সৈয়দ মাহবুব ।।
ব্যক্তি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে শিল্পের একটা অন্তগূঢ় মিল রয়েছে। এই সত্য প্রথম ধরা দেয় কবি এলিয়টের কবি স্বভাবে। এমনকি নাগরিক অনুভবে শিক্ষিত কবিদের প্রগাঢ় লোক চৈতন্যে। এভাবে অর্ন্তলীন লোকচেতনায় প্রভাবিত কবিকুল শিল্প বিনির্মাণের একাগ্রতায় বিশ্ব সংস্কৃতির সঙ্গে সেতু রচনা করেন। কবিতা যখন শিল্প হিসাবে সমাদৃত হয় তখন ঐতিহ্যের স্বর্ণখন্ড তাতে উজ্জল দীপ্তি ছড়ায়। আবার যখন তা নিজস্ব সম্পদ হতে পাবে না তখন কবির স্বরে লোকায়তজীবন, সুর, স্মৃতি ও ছবি সংস্কৃতির অর্কেষ্ট্রায় পরিণত হয়। কবিতার বহস্বরিকতা এলিয়টের মতো কবি যত দ্রুত বুঝতে পারেন পাঠক সমাজ সেই অনূভুতিতে পৌঁছুতে অনেক সময় নিয়ে থাকেন। শিল্পের লোকোজ লোকায়ত অবতল স্পর্শ করতে কবিতার পাঠককে নতুন বিনির্মাণের ফাঁকফোকর পাড়ি দিতে হয় নিবিষ্টভাবে।
কারণ এখানে থাকে নতুন স্টাইল যা সমালোচক ক্রিস্টাল ও ডেভি উভয়ের ভায়ায় ধরা পড়েছে। তাদের ধারণা Style does not clarify matters greatly, because of the multiplicity definitions that the word style has. পাশ্চাত্যের পন্ডিত স্তাধালের সঙ্গে এ ভাবনার মিল রয়েছে নানাভাবে।
তাদের কাছে স্টাইল মানে effective presentation যা কিনা বাংলা কবিতার এক তরুণ কবি আল হাফিজের কবিতার অধিবাচনে ধরা দিয়েছে। ‘যে শহরে হাঁস-গরু-মৎস্য আর বৃক্ষেরা মরে শুধু অসহায়/মানুষের মতো, তুমি তাকে বলো না শহর। যে শহরে মশা-মাছি-তরুলতা লজ্জায় ডরে কাঁপে বেদনার ভারে/ সে শহরে আমি নেই, তুমি তাকে বলো না শহর-’ কথাগুলো কবির অর্জিত অভিজ্ঞতার ফসল। এক্ষেত্রে কবির কবিতা ভাষা পরিসরের ব্যপন ক্রিয়ায় (diffusion) প্রবাহমান। তার ভাষাকে বলতে হবে শিস্ট ভাষার উপরিতলের এক সম্প্রসারিত রূপে যা কিনা এক ধরনের pressure উচ্চারণে from down to change হিসাবে আদৃত।
কবি আল হাফিজের ‘যে শহরে আমি নেই’ কবিতার স্পষ্ট ‘বলো তুমি সে শহরে আল্লার গোলামেরা/বলদের মতো ক্যানো বাঁচে।’ অধুনাক্তিক শহরে এমন চিত্র বিরাজমান। এই কবিতায় লোকোপাদান প্রয়োগ দক্ষতায় স্বতন্ত্র সৃজনের নবআভরনে স্পর্শকৃত। Link between extent and linguistic for –এর মধ্যে শহর কেন্দ্রিক দ্বন্দ্বময়তায় নাগরিক বেচাবিক্রির উৎস খুঁজে ফেরাই মুখ্য। কর্মচঞ্চল বাণিজ্য শহরের বাস্তব ছবি আঁকতে গিয়ে পার্থক্য নির্দেশিত বন্ধুর সামাজিক চালচিত্রের বিচূর্ণ উপাদানের সংমিশ্রন ঘটেছে আল হাফিজের কবিতায়। এক্ষেত্রে পাশ্চাত্য ভাবনার নকল নবিশী অনুপস্থিত। একই সঙ্গে বর্জিত হয়েছে পরিভাষার ব্যবহার। তবু বলতে হবে আধুনিক কবিতার তিনটি ধারা যথা আঙ্গিক, বিষয় ও সঠিক বা অভিপ্রায় এখানে বিরাজমান। অমন্বয়ী ও অন্বয়ী ধারার বাক্যন্বয়ী, অবধারক ও পদপূরকের স্পষ্ট ছাপ আছে। Contextual alien কবিতার উপাদান হয়ে কাব্য জগতে নতুনের সন্ধান দান করে বলে এই কবিতার তুলনামূলকভাবে … ভাষার কবিতা তুলনামূলকভাবে সম্প্রসারিত। তবে তা কোনো পর্যায়ে শব্দগতভাবে সংকীর্ণ নয়। ‘প্রতীক্ষার আহাজারি’, ‘ওকালতি ভাষার মতো জিলেপির প্যাচ’, ‘দরজার চৌকাঠে নুনের আঁচড়’, ‘আঁধারের জীবাণুরা’ ‘ভোরবেলা নিরামিষ মানুষেরা’ এই সব লৌকিক ভাষা কাব্যকায়ার সঙ্গে সমীভূত এবং কাব্যেরই সম্পূর্ণতার অন্তরঙ্গ দ্যোতক। মানুষ একই শহরে একই বাড়িতে মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু কাটিয়ে দিতে পারে না। আত্মতার অকারণকে কারণে রূপান্তরিত করার ভাষা কেবল ভিন্ন স্বাদের জীবন দিতে পারে। কবি আল হাফিজের কবিতায় সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত।
