আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক

বেগম ফয়জুন নাহার শেলী

শিক্ষক শব্দটির বৎপত্তি হল শিক্ষ্ +ণিচ= শিক্ষি (উপদেশ দেয়া)+ অক= শিক্ষক। অর্থাৎ যিনি উপদেশ দেন তিনিই শিক্ষক। প্রচলিত অর্থে, যিনি শিক্ষা দান করেন তিনিই শিক্ষক। এ অর্থে কবি সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতাটির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলা যায়- `বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র/ নানা ভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবা রাত্র’।

এদিক দিয়ে শিক্ষক হলো আকাশ, বায়ু, পাহাড় অর্থাৎ প্রকৃতি। তবে শিক্ষক দিবসের এই শিক্ষক হলেন, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষা দান করেন।

শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো (UNESCO) ১৯৯৫ সালে ৫ অক্টোবরকে শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। বিশ্বের ১০০টি দেশে এ দিবসটি পালন করা হয়। Educational International (E I) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন এ দিনটি পালনে মূল ভূমিকা রাখে। এ উপলক্ষে E I প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অনন্য অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। এবারে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হল ‘শিক্ষক : সংকটে নেতৃত্বে ভবিষ্যতের পুনর্নিমাণ’।

তবে বিশ্বের সব দেশই যে ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস পালন করে এমনটি নয়। ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি (১৯৫২-১৯৬২) এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি (১৯৬২-১৯৬৭) ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান (০৫/০৯/১৮৮৮____১৭/০৪/১৯৭৫) একাধারে শিক্ষাবিদ অন্যদিকে রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তার গুণমুগ্ধ ছাত্র ও বন্ধুরা ৫ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন পালন করতে চাইলে তিনি এই দিনটিকে শিক্ষক দিবস বলে পালন করার প্রস্তাব রাখেন। সেই থেকে ভারতে ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে। অনুরূপভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে সে দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সৈয়দ মর্তুজা মোতাহহারীর শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি ও সম্মান স্বরূপ তাঁর জন্মদিন ২ মে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সে হিসেবে আমাদের বাংলাদেশের অহংকার ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১০/০৭/১৮৮৫—১৩/০৭/১৯৬৯)র জন্মদিন ১০ জুলাইকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব রেখে মূল আলোচনায় আসা যাক।

আমার জীবনের প্রিয় শিক্ষক অনেকেই। কার কথা বাদ দিয়ে কার কথা বলব? সেই ছোটবেলায় যখন বরিশাল হালিমা খাতুন বালিকা বিদ্যালয় ইনফ্যান্, ওয়ান, টুতে পড়েছি তখন দুলু আপা ক্লাসে ঢুকেই প্রথম আমাকে কোলে নিতেন তারপর পড়ানো শুরু করতেন। এই সেদিনও ছায়া আপা আমাকে ফোন করে বললেন, ‘এই তোর ছোটবেলার কোন ছবি আছে? আমি বললাম, না । উনি বললেন, ‘গুড্ডু গুড়িয়া সিরিয়াল টা দেখিস ? তুই ঐ গুড়িয়ার মতো দেখতে ছিলি। এরপর যখন বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হলাম তখনও সবার স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি। এমনকি বড়দি অর্থাৎ শান্তি  গুহ দিদির মত রাশভারী মহিলার চোখেও আমার জন্য অনেক স্নেহ দেখেছি । আব্বার বদলি সূত্রে ঝালকাঠি হরশ্চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম । সেখানেও বড় আপা থেকে শুরু করে সবাই স্নেহ করতেন। বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে বরিশাল উম্যান্স কলেজে (উম্যান্স কলেজ নাম ছিল তাই সরকারি মহিলা কলেজ লিখলাম না) ভর্তি হলাম । সেখানেও অনেক স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি । আজও মাঝেমধ্যে খাতুন মাহমুদা (বুড়ি) আপার সাথে দেখা হলে সাদরে পাশে নিয়ে বসান। তারপর বরিশাল ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ । এখানে শিক্ষকরা শুধু শিক্ষক রইলেন না। শ্রদ্ধার পাশাপাশি তাদের সাথে এক ধরনের সখ্যতা গড়ে উঠলো । আনন্দের সাথে শিক্ষা গ্রহণ করেছি সব শিক্ষকের কাছ থেকেই । আমার শিক্ষকরা যেমন প্রয়োজনে শাসন করেছেন তেমনি সোহাগও  করেছেন । তাই বলবো কাকে রেখে কাকে প্রিয় শিক্ষক বলি? সবাই তো প্রিয়। তবে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বলে কাউকে নির্দিষ্ট করতে হলে আমি আমার শিক্ষক পিতার কথাই বলবো।

