বেগম ফয়জুন নাহার শেলী ।।
‘বাবা কতদিন কতদিন দেখিনা তোমায়/ কেউ বলেনা তোমার মত কোথায় খোকা ওরে বুকে আয়।’ সেই যে বাবা ১৯৯৬ এর ২মার্চ পরওয়ারদিগারের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন আর ফিরে এলেন না। রেখে গেলেন অনেক অনেক স্মৃতি। আজ জুন মাসের তৃতীয় রবিবার আন্তর্জাতিক বাবা দিবস ।এই বিশেষ দিনটিতে অন্য সবদিন ছাপিয়ে আরো বেশি করে বাবার কথা মনে পড়ছে । জীবনের স্মৃতির স্তুপ সরিয়ে সরিয়ে এই বিশেষ দিনটিতে তাঁর কথা বিশেষ করে পিতা হিসাবে সন্তান লালন পালনের কিছু স্মৃতি সবার সাথে ভাগ করে নিচ্ছি। তবে তার আগে বাবা দিবসের ইতিহাসটার সাথে একটু পরিচিত হই।
মধ্যযুগ থেকে ইউরোপের ক্যাথলিক দেশগুলোতে বাবা দিবস হিসেবে সেন্ট জোসেফ দিবস পালিত হতো।তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বাবা দিবস হিসেবে একটি বিশেষ দিন পালিত হতো। মায়ের পাশাপাশি বাবাও যে নীরবে-নিভৃতে অবলীলায় সন্তানের প্রতি দায়ভার বয়ে বেড়ান, তাকে আগলে রাখেন, শেষ বিকেলের মহিরুহুর বিশাল ছায়ার মত সমস্ত ঝড়ঝঞ্জা থেকে সন্তানকে সামলে রাখেন এটা বোঝানোর জন্য এ দিবসটি পালনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখতে পাই – ১৯০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় এক ভয়ানক খনি বিস্ফোরণে ৩৬০ জন পুরুষ প্রাণ হারায় ।এদের মধ্যে ২১০জনই ছিলেন সন্তানের বাবা। বিষয়টি মিসেজ গ্রেস গোল্ডেন ক্লিনটনকে পীড়া দেয়। তিনি ফেয়ারমন্টের মেথোডিস্ট গির্জার জাযককে বাবার সম্মানে ১৯০৮সালের ৫ জুলাইকে মৃত বাবাদের নামে উৎসর্গ করার অনুরোধ জানান। এটা ছিল মিসেস গ্রেসের বাবার জন্মদিন । তবে তা নিয়মিত হয়নি । আবার এও শোনা যায়, এ ঘটনার দু’বছর পর মিসেস সেনোরাস্মার্ট বট নামের ওয়াশিংটনের এক ভদ্রমহিলার মাথায় বাবা দিবস পালনে ধারণা আসে। তিনি পূর্বে অনুষ্ঠিত বাবা দিবসের বিষয়টি জানতেন না। গির্জার এক ধর্মযাজক তার বক্তব্যে মাকে নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন।তখন তার মনে হয়েছিল, তাহলে বাবাকে নিয়েও কিছু করা দরকার। কারণ বাবা মার মতই ত্যাগী হন । তার বাবা উয়িলিয়াম স্মার্ট একজন সৈনিক ছিলেন। ষষ্ঠ সন্তান জন্মদানের সময় তার মা মারা যান। তারপর শত দুঃখ কষ্টের মধ্যে থেকেও তার বাবা ছয় সন্তানকে আগলে রাখেন এবং একাই লালন-পালন করেন। তাই সেনোরা স্মার্ট বট তার বাবার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাতেই এই দিনটি পালনের উদ্যোগ নেন এবং সেই মতে ১৯১০ সালের ১৯ জুন সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে বাবা দিবস পালনের সূচনা করেন। তবে সেনোরা স্মার্ট ডটকে বাবা দিবসের উদ্যোক্তা মনে করা হলেও ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপক্ষ একটি ঐতিহাসিক ফলক স্থাপনের মাধ্যমে ফেয়ারমন্টকে বাবা দিবসের জন্মস্থান হিসেবে ঘোষণা দেয়।
এদিনটি প্রথমদিকে অত্যন্ত ঢিলেঢালাভাবে পালিত হতো। অবস্থা ধীরে ধীরে পাল্টায়। ১৯১৩ সালে আমেরিকার সংসদে বাবা দিবস কে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করার জন্য একটি বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে আমেরিকার ৩০ তম প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন ক্যুলিজ বিলটি সম্পূর্ণ অনুমোদন করেন। এরপর ১৯৬৬সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন বাবা দিবস কে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রতিবছর জাতীয়ভাবে বাবা দিবস পালনের রীতি চালু করেন।
বিশ্বের সর্বত্র একই সাথে এ দিনটি পালন করা না হলেও অধিকাংশ দেশে অর্থাৎ ১১১টির বেশি দেশে জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এ দিনটি পালিত হয়।
থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা এবং দেশটির জনক ভূমিবল আদুলিয়াদেজের জন্মদিন ৫ডিসেম্বর বাবা দিবস পালিত হয়। এদিন সেদেশের নাগরিকরা হলুদ কাপড় পরেন।
মেক্সিকোতে এ দিনে ১৩ মাইল লম্বা একটি দৌড় প্রতিযোগিতা হয়।এ দৌড়ে বাবার সাথে সন্তানও অংশ নেয়। জার্মানিতে বাবারা কয়েকটি গ্রুপ হয়ে হাইকিং এ বেড়োন।
ফ্রান্সে বিভিন্ন উপহার সামগ্রীর সাথে বাবাকে লাল গোলাপ দেয়া হয়। তবে বাবা মৃত হলে তাঁর সমাধিতে সাদা গোলাপ রেখে আসে। “পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহী পরম্ঙ তপঃ। পিতরী প্রিতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা।”
আমার বাবা বজলুল হক মিয়া ( সাবেক প্রধান শিক্ষক, বরিশাল জিলা স্কুল, পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক, বরিশাল এ, কে স্কুল) একজন আপাদমস্তক শিক্ষক ছিলেন। কী প্রাতিষ্ঠানিক, কী পারিবারিক সর্বক্ষেত্রে। ছোটবেলার যখন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হইনি তখন আমাদের দু বোনকে (আমি আর মেজো বোন) সাথে করে বরিশাল জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাসার সামনের পুকুরটিতে নিয়ে যেতেন সাঁতার শিখাতে। নিজের হাতের ওপর তুলে সাঁতার শেখাতেন। আমপারা থেকে কুরআন মাজীদও তাঁর কাছে শেখা। তোতলামি করে পড়লে হবেনা, গড়গড় করে পড়তেহবে। তিনিবলতেন, “পুথি পড়ে থুতিতে, কোরআন পড়ে মুন্সীতে।”
আজও মনে পড়ে শীতের দিনে ভোরবেলা বরিশাল ব্রাউন কম্পাউন্ডের বাসার দোতলার বারান্দায় তিনি একটি বড় কাশ্মীরি শাল জড়িয়ে নামাজ পড়তেন । নামাজ শেষে তাঁর কাছে গেলে তিনি ওই চাদরের মধ্যে আমাকে নিয়ে বসে কখনও কোরআনের আয়াত কখনো পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবর কবিতা আবৃত্তি করে শুনাতেন। হেসে হেসে আবৃত্তি করতেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিষ্কৃতি কবিতার প্রথম ক’টি চরণ-
“মা কেঁদে কয়” মন্ঞ্জুলি মোর ঐ তো কচি মেয়ে/ওরি সঙ্গে বিয়ে দেবে।-বয়সে ওর চেয়ে/পাঁচ গুণো সে বড়ো,/তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়সড়/এমন বিয়ে ঘটতে দেব না কো।/বাপ বলে, “কান্না তোমার রাখো/পঞ্চাননকে পাওয়া গেছে অনেক দিনের খোঁজে,/জানো না কি মস্ত কুলীন ও-যে।
সমাজে তো উঠতে হবে সেটা কি কেউ ভাবো/ওকে ছাড়লে পাত্র কোথায় পাব।”
আবার কখনো বা মুক্তি কবিতা থেকে আবৃত্তি করে শুনাতেন।-
“ডাক্তারে যা বলে বলুক নাকো, রাখো রাখো খুলে রাখো,
শিওরের ঐ জানালা দুটো,-গায়ে লাগুক হাওয়া/ওষুধ? আমার ফুরিয়ে গেছে ওষুধ খাওয়া।”
কবিতাটির প্রতিটি ছত্রই আমাকে নাড়া দেয়। জানি রবীন্দ্রনাথ মাত্রেই এমন। তারপরও এ কবিতাটি থেকে আরো কয়েকটি ছত্র উদ্ধৃত করছি।
“আনন্দ আজ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে প্রাণে/আমি নারী, আমি মহীয়সী/আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্না-বীণায় নীদ্রা-বিহীন শশী/আমি নইলে মিথ্যা হোত সন্ধ্যা-তারা ওঠা, মিথ্যা হোত কাননে ফুল ফোটা।”
আর এমনি করেই আমার মধ্যে এ বিশ্বাস দৃঢ় হল, “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/চূণী উঠলো লাল হয়ে,”
তিনি ‘অন্তর্যামী’ কবিতাটি পুরোটাই মুখস্থ শোনাতেন । গোলাম মোস্তফার ‘শিক্ষক’ কবিতাটির লিখিত অর্থাৎ ছাপা রূপটি আজ অবধি দেখিনি। দেখা হয়নি ‘পান্তুয়া আর সন্দেশ’ এবং ‘আমি একটা হাবা মেয়ে:: ছড়া দুটো। আজও জানা হয়নি এ চমৎকার ছড়া দুটির শিরোনাম বা লেখকের নাম । কিন্তু তার কাছ থেকে শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘অভিশাপ’ কবিতাটি তিনি খুব পছন্দ করতেন। আর কবিতাগুলো আবৃত্তি করার সময় এমনভাবে করতেন যেন এগুলো তাঁরই কথা। কোরআন মাজীদ অনুবাদসহ পড়তেন আর মাঝেমধ্যে আমাদের কিছু কিছু জায়গা থেকে অনুবাদ করে বলতেন ,”দেখ, চোদ্দ পনেরো শত বছর আগে মহাজ্ঞানী আল্লাহপাক রাসূল (সা:) এর মাধ্যমে মানুষকে এ কথাগুলো জানিয়েছেন আর মানুষ এখন তা আবিষ্কার করছে।” আব্বা অপব্যয়িকে মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, ইন্নাল বুবাজ্জিরিনা কানু ইখওয়ানিশ শয়াতিন।(জানিনা ঠিক হল কিনা)।এর অর্থ হল, অপব্যয়ি শয়তানের ভাই।
সব সময় নামাজ পড়ার তাগিদ দিতেন। ঠিকমত নামাজ না পড়লে বলতেন, রাসুলুল্লাহ (স:)ই তাঁর চাচাকে ঠিক করতে পারলেন না। আমিতো ছার। আমার ছোটভাইরা বাসার ছাদে আজান দিয়ে আব্বার ইমামতিতে নামাজ পড়তেন।
পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে আব্বা কখনো বকাঝকা বা মারধর করতেন না। বরং ভবিষ্যতে ভালো করার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। একদিন ( ঠিক কোন শ্রেণি মনে নেই) আমার মেজ বোন অংকে কম নম্বর পাওয়ায় ওর মন খারাপ। আব্বা ওকে বোঝালেন, আরে আমিতো নাইন থেকে টেনে শূন্য পেয়ে উঠেছি। তবে সেই আমিই টেনএ বসে আমার সহপাঠীদের অংক শিখিয়েছি। বলাবাহুল্য আমার সেই মেজ বোন বৃত্তি নিয়ে ম্যট্রিক পাশ করেছিল। জনান্তিকে বলে রাখি আমরা কিন্তু কেউই ক্লাসে প্লেস পেতাম না। তবে একদম পিছনের সারির শিক্ষার্থীও ছিলাম না। তিনি জীবনে পুঁথিগত শিক্ষার থেকে মৌলিক শিক্ষার উপর জোর দিতেন বেশি। তিনি বলতেন, পুস্তকস্য বিদ্যা পরহস্ত ধন কার্যকালে নস বিদ্য নস ধন (ঠিক মতো বলতে পারলাম কিনা জানিনা)।যার অর্থ, বইয়ের বিদ্যা (মুখস্ত বিদ্যা) আর পরের ভরসায় রাখা অর্থ প্রয়োজনে কোনো কাজেই আসেনা।
তিনি আরও বলতেন,”আগার ফেরদৌস বার রোএ জামিনাস্ত/হামিন আস্ত, হামিন আস্ত, হামিন আস্ত।”অর্থাৎ পৃথিবীর কোথাও যদি স্বর্গ থেকে থাকে/তা এখানে, এখানে, এখানে। তখন কিন্তু আমি ফারসির ফও জানতাম না। এমনকি জানবো যে তাও কোনদিন কল্পনা করিনি।
হ্যা, আমাদের পরিবারের ভীত ছিল পারস্পরিক সম্মানের উপর প্রতিষ্ঠিত। আব্বা জীবনে আম্মাকে রাগী সুরে কোনো কথা বলেছেন বলে আমার মনে পড়েনা। আম্মাও আব্বাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতেন। আম্মা বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে খুব জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কাছে কখনো বই নিয়ে পড়তে বসেছি কিনা মনে পড়েনা। আব্বা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে পড়াতেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ছিলেন কিন্তু ইংরেজি সহ মানবিক বিভাগের অন্যান্য বিষয়ের উপর তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের পাঠ্য ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ’। আব্বা এত সুন্দর করে গল্প বলে বলে পড়িয়েছেন যে ঐ শ্রেণিতে থাকতেই আমি ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য শেষ করেছিলাম। মুখস্ত করেছিলাম কবির সমাধিতে লেখা স্বরচিত এপিটাফ। আটলান্টিক স্রোত কিভাবে সহজ করে পড়াতেন তা ভাবলে অবাক লাগে।ঝালকাঠিতে যখন তিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন তখন রাতে স্কুল ক্যাম্পাসে হেঁটে হেঁটে তিনি আমাদের আকাশের তারা চেনাতেন। কোনটা সপ্তর্ষি, সপ্ত ঋষির নাম, ক্যাথিওপিয়া, সন্ধ্যাতারা সব তিনি আকাশের তারাগুলোকে দেখিয়ে শেখাতেন।
একত্রে বসে রেডিওতে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার ধারাবর্ণনা শুনতাম।কী যে উত্তেজনাকর সে ধারাবর্ণনা!এখনো নস্টালজিক হয়ে যাই। আব্বা খুব ভালো ভলিবল ও ফুটবল খেলতে পারতেন। আর ছাত্রদের সাথে সমানে পাল্লা দিয়ে খেলতেন। আমরা দর্শকের সারিতে বসে এ খেলা উপভোগ করতাম। হ্যা, তাসও খেলতেন। তবে আমাদের সাথে। ব্রে খেলতাম। বড়আপা খেলতে পারতেন না বলে আব্বা তার পিছনে বসে সাহায্য করতেন। তবে খেলা যেন নেশায় পরিণত না হয় এ ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক ছিলেন। তিনি বলতেন, ক্যারাম খেলাও হারাম যদি তা তোমার কর্তব্যকে ভুলিয়ে নেশায় পরিণত করে।
আব্বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবণ্তী মজুমদারের সেই বিখ্যাত গান “আয় খুকু আয়’এর জীবন্ত প্রতিমূর্তি। একদিন আমার মেজবোন কবি নজরুল ইসলামের ‘নূরজাহান’ গানটি গাইছেন এবং “ইরানি গুলিস্হান” শব্দটি উচ্চারণ করলেন। আব্বা সাথে সাথে শুধরে দিলেন গুলিস্হান নয় গুলিস্তান। শরীর বানানে শরির লিখতাম। একদিন আব্বা বললেন, তোর শরীর ঠিক হলে বানানটা ঠিক হবে। আজও শরীর লিখতে গেলে সেকথা মনে পড়ে। শরীরে আর ভুল হয়না। ঘরে বসে অকারণে সাজুগুজু করে আব্বার সামনে দাঁড়াতাম।আব্বা ভীষণ খুশী হতেন।
স্কুলে টাইগার উপাধিতে খ্যাত এই মানুষটি ঘরোয়া পরিমণ্ডলে একদম অন্য জগতের। আমাদের পারিবারিক আড্ডা আব্বার বিছানায় বসেই হতো। আমার জীবনে রান্নার ক্ষেত্রে আব্বার অবদান অনেক। জীবনে প্রথম পিঠা বানানোর শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। আমাদের বরিশালে যাকে বলে মুইঠ্ঠা পিঠা। রান্নায় হেরফের হলে কখনো বিরক্ত হতেন না বরং হাসিমুখে খেয়ে উঠতেন। শব ই বরাতের দিন রুটি বানানোর সময় তিনি রান্নাঘরে আমাদের পাশে থাকতেন। কখনো বা রুটি ভেজে দিতেন। সেলাই করার সময় তিনি অনুপ্রেরণা দিতেন। এ কাজটি তিনি খুব পছন্দ করতেন। তবে খাওয়া পড়াটা নির্দিষ্ট সময় মাফিক করতে হতো।এ ক্ষেত্রে কোন ক্ষমা নেই। সন্ধ্যার আগে ঘরে না ফিরলে খবর হয়ে যেতো। এজন্য ভাইয়েরা যে কত বকাঝকা ও মার খেয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। এমনকি খেলার মাঠে কারো সাথে মারামারি হলে বা ব্যথা পেলে আব্বা আম্মার কাছে নালিশ করার জো টি নেই। কারণ তাদের বিচার, এমন বন্ধু বান্ধবের সাথে মিশো কেন ? তোমরা না গেলে তো এটা হতো না। তাই ব্যথা পেয়েও ভাইয়ারা কখনো আব্বার কাছে নালিশ করতে সাহস পায়নি। তাহলে সেকেন্ড রাউন্ডে ফ্রি স্টাইলে একতরফা মার খেতে হত। কারো নামে গীবত করা একদম পছন্দ করতেন না। খাবার টেবিল তাঁর কাছে আরেকটি ইবাদতের স্থান ছিল। সেখানে বসে বেশি কথা বললে বা কারো নামে বদনাম করলে তিনি ভাতের টেবিল থেকে উঠে যেতেন। সমস্ত হাতের মধ্যে ভাত মেখে খাওয়া বা পানির গ্লাসটা টইটুম্বুর করে ভরা তিনি পছন্দ করতেন না। বড় মাছের মাথা বা দুধের সর যথারীতি আব্বার থালায় দেয়া হলেও তিনি কখনও তা একা খান নি। সবাইকে একটু একটু করে দিয়েছেন। পারিবারিক বন্ধনের যে আনন্দ তা আমাদের বাসায় এসে অনেকেই উপভোগ করতেন।
ছাত্রদের তিনি বেত্রাঘাত করেছেন আবার ভালোও বেসেছেন। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছাত্রদের তিনি বিনা পারিশ্রমিকে বাসায় এনে পড়িয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত অনেক ছাত্রর কাছ থেকে শুনেছি, “তাঁর সেদিনের সেই বেতের জন্যই আজ আমরা এখানে এসে দাঁড়াতে পেরেছি।”
এ প্রসঙ্গে আব্বার জীবনের আরেকটি ঘটনা সবাইকে জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না। সন-তারিখটা ঠিক মনে নেই। সম্ভবত ১৯৬৭ কি’৬৮ সালের কথা। আব্বা তখন ঝালকাঠি সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আওলাদ নামে এক ছাত্র পরীক্ষায় নকল করার অপরাধে স্কুল থেকে বহিস্কার হয়েছে। সেদিন ছিল শবে বরাতের রাত। আব্বা গিয়েছেন থানায় স্থানীয় ওসি সাহেব মিলাদের আয়োজন করেছেন সেই দাওয়াতে।আর আমরা গিয়েছি আব্বার সহকর্মী মুজাম্মেল কাকার বাসায়। (কাকা পরবর্তীতে বরিশাল জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন) বড়আপা আর বড় ভাইয়া বাসায়। তখন ঝালকাঠিতে ছিলেন আনোয়ার ওসি। হ্যা, খুব নামকরা ওসি। এদিকে আওলাদ এসেছে বাসায় আব্বার সাথে দেখা করতে। বড় ভাইয়া আওলাদকে দেখে কোলাকুলি করতে গিয়ে ওর কোমরে খোলা ছুরি টের পেল। ঘটনা বুঝতে ভাইয়ার সময় লাগলো না। ভাইয়া ওকে বসিয়ে রেখে বড়আপাকে সতর্ক করে সোজা থানায় গিয়ে বিষয়টি আব্বাকে জানালো। আনোয়ার ওসি তৎক্ষণাৎ আব্বাকে সাথে নিয়ে বাসায় এলেন এবং আওলাদকে হাতে নাতে ধরে ফেললেন। ব্যাস, আর যায় কোথায়? সরকার-বাদী কেস হয়ে গেল। ঘটনা জেনে আওলাদের বড়ভাই চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে পাকিস্তান থেকে ভাইকে বাঁচাতে ছুটে এলেন। কিন্তু ওসি সাহেব নিজের হাতে উন্মুক্ত ছুরিসহ আওলাদকে ধরে ফেলায় ব্যাপারটি কঠিন আকার ধারণ করে। উপায়ন্ত না দেখে ভদ্রলোক আব্বার কাছে এসে কেঁদে পরলেন। আব্বা ছেলেটার ভবিষ্যৎ ভেবে ক্ষমা করে দিলেন। বস্তুত: এঁরাই আদর্শ শিক্ষক। আব্বার নামাজ কাজা হতে কখনো দেখিনি। শেষ জীবনে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায়ও আজান দিলেই নামাজে বসে পড়তেন। দাঁড়িয়ে পড়তে পারতেন না।একদিন আব্বাকে বললাম, ” আরেকটু পরে পড়না। “আব্বা বললেন, “নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নাই।”
কত বলব এই মানুষটির কথা! বলে শেষ হয় না। তাঁর প্রতিটি পরতে পরতেই শিক্ষা। রেডিও তেহরানে কাজ করছি। আব্বাকে লিখলাম,” আব্বা এখানে কষ্ট হয়। ঘরে কাজের মানুষ নেই। যেদিন গাড়ি মিস করি সেদিন চার তলার সমান পাহাড় বেয়ে অফিসে ঢুকতে হয়।” উত্তরে আব্বা আর দশজন মা বাবার মতো বললেন না যে, “মা তোমার কাজ করার দরকার নেই।” উল্টো লিখলেন,” পৃথিবীতে যে জাতি যত পরিশ্রমী, সে জাতি তত উন্নত।”
এই শিক্ষক পিতার কন্যার ( আমার) কাছে লেখা একটি চিঠি দিয়ে ইতি টানছি। এ সময় আব্বা পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তবে আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় চিঠির উত্তর তিনি ঠিকই দিয়েছেন। আম্মা শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হবার খবর শুনে আব্বাকে লেখা আমার চিঠির উত্তর। বলাবাহুল্য আম্মাকে এ পর্যায় নিয়ে আসার সিংহভাগ কৃতিত্ব আব্বার। কারণ আব্বা কখনো স্বামী ছিলেন না, ছিলেন ‘ হামছার’ বা ‘জীবনসঙ্গী’। আর একটা কথা আম্মা চিঠি লেখার ব্যাপারে ভীষণ আলসে ছিলেন। তাই তার এ কৃতিত্বের আনন্দ প্রকাশ করে চিঠিটা আব্বাকে লিখেছিলাম। ১৯৯১ সালের অগাস্ট মাসে লেখা এ চিঠিটি পড়তে পাঠকের সমস্যা হতে পারে বিধায় চিঠিটির অনুলিপি দিলাম।
বরিশাল ১৮/৮/৯১
মা শেলী, আদর নিও।
তোমার চিঠি পেয়েছি কাল। চিঠি পেয়ে যে কত আনন্দিত হয়েছি তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। আমার মনে হয় তুমি যতটুকু আনন্দিত হয়েছ দুনিয়ার আর কেউই এতোটুকু আনন্দিত হয়নি। আমাদের জীবনেও কেন পূর্বের অনেক কথা তুমি মনে করেছ। আমার ছোটকাল, তোমার নানাভাই, যাকে তোমরা নানা হিসাবে পাওনি , তোমার বড়মা, যাকে তোমরা দাদু ডাকতে আরো কত কী যে তুমি স্মরণ করেছ যা আমাদের এখনো মনে হয় না অথচ ঘটনা সত্য। চেষ্টার অসাধ্য কিছুই নেই। কে ভেবেছে যে আমরা বড় হব। লোকের এত আদর যত্ন কুড়াবো।
ওই হিন্দু মেয়েটির কথা কিছুটা মনে পড়ে। আমার একটি ছাত্রের মা। ওরা আমাকে যে কত ভালোবাসতো তা বলে শেষ করা যায় না। মানুষকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পুরস্কার আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। কে ভেবেছে আল্লাহ আমাকে মানুষ করবে। স্কুলে যখন পড়ি ১৯২৯-১৯৩২ পর্যন্ত তখন ছয় পয়সা Poor fundর পয়সা স্কুলে দেওয়ার সামর্থ ছিলনা।
আর আজ! আল্লাহ আমাকে কত সুখ স্বাচ্ছন্দ ঐশ্বর্য দিয়েছেন। তোমাদের মত ছেলে মেয়ে কজন লোকের আছে ? হ্যাঁ ঠিকই। আমার জীবন সার্থক হয়েছে। বাকি ছিল – তোমার আম্মা রীতিমতো নামাজ পড়ে না। আল্লাহ সেটাও পূরণ করে দিয়েছেন। আমি কোন কথাই ঠিক মতো গুছিয়ে লিখতে পারিনা। সুযোগ পেলে আবার লিখব। মুন্নাকে নিয়েই দিনকাটাই। গত শুক্রবার ঢাকা গেছে। আজ ওর একটা পরীক্ষা ঢাকাতে। আবৃত্তি পরীক্ষা। ভালো করলে জানাবো। কাল বা পরশু এখানে হয়তো আসবে।
আমার ভাইয়াকে আদর দিও । ওর আব্বা কেমন আছে? ওকে আমার দোয়া জানাবে। চিঠি দিও। ইতি, তোমার ছেলে, ১৬/৮/৯১
বস্তুত মা-বাবার কথা বলে কোন সন্তানই শেষ করতে পারে না। তার উপর তিনি বা তাঁরা যদি হন শিক্ষক, তাহলে তো কথাই নেই। আমার দৃষ্টিতে শিক্ষক পিতা-মাতার সন্তানরা নিজেদের মা-বাবার ব্যাপারে একটু অহংকারী হন। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। ইরানে থাকাকালীন একটি সিনেমা চলছি ,”বেহতারিন ফেদারে দুনিয়া আস্ত।” অর্থাৎ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পিতা। বইটি দেখার প্রচন্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে দেখা হয়নি। তবে আফসোস নেই। আমার জীবনে আমার বাবা যেমন বেহতারিন ফেদারে দুনিয়া আস্ত। তেমনি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকও তিনি। তিনি আমাদের বইয়ের পাঠ যেমন শিখিয়েছেন জীবনের পাঠও তেমনি দান করেছেন। হে আল্লাহ, তুমি তাঁকে তোমার রহমতের ছায়ায় স্থান দিও। আমিন।
বেগম ফয়জুন নাহার শেলী প্রাক্তন বাংলা প্রভাষক, বরিশাল ইসলামিয়া কলেজ