আল হাফিজের কবিতায় লিঙ্ক তৈরি করেছে বস্তুবিশ্ব ও ভাববিশ্বের সম্পর্কে যা কিনা বাখতিনের Situatedness এবং ফাঙ্ক বি ফ্যারেলের Context of significance –এর নিরীক্ষা ধর্মিতায় বিচার্য। তাই কবিতাকে এগোতে হয় অম্বয়ের নিরঙ্কুশ তাড়নায় অস্থির বৃত্তায়নের কথকতায়। জেনেভিয়েভ লয়েড ‘রিং ইনটাইম’ বইতে বলেছেন : There is not a stable self perceiving a chanle world, but a self which is ltself shifting and unslable, কূটাভাসপূর্ণ গ্রন্থিল সময়ে যে সত্তা সামাজিক পরিসর থেকে বিচ্যুত এবং নিজস্ব তাৎপর্য সন্ধানী প্রক্রিয়া থেকে নির্বাসিত তার অনেকান্তিক রহস্য উন্মুক্ত থেকে যায়। কেয়ারী করা বৈষম্যের অন্ধকারে বিস্মৃতির ধূপ ছায়ায়। এভাবে মূল্যায়ণের দিক থেকে কবি আল হাফিজের কবিতাটি নতুন আখ্যানের নিরলম্ব শূন্যতায় পূর্ণতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘যে শহরে রাতের লালার মতো ইহুদিরা খোলামেলা ম্যাকসির মায়া পরে ঘোরাফেরা করে।’ এই অর্ন্তবয়ান ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠা প্রতিজগতের প্রতিচ্ছবির সঙ্গে তুলনীয়। স্বাধীনতা বঞ্চিত ফিলিস্তিনিয়দের ঘরে ফেরায় বাধা দানকারী ইহুদিরা মানবিক আহাজারি শুনতে পায় না বলে কুশলীও বিলাসিতা হয়ে ওঠে। চিন্তাহীন অভ্যাসে ও ভোগবাদের আবর্তে আত্মহারা, অবক্ষয়ী আধুনিকতায় পুঁজির দাপটে বিভোর আর মৃগা যায় উদবাহু হওয়ায় যেন এই সব অত্যাচারী ইহুদিদের কাছে নির্লজ্জভাবে অবধারিত। শহরের নৈরাজ্যে তলিয়ে যায় রাষ্ট্র কাঠামোর নির্জলা নিষ্ঠুরতা। এই অসুখ ভয়ানক যা সারানো খুবই মুসকিল। আধুনিক চিন্তাকে যারা দেশের দোড়গোড়ায় এনেছেন তারা আবার রাজনীতি ও সংঘাতকে উত্তর উপনিবেশের অর্থনৈতিক দুর্গতিকেও দেখেছে। এই দুর্গতি হতাশায় রূপ নিয়েছে আল হাফিজের কবিতায়।
কবি তার কবিতায় অভিনব ইমেজে জাগতিক সচেতনতায় নাগরিক সভ্যতার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন। কবি আসলে বাঁধ ভেঙে দেয়ার প্রবণতায় বিশ্বসী। একই সঙ্গে আক্রমণকারী অভিপ্রায়ের অনুসারীও বটে। অবশ্য কবিতা বই যে রাজনীতিতে আর কিছু নয়। অর্থাৎ পলিটিক্স আজকালকার কাব্য ধারার অন্যতম অবলম্বন। একই সঙ্গে যা কিনা বোঝাপাড়ার দলিল হিসাবে সমাদৃত। নিরন্তর অতৃপ্তি কবি আল হাফিজকে পীড়িত করে। যা কিছু হাতের মুঠোয় অধিকারলব্ধ তাকে ছুড়ে ফেলে নতুনের সন্ধানে মেতে উঠতে চান তিনি। ফলে তার কবিতা সৃজন বৈশিষ্ট ব্যতিক্রমী হয়ে উঠার কামনা কাতর। জাগ্রত মননের সাথে ক্রোধ মিশিয়ে যে উচ্চারণ তিনি করেছেন হয়তো একদিন এসবের পরিণতি মিলবে সৃষ্ট বর্ণমালার ধ্বনি ব্যঞ্জনায়। ‘যে শহরে ঘুমোতে যাবার আগে মানুষেরা/আখেরি সালাম দিয়ে বিছানায় চড়ে সে শহরে/আমি নেই, তুমি তাকে বোলো না শহর’।
কবিতাটি এভাবে সুরম্য বিনির্মাণ গড়ে তুলছে। তাই কবির কবিতা জাগ্রত প্রহরীর মতো তাড়িয়ে নেয় পাঠক হৃদয়। পাঠকের কবিতা এবং কবিতা থেকে কবিতায় কবি আল হাফিজ বিচারিত নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে প্রস্থান বিন্দুর অনুপস্থিতি গৌনভাবে ধরা পড়লেও কবিতাটি সুখপাঠ্য।