হ্যা, আমার বাবা বজলুল হক মিয়া (অব: প্রধান শিক্ষক, বরিশাল জিলা স্কুল, পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক, বরিশাল এ,কে স্কুল) একজন আপাদমস্তক শিক্ষক ছিলেন। কী প্রাতিষ্ঠানিক, কী পারিবারিক সর্বক্ষেত্রে। ছোটবেলায় যখন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হইনি তখন আমাদের দু বোনকে (আমি আর মেজো বোন) সাথে করে বরিশাল জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাসার সামনের পুকুরটিতে নিয়ে যেতেন সাঁতার শিখাতে। নিজের হাতের ওপর তুলে সাঁতার শেখাতেন। আমপারা থেকে কুরআন শরীফও তাঁর কাছে শেখা। তোতলামি করে পড়লে হবেনা, গড়গড় করে পড়তে হবে। তিনি বলতেন, ‘পুথি পড়া থুতির কাম, কোরআন পড়া মুন্সীর কাম’।

আজও মনে পড়ে শীতের দিনে ভোরবেলা বরিশাল ব্রাউন কম্পাউন্ডের বাসার দোতলার বারান্দায় তিনি একটি বড় কাশ্মীরি শাল জড়িয়ে নামাজ পড়তেন। নামাজ শেষে তাঁর কাছে গেলে তিনি ওই চাদরের মধ্যে আমাকে নিয়ে বসে কখনও কোরআনের আয়াত, কখনো পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবর কবিতা আবৃত্তি করে শুনাতেন। হেসে হেসে আবৃত্তি করতেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিষ্কৃতি কবিতার প্রথম ক’টি চরণ-

মা কেঁদে কয় মন্ঞ্জুলি মোর ঐ তো কচি মেয়ে / ওরি সঙ্গে বিয়ে দেবে।-বয়সে ওর চেয়ে

পাঁচ গুণো সে বড়ো / তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়সড়।

এমন বিয়ে ঘটতে দেব না কো / বাপ বলে, কান্না তোমার রাখো;

পঞ্চাননকে পাওয়া গেছে অনেক দিনের খোঁজে / জানো না কি মস্ত কুলীন ও-যে।

সমাজে তো উঠতে হবে সেটা কি কেউ ভাবো / ওকে ছাড়লে পাত্র কোথায় পাব।

আবার কখনো বা মুক্তি কবিতা থেকে আবৃত্তি করে শুনাতেন।-

ডাক্তারে যা বলে বলুক নাকো /রাখো রাখো খুলে রাখো,

শিওরের ঐ জানালা দুটো,-গায়ে লাগুক হাওয়া

ওষুধ? আমার ফুরিয়ে গেছে ওষুধ খাওয়া।

তিনি ‘অন্তর্যামী’ কবিতাটি পুরোটাই মুখস্থ শোনাতেন । গোলাম মোস্তফার ‘শিক্ষক’ কবিতাটির লিখিত অর্থাৎ ছাপা রূপটি আজ অবধি দেখিনি। দেখা হয়নি ‘পান্তুয়া আর সন্দেশ’ এবং ‘আমি একটা হাবা মেয়ে : ছড়া দুটো। আজও জানা হয়নি  এ চমৎকার ছড়া দুটির শিরোনাম বা লেখকের নাম । কিন্তু তার কাছ থেকে শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘অভিশাপ’ কবিতাটি তিনি খুব পছন্দ করতেন। আর কবিতাগুলো আবৃত্তি করার সময় এমনভাবে করতেন যেন এগুলো তাঁরই কথা । কোরআন মাজীদ অনুবাদসহ পড়তেন আর মাঝেমধ্যে আমাদের কিছু কিছু জায়গা থেকে অনুবাদ করে বলতেন, ‘দেখ, চৌদ্দ পনেরো শত বছর আগে মহাজ্ঞানী আল্লাহপাক রাসূল (সা:) এর মাধ্যমে মানুষকে এ কথাগুলো জানিয়েছেন আর মানুষ এখন তা আবিষ্কার করছে।

আমাদের পরিবারের ভীত ছিল পারস্পরিক সম্মানের উপর প্রতিষ্ঠিত। আব্বা জীবনে আম্মাকে রাগী সুরে কোনো কথা বলেছেন বলে আমার মনে পড়েনা। আম্মাও আব্বাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতেন। আম্মা শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কাছে কখনো বই নিয়ে পড়তে বসেছি কিনা মনে পড়েনা। আব্বা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে পড়াতেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ছিলেন কিন্তু ইংরেজি সহ মানবিক বিভাগের অন্যান্য বিষয়ের উপর তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের পাঠ্য ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ’। আব্বা এত সুন্দর করে গল্প বলে বলে পড়িয়েছেন যে ঐ শ্রেণিতে থাকতেই আমি ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য শেষ করেছিলাম। মুখস্ত করেছিলাম কবির সমাধিতে লেখা স্বরচিত এপিটাফ। আটলান্টিক স্রোত কিভাবে সহজ করে পড়াতেন তা ভাবলে অবাক লাগে। ঝালকাঠিতে যখন তিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন তখন রাতে স্কুল ক্যাম্পাসে হেঁটে হেঁটে তিনি আমাদের আকাশের তারা চেনাতেন। কোনটা সপ্তর্ষি, সপ্ত ঋষির নাম ক্যাথিওপিয়া, সন্ধ্যাতারা সব তিনি আকাশের তারাগুলোকে দেখিয়ে শেখাতেন।

স্কুলে টাইগার উপাধিতে খ্যাত এই মানুষটি ঘরোয়া পরিমণ্ডলে একদম অন্য জগতের। আমাদের পারিবারিক আড্ডা আব্বার বিছানায় বসেই হতো। আমার  জীবনে রান্নার ক্ষেত্রে আব্বার অবদান অনেক। জীবনে প্রথম পিঠা বানানোর শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। আমাদের বরিশালে যাকে বলে মুইঠ্ঠা পিঠা। রান্নায় হেরফের হলে কখনো বিরক্ত হতেন না বরং হাসিমুখে খেয়ে উঠতেন। শব ই বরাতের দিন রুটি বানানোর সময় তিনি রান্নাঘরে আমাদের পাশে থাকতেন। কখনো বা রুটি ভেজে দিতেন। সেলাই করার সময় তিনি অনুপ্রেরণা দিতেন। এ কাজটি তিনি খুব পছন্দ করতেন। তবে খাওয়া পড়াটা নির্দিষ্ট সময় মাফিক করতে হতো। এ ক্ষেত্রে কোন ক্ষমা নেই। সন্ধ্যার আগে ঘরে না ফিরলে খবর হয়ে যেতো। এজন্য ভাইয়েরা যে কত বকাঝকা ও মার খেয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। এমনকি খেলার মাঠে কারো সাথে মারামারি হলে বা ব্যথা পেলে আব্বা আম্মার কাছে নালিশ করার জো টি নেই। কারণ তাদের বিচার, এমন বন্ধু বান্ধবের সাথে মিশো কেন? তোমরা না গেলে তো এটা হতো না। তাই ব্যথা পেয়েও ভাইয়ারা কখনো আব্বার কাছে নালিশ করতে সাহস পায়নি। কারো নামে গীবত করা একদম পছন্দ করতেন না। খাবার টেবিল তাঁর কাছে আরেকটি ইবাদতের স্থান ছিল। বড় মাছের মাথা বা দুধের সর যথারীতি আব্বার থালায় দেয়া হলেও তিনি কখনও তা একা খান নি। সবাইকে একটু একটু করে দিয়েছেন। পারিবারিক বন্ধনের যে আনন্দ তা আমাদের বাসায় এসে অনেকেই উপভোগ করতেন।      ছাত্রদের তিনি বেত্রাঘাত করেছেন আবার ভালোও বেসেছেন। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছাত্রদের তিনি বিনা পারিশ্রমিকে বাসায় এনে পড়িয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত অনেক ছাত্রর কাছ থেকে শুনেছি, ‘তাঁর সেদিনের সেই বেতের জন্যই আজ আমরা এখানে এসে দাঁড়াতে পেরেছি’।

আব্বার নামাজ কাজা হতে কখনো দেখিনি। শেষ জীবনে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায়ও আজান দিলেই নামাজে বসে পড়তেন। দাঁড়িয়ে পড়তে পারতেন না। একদিন আব্বাকে বললাম, আরেকটু পরে পড়না। আব্বা বললেন, ‘নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নাই’।

কত বলব এই মানুষটির কথা! বলে শেষ হয় না। তাঁর প্রতিটি পরতে পরতেই শিক্ষা। রেডিও তেহরানে কাজ করছি। আব্বা কে লিখলাম, ‘আব্বা এখানে কষ্ট হয়। ঘরে কাজের মানুষ নেই। যেদিন গাড়ি মিস করি সেদিন চার তলার সমান পাহাড় বেয়ে অফিসে ঢুকতে হয়। উত্তরে আব্বা আর দশজন মা বাবার মতো বললেন না যে, মা তোমার কাজ করার দরকার নেই। উল্টো লিখলেন, ‘পৃথিবীতে যে জাতি যত পরিশ্রমী, সে জাতি তত উন্নত’।

বস্তুত মা-বাবার কথা বলে কোন সন্তানই শেষ করতে পারে না। তার উপর তিনি বা তাঁরা যদি হন শিক্ষক, তাহলে তো কথাই নেই। আমার দৃষ্টিতে শিক্ষক পিতা-মাতার সন্তানরা নিজেদের মা-বাবার ব্যাপারে একটু অহংকারী হন। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। ইরানে থাকাকালীন একটি সিনেমা চলছিল, ‘বেহতারিন ফেদারই দুনিয়া আস্ত’। অর্থাৎ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পিতা। সিনেমাটি দেখার প্রচন্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে দেখা হয়নি। তবে আফসোস নেই। আমার জীবনে আমার বাবা যেমন বেহতারিন ফেদারই দুনিয়া আস্ত। তেমনি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকও। তিনি আমাদের বইয়ের পাঠ যেমন শিখিয়েছেন জীবনের পাঠও তেমনি দান করেছেন। হে  আল্লাহ, তুমি তাঁকে তোমার রহমতের ছায়ায় স্থান দিও। আমিন।

বেগম ফয়জুন নাহার শেলী, সাবেক বাংলা প্রভাষক, বরিশাল ইসলামিয়া কলেজ। সাবেক অনুবাদক ও ঘোষক, রেডিও তেহরান।

Next Barisal banner ads

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *