মুহাম্মাদ আবদুল মাননান
আজকের প্রবন্ধের শিরোনাম ‘একজন মুমিনের সালাত, সাওম এবং তাকওয়ার গুরুত্ব’ দেয়ার উদ্দেশ্য হলো- একজন মুমিন, আসমান জমিনের একচ্ছত্র অধিপতি মহান রবের প্রতি ইমান তথা বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে ইসলামে প্রবেশ করে। সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় রবের প্রতি আনুগত্য বা আত্মসমর্পণের প্রথম সোপান সালাত আদায় করা। সালাত আদায়ের মাধ্যমে একজন মুমিন আল্লাহ তায়ালার সাথে অনেক পরিপালনীয় চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং অগ্রসর হয় উন্নতর আমলের দিকে। আর সাওম বা রোযা হলো আত্ময়িন্ত্রণ বা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের এক অন্যতম প্রধান উপায়। তা হলে আমরা মনে করতে পারি, ‘একজন মুমিনের সালাত, সাওম এবং তাকওয়া তাঁর প্রতিপালকের নৈকট্য লাভ তথা রেজামন্দি হাসিলের এক অসাধারণ ধাপ বা সিড়িঁ।
এবারে আসি ‘মুমিন’ কে ?
‘মুমিন’ আরবি শব্দ। যা মূলত আরবি ‘ইমান’ শব্দটি থেকে এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ “বিশ্বাসী” অর্থাৎ যিনি আল্লাহর একত্বে ইমান বা বিশ্বাস এনেছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর একত্ব, গুণাবলি, বিধান এবং তার পুরস্কার ও শাস্তি সম্পর্কে জানে এবং অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে তাকে বলা হয় মুমিন ।
আল কুরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন ‘প্রকৃত মুমিনতো তারাই যারা আল্লাহ ও রসুলের প্রতি ইমান আনয়ন করে,অতঃপর (ইমান আনার পর) সামান্যতম সন্দেহও তারা পোষন করে না এবং জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে: এরাই হচ্ছে সত্যনিষ্ঠ’। (সুরা হুজরাত : আয়াত ১৫) অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘মুমিন তো তারাই যাদের সম্মুখে আল্লাহর স্মরণ করা হলে তাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে আর যখন তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তাদের ইমান বৃদ্ধি পায় আর তারা তাদের রবের উপর ভরসা করে। যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। তারাই হল প্রকৃত মুমিন, তাদের রবের নিকট তাদের জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদাসমূহ, ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা। (সুরা আনফাল, আযাত: ২-৪) এক কথায় মুমিন হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার সমস্ত কর্মকা- একনিষ্ঠতার সাথে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ও তার রসুল (স.) এর আনুগত্যের উপর পরিচালনা করে থাকে।
মুমিনের সালাত প্রসঙ্গ:
সালাত আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হলো- কারো দিকে মুখ করা, অগ্রসর হওয়া, দুআ করা, নিকটবর্তি হওয়া, পবিত্রতা বর্ণনা করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় সালাতের পরিবর্তে সচরাচর ‘নামায’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, তুুর্কি ও বাংলা ভাষায় একে নামায (نماز) বলা হয়। পারিভাষিক অর্থ: শরিয়াত নির্দেশিত ক্রিয়া-পদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে বান্দার ক্ষমা প্রার্থনা নিবেদনের শ্রেষ্ঠতম ইবাদতকে সালাত বলা হয়, যা তাকবিরে তাহরিমা দ্বারা শুরু হয় ও সালাম দ্বারা শেষ হয়।
সালাতের গুরুত্ব ও শিক্ষা:
দৈহিক ইবাদতের মাঝে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও মহান ইবাদত হল সালাত যা নিয়মিত দৈনিক পাঁচ বার আদায় করতে হয়। সালাতের মাধ্যমে একজন মুমিন তার রবের সাথে প্রতি ওয়াক্তে কথোপকথনের মাধ্যমে তার প্রশংসা, বড়ত্ব, মহিমা, স্তুতি প্রকাশ করে থাকে এবং সকল ধরনের শিরক, কুফরি, বেদয়াত ও আল্লাহর নাফরমানি থেকে নিজকে মুক্ত রাখতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। রুকু এবং সিজদাহর মাধ্যমে বান্দাহ তার রবের নিকট এমন ভাবে নিজকে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আপদমস্তক উজার করে দেয় যেন বান্দাহ তার রবের সর্বাধিক নিকটে চলে যায় এবং বিগলিত চিত্তে বান্দাহকে প্রতিপালকের দাসত্বের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দেয়। সালাতের মাধ্যমেই এ ভাবেই মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হয়। ইহকাল ও পরকালের মুক্তির পথ কণ্টকমুক্ত হয়। প্রতিনিয়ত একজন মুমিন এভাবে একাগ্রতার সাথে খুশুখুজুসহ জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করে এবং সে মনে করতে থাকে প্রতিটি মুহূর্ত আমি যা কিছু করছি সার্বক্ষনিক আমার রব তা দেখেছেন এবং আমার সব কিছুই তিনি অবহিত আছেন। আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবি করিম (স.)কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- ‘তুমি এভাবে নামায আদায় করবে যেন তুমি স্বয়ং আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ, আর যদি তোমার পক্ষে তা সম্ভব না হয়, তবে তুমি অবশ্যই মনে করে নিবে যে, আল্লাহ তোমাকে সার্বক্ষণ দেখছেন’। (মুসলিম)। এই চেতনাবোধ থেকে একজন মুমিন হয়ে ওঠতে পারে সমাজের একজন পরিপূর্ণ আদর্শবান ও অনুকরণীয় মানুষ। আর এ রকম মানুষ এর মাধ্যমেই পরিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব ও মমতাবোধ ফিরে আসে এবং গড়ে উঠে সামাজিক ঐক্য। আল্লাহ রব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ঘোষনা করেন ‘এবং তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে (আল্লাহর কাছে) সাহায্য প্রার্থনা কর। (নিষ্ঠার সাথে) নামায প্রতিষ্ঠা করা (অবশ্যই) কঠিন কিন্তু যারা (আল্লাহকে) ভয় করে তাদের কথা আলাদা, যারা জানে একদিন তাদের সবাইকে তাদের মালিকের সামনাসামনি হতে হবে।’ (সুরা বাকারাহ : ৪৫,৪৬) একজন কাংখিত মানের সালাত আদায়কারীর পক্ষে কোনো অন্যায় ও পাপাচার কাজ করা সম্ভব নয়। আল কুরআনের ঘোষণা ‘এবং সালাত কায়েম কর। নিশ্চয় সালাত অন্যায় ও অশ্লীল কাজ হতে (মানুষ) কে বিরত রাখে।’ (সুরা আনকাবুত -৪৫) সূরা মুমিনুনে বলা হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে মুমিনগন সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়াবনত হয়’ । (সুরা মুমিনুন- ১ ও ২ )
সালাত একমাত্র এবাদত যা আল্লাহ তাআলা সাত আসমানের উপরেই ফরজ করাকে শ্রেয় মনে করেছেন। তাই রসুল (স:) যখন মেরাজে গমন করেন তখন আল্লাহ তাআলা সরাসরি-কোনোপ্রকার মাধ্যম ছাড়াই রসুল (স:) -কে সালাতের দায়িত্ব দেন। আল্লাহ তাআলা প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেন। তারপর আল্লাহ মানুষের প্রতি দয়া করে তা কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্তে নিয়ে আসেন। সুতরাং যে ব্যক্তি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে আল্লাহ তাকে ৫০ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সওয়াব প্রদান করবেন। সালাত এমন এক এবাদত মৃত্যু ছাড়া আর কোনো অবস্থাতেই সালাত মাফ হয় না এমনকি মৃত্যুশয্যাতেও সালাত হতে বিরত থাকার কোনো বিধান নেই। বিশ্বনবি (স.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি নামায আদায় করে না, ইসলামে তার কোনো অংশ নেই। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত নামায ত্যাগ করে, সে জাহান্নামি।’ রসল (স:) আরও বলেন: মুমিন বান্দা ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত।’ (সহিহ মুসলিম) প্রখ্যাত তাবেয়ি শাকিক ইবনে আব্দুল্লাহ আল উকাইলি (রহ.) বলেন, ‘সাহাবায়ে কিরাম (রা) নামায ব্যতীত অন্য কোনো আমল ছেড়ে দেয়াকে কুফরি মনে করতেন না।’ (জামে আত-তিরমিযি) আমরা যদি একটু বিশ্লেষনের দৃষ্টিতে দেখি তা হলে দেখব সালাত সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক শারীরিক ও নৈতিক দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে ।
সালাতের সামাজিক গুরুত্ব:
সমাজবদ্ধভাবে জীবন পরিচালনা করার কারনে প্রতিদিন মানুষ ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভাবে একে অপরের সাথে পারস্পারিক মুয়ামালাত বা জীবন পরিচালনা করে থাকলেও দিনে পাঁচ বার মুমিনের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া অপরিহার্য হওয়ায় শারিরীক অসুস্থতা ,ভয়ভীতি, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া অথবা দূরে কোথাও যাওয়া ছাড়া মসজিদ তথা জামায়াতে উপস্থিত না হওয়ার কোন সুযোগ না থাকায় একজন সালাত আদায়কারীর সাথে অপরের সাথে মসজিদে দেখা হবে এটা খুবই বাস্তবতা । অপরদিকে একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধনী-গরিব উঁচু-নিচু সাদা-কালো কোনো ভেদাভেদ না করে একই সাঁড়িতে সালাত আদায়ের মাধ্যমে পরস্পরের কুশলাদি জিজ্ঞেস করা ,ব্যক্তিগত পারিবারিক সমস্যাদি জানার মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি যেমনি মহব্বত সৃষ্টি সামাজিক বন্ধন তৈরি হয় তেমনি দূর হয় সামাজিক বৈষম্য হিংসা বিদ্বেষ প্রতারণা হঠকারিতা মাপে কম ও ভেজাল দেওয়া কাউকে ঠকানো মিথ্যা মামলা ও সাক্ষী দেয়া পরনিন্দা গিবত কারও দোষ খোঁজা ইত্যাদি। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ঘোষণা দেন ‘মুমিনরা তো (একে অপরের) ভাই, অতএব তোমাদের ভাইদের মাঝে (বিরোধ দেখা দিলে) মীমাংসা করে দাও আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর, আশা করা যায় তোমাদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করা হবে।’ (সুরা আল হুজরাত ১০) হাদিসে আসছে ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। এক ভাই যেন অন্য ভাইয়ের ওপর জুলুম না করে, অপমান না করে, তুচ্ছ মনে না করে।’ (মুসলিম, আহমদ)
সালাতের রাজনৈতিক গুরুত্ব:
মসজিদে আমরা এক ইমামের আনুগত্য করি। রসুল (স.) এর নির্দেশিত বা দেখানো পদ্ধতিতে ইমাম সাহেব হুবহু সালাত আদায় করে বিধায় আমরা ইমাম কে অনুসরণ করে থাকি এবং সার্বক্ষনিক সচেতন থাকি ইমাম সাহেব নামাজের কোন বিধান লঙ্ঘন করেন কিনা, করলে সাথে সাথে লোকমা দিয়ে সতর্ক করে দেই, মনে মনে বলি ইমাম সাহেব এতক্ষন আপনি রাসুলের শিখানো পদ্ধতির মধ্যে ছিলেন তাই আপনাকে অনুসরণ করেছি, সাবধান হয়ে যান । সালাত শেষ করার পর যে সমাজে আমরা বিচারণ করি সেই সমাজের ইমাম বা নেতা আল্লাহর বিধনের উপর প্রতিষ্ঠিত কিনা , তিনি আদেশ নিষেধ বিচার ফয়সালা যাবতীয় কার্যক্রম আল্লাহর বিধান এবং রসুল (স.) প্রদর্শিত পথে করেন কিনা সে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব এবং তাকওয়ার সাথে আমাদেরকে বিশ্লেষণ করতে হবে। আল্লাহ আল কুরআনে ঘোষণা করেন ‘যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারা কাফের।’ (সুরা মায়িদা-৪৪) এমতাবস্থায় মসজিদে নামাযরত অবস্থার ইমামতের আনুগত্য ও মসজিদ থেকে বের হয়ে সমাজপতিদের আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থায়ই আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলের বিধান পরিত্যাগ বা লঙ্ঘন করার সুযোগ একজন মুমিনের নেই। আর এটাই নামাযের রাজনৈতিক শিক্ষা।
সালাতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
আমরা জানি আমাদের জীবন পরিচালনার সাথে আমাদের আয় বা জীবিকা সরাসরি জড়িত এবং আরও অবহিত আছি ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হলো হালাল রিযিক ভক্ষণ করা। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন ‘হে রসুলগন! তোমরা পবিত্র ও ভালোবস্তু থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। তোমরা যা কিছু কর সে বিষয়ে আমি সম্যক অবহিত আছি। (সুরা আল মুমিনুন: ৫১) রসুল স. বলেছেন, ‘হে সাদ! পবিত্র খাবার গ্রহণ করো, তবে তোমার দোয়া কবুল হবে। সেই সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ। বান্দা যখন তার মুখে হারাম উপায়ে কোনো খাবার গ্রহণ করে, আল্লাহ ৪০ দিন তার কোনো আমল কবুল করেন না। আর যে ব্যক্তি বেড়ে ওঠে অবৈধ সম্পদ আর হারাম উপার্জিত অর্থে, তার জন্য জাহান্নামের আগুনই উত্তম। সুতরাং আমরা বুঝতেই পারছি যে সালাত এত গুরুত্ব বহন করে সে সালাত কবুল হওয়ার জন্য অর্থনৈতিক মাধ্যম হালাল জীবিকার গুরুত্ব কতটা তাৎপর্যপূর্ণ।
সালাতের শারীরিক গুরুত্ব:
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় এর মাধ্যমে আমরা যে শুধু আল্লাহর ফরয হুকুম পালন করে থাকি বিষয়টি কিন্তু তা নয় নামায পড়ার মাধ্যমে আমাদের শরীরের বেশকিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাড়াচড়া হয় যা অত্যন্ত উত্তম একটি ব্যায়াম হিসেবে কাজ করে। এই ব্যায়াম স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী যা আমাদের শরীর ও মনকে প্রফুল্ল রাখতে সাহায্য করে। নামাযে রুকু সিজদা বসা আর উঠে দাঁড়ানোর সময় আমাদের মেরুদ-ে বিভিন্ন রকমের নাড়াচড়া হয়, যা মেরুদ-ের বিভিন্ন রোগ থেকে আমরা বেঁচে থাকি। নামাযে যখন সিজদা করা হয় তখন আমাদের মস্তিস্কে রক্ত দ্রুত প্রবাহিত হয়। ফলে আমাদের স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে থাকে। নামায আদায়কারী মানুষের দৃষ্টিশক্তি বজায় থাকে। সঠিক নিয়মে রুকুতে গিয়ে নামায পড়লে কোমর ও শিরদাড়ার ব্যথা দূর হয়ে যায়। এভাবে শারীরিক দিক থেকে নামাযে আমরা অনেক উপকৃত হয়ে থাকি।
সালাতের নৈতিক শিক্ষা:
সালাত হলো ইমানের ভিত্তি। আর ইমান হলো চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান । ফলে একজন সালাত আদায়কারীর চারিত্রিক দৃঢ়তা উন্নত ও অসাধারণ। একজন সালাত আদায়কারী মুমিন সারাক্ষন বিনয়ী নম্র ও নিরহংকার হয়ে থাকে। সে কখনো প্রবৃত্তির দাস হয় না এবং কোনো হতাশায় তাকে গ্রাস করে না। একজন মুমিনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাত তার মন ও চরিত্র সংশোধনের এক অন্যতম হাতিয়ার। সালাত আদায়ের পূর্বে একজন মুমিনকে সুন্দর ভাবে পবিত্রতা অর্জন করে নিতে হয় এবং মহান রবের একান্ত সান্নিধ্যে চলে যাওয়ার অভিপ্রায় বান্দাহ ব্যাকুল ও বিনয়াবনত হওয়ার কারনে নিজেকে সার্বক্ষনিক শৃঙ্খলাবদ্ধার মধ্যে নিমজ্জিত রাখেন। সে হয়ে ওঠেন সচেতন ও পবিত্রতম একজন মানুষ। সামাজিক সকল ধরনের অবক্ষয় নোংড়ামী অন্যায় ও অপসংস্কৃতি থেকে সে হয়ে ওঠে আলাদা একজন ব্যক্তিত্ব।
সাওম বা সিয়াম কি ?
সাওম আরবি শব্দ। বহু বচনে সিয়াম। এর আভিধানিক অর্থ- কোনো কিছু থেকে বিরত থাকা, বিরত করা, বিরত রাখা, সংযম, নিয়ন্ত্রণ, দূরে থাকা, সংযত হওয়া, কোনো কিছুকে পরিত্যাগ করা, বারণ করা বা ফিরিয়ে রাখা, অবিরাম চেষ্টা- সাধনা ইত্যাদি। ফারসি শব্দ রোযাকেই মূলত সাওম বা সিয়াম বলা হয়। রোযা মানুষকে পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত রাখে, নফসকে বারণ করে এবং শয়তানকে বান্দার কাছ থেকে ফিরিয়ে রাখে বলেই এর নাম হচ্ছে সাওম। তাই হাদিসে সাওমকে ‘ঢাল স্বরুপ’ বলা হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে শত্রু আক্রমণ থেকে ঢাল যেভাবে মানুষকে রক্ষা করে, রোযাও তেমনি কুপ্রবৃত্তি, সমস্ত অন্যায় কাজ, নফসের তাড়না, ষড়রিপু ও শয়তানের ধোঁকা থেকে রোযাদারকে রক্ষা করে।
রমজান আরবি বারো মাসের মধ্যে নবমতম মাস। আরবি ‘রময’ শব্দ থেকে রমযান শব্দটি এসেছে। রময ধাতুর দুটি অর্থ আরবি অভিধান ও আরবি সাহিত্যে পাওয়া যায়। এক অর্থ (আরবদেশের) বছরের প্রথম বৃষ্টি। আরবদেশে বছরে যে প্রথম বৃষ্টি হতো তাকে রময বলা হতো। আল্লাহর হুকুমে আকাশের মেঘমালা বছরের প্রথমে যে বারিধারা বর্ষণ করে থাকে, তাকে মৃত জমিন যেমন সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে, এতে পৃথিবী যেন নবশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি রমযানের রোযা ও মৃতপ্রায় মানুষের আত্মা নবশক্তিতে বলীয়ান করে তোলে। রময শব্দের আর একটি অর্থ হলো- দহন করা, জ্বালানো বা পোড়ানো, পুড়িয়ে ফেলা, জ্বালিয়ে দেয়া, দগ্ধীভূত করা, ধ্বংস করা, বিনাশ সাধন ইত্যাদি। রমযানের রোযা গুনাহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। সিয়াম সাধনায় গুনাহ মাফ হয়। রমযানের সিয়াম সাধনা রোযাদারকে সবরের অগ্নিদহনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পূত-শুদ্ধ মানুষরূপে গড়ে তুলতে প্রয়াস পায়। রমযানের রোযা নফসের খায়েশাতকে জ্বালিয়ে দিয়ে মানুষকে আল্লাহর খাটি বান্দাহতে পরিণত করে যেমনি সোনা আগুনে পুড়িয়ে খাটি সোনায় রূপান্তরিত করে। এই খাঁটি মানুষ জীবনের প্রতিটি দিক-দিগন্তে তার প্রত্যেকটি চিন্তা ও কর্মে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করবে। ইসলামি শরিয়াতের পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে প্রভাতের আলোর সাদা রেখা প্রকাশের সময় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, কামাচার, ইন্দ্রিয়তৃপ্তি এবং আল্লাহর মর্জির বিপরীত কথা ও অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্চিত ও অশালীন কার্যকলাপ হতে বিরত থাকার কঠোর কৃচ্ছ সাধনার নাম হচ্ছে রমযান। পবিত্র রমযান মাসে পূর্ণ এক মাস সিয়াম পালন করা সুস্থ বিবেকসম্পন্ন প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর ওপর ফরয।
মাহে রমযানের শ্রেষ্ঠ উপহার মহাগ্রন্থ আল কুরআন:
আমরা জানি পৃথিবীর সব দেশের মানুষই বারো মাসে বছর হিসাব করে। কিন্তু এই বারো মাসের মধ্যে একটি মাসের গুরুত্ব এতো বেশি কেন সে বিষয় আমরা অনেকেই হয়তো ওয়াকিফহাল নয়। আমাদেরকে অত্যন্ত আবেগ ও ঐকান্তিকতা দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করা দরকার, এই মাসের সম্মান মর্যাদা গুরুত্ব ফযিলত বরকত নাজাত মাগফিরাত একমাত্র কুরআন-এর সম্মানের কারণে হয়েছে। মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিশা দেয়ার জন্য আল্লাহ রব্বুলর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন, যা এই রমযান মাসেই অবতীর্ণ করা হয়। আল্লাহ আল কুরআনে ঘোষণা দেন, ‘রমযান মাস- যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে মানুষের জন্য পথনির্দেশনাস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলিসহ যা সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী।’ (আল-বাকারা : ১৮৫) এ মাস হলো কুরআনের মাস। রসুলে কারিম (স.) এ মাসকে শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ মাসকে সকল মাস অপেক্ষা উৎকৃষ্টতম বলেছেন। যদি এই মাসে কুরআন নাযিল না হতো তাহলে এই রমযান মাসের এত ফযীলত হতো না। পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব আল্লাহর প্রিয় হাবিব মুহাম্মাদ (স.) এর উপরে দীর্ঘ ২৩ বছরব্যাপী স্থান কাল ও পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ে, প্রয়োজন মোতাবেক অল্প অল্প করে আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছিলেন, কোনোরূপ সন্দেহ সংশয় ব্যতিরেকেই। আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিজেই ঘোষণা দেন: ইহা সেই কিতাব যার মধ্যে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই। (সুরা বাকারা: আয়াত ২)
সাওম পালনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত ও মর্যাদা :
মহান রব্বুল আলামিন তার বান্দাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু এবং মেহেরবান। এ জন্য তার বান্দাদের সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণের বিবেচনায় রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দেয়ার মানসে বান্দাদের জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, যার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে রমযান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। আত্মিক এবং শারীরিক উন্নতি সাধনের এক অনন্য প্রশিক্ষণ হচ্ছে সিয়াম। মানুষের বৈচিত্র্যময় চাহিদা, সীমাহীন পাওয়ার আশা এবং চরম ভোগের সার্বক্ষণিক নেশায় আত্মিক অনুভূতিগুলোকে বিপর্যস্ত করে রাখে এবং অনুভূতিহীন করে দেয় মানবাত্মাকে। ফলে উন্নততর মানবিক গুণগুলো ক্রমান্বয়ে অসার হয়ে পড়ে। মনুষ্যত্ব এবং মানবিকতার এ স্বভাবজাত অধঃপতন ও অবক্ষয় থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যেই রমযান মাসের সিয়াম সাধনাকে অপরিহার্য করা হয়েছে। এ মাস ক্ষমা লাভের মাস। এ মাস পাওয়ার পরও যারা তাদের আমলনামাকে পাপ-পঙ্কিলতা মুক্ত করতে পারলো না রসুল (স.) তাদেরকে ধিক্কার দিয়ে বলেছেন, ‘‘ওই ব্যক্তির নাক ধূলায় ধুসরিত হোক যার কাছে রমযান মাস এসে চলে গেল অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করিয়ে নিতে পারল না।’ (তিরমিযি) রমযান মাসে সৎ কর্মের প্রতিদান বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। এ বিষয়ে রসুলুল্লাহ (স:) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমযান মাসে কোনো একটি নফল ইবাদত করলো, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরয আদায় করলো। আর রমযানে যে ব্যক্তি একটি ফরয আদায় করলো, সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরয আদায় করলো। রমযানে ইবাদতে রাত্রি জাগরণের ফযিলত বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। রসলুল্লাহ (স:) বলেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে নেকির প্রত্যাশায় রমযানের রাত্রি জাগরণ করবে তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।’[বুখারি: ৩৭; মুসলিম: ৭৬০] রমযানের শেষ দশকে রসুলুল্লাহ (স:) বিশেষভাবে ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রসুলুল্লাহ (স:) রমযানের শেষ দশকে বেশি বেশি ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন, যতটা তিনি অন্য দিনগুলোতে করতেন না।’ [মুসলিম : ১১৭৫] এ মাসে মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়। রসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মাহে রমাযানে প্রতিরাত ও দিনের বেলায় বহু মানুষকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে থাকেন এবং প্রতিটি রাত ও দিনের বেলায় প্রত্যেক মুসলিমের দুআ ও মুনাজাত কবুল করা হয়ে থাকে।’ [মুসনাদ আহমদ : ৭৪৫০] রসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘প্রতিটি আদম সন্তানের নেক কাজের ফল দশগুণ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন, তবে রোযাকে এর মধ্যে গণ্য করা হবে না। কারণ, রোযা কেবল আমারই জন্য। আর আমিই এর প্রতিদান দেব। আমার জন্য সে আহার ও যৌন চাহিদা পরিহার করে। রোযাদারের আনন্দ দুটি : একটি আনন্দ তার ইফতারের সময়। আরেকটি আনন্দ আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আনন্দ। রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধির চাইতেও সুগন্ধিময়।’ [মুসলিম : ১১৫১] হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন: ‘পাঁচ ওয়াক্তের সালাত, এক জুমুআ থেকে আরেক জুমুআ এবং এক রমাযান থেকে আরেক রমাযানের মধ্যবর্তী সব গুনাহ্ কে মুছে দেয়, যদি সে কবিরা গুনাহ্ থেকে বেঁচে থাকে।’ [সহিহ মুসলিম: ৪৫৯] নবি করিম স. বলেছেন, ‘যখন পবিত্র রমযান মাস এসে যায় তখন আসমান তথা জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খাবদ্ধ করা হয়।’ [সহিহ বুখারি: ১৮৯৯, মুসলিম: ১০৭৯] হাদিসে এসেছে: ‘জান্নাতের একটি দরজা রয়েছে যার নাম ‘‘রাইয়্যান’’। কেয়ামতের দিন ওই দরজা দিয়ে রোযাদারগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া তাদের সাথে আর কেউই ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। বলা হবে: ‘কোথায় রোযাদারগণ?’ তখন তারা ওই দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ [বুখারি: ১৮৯৬, মুসলিম: ১১৫২]
সাওমের সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা:
মানব জাতির সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যেই মাহে রমযানের আগমন। রমযানে বিশ্বের মুসলমানরা অত্যন্ত আগ্রহ ও নিষ্ঠার সঙ্গে রোজা পালন করে থাকেন। রোযা পালনের মাধ্যমে তারা আল্লাহতায়ালার আদেশ-নিষেধ মোতাবেক জীবন পরিচালনার প্রশিক্ষন নিয়ে থাকেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সমাজে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরে আসে, সমাজ হয় সুন্দর-সুশোভিত। মাহে রমজানে আমাদের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত করে তোলে। সিয়ামের প্রভাবে রোযাদাররা যেমন নিষ্ঠাবান হয়ে উঠেন তেমনি কথা-বার্তায়ও হয়ে উঠেন সত্যপরায়ণ। কেউ কাউকে ঠকানোর চেষ্টা করে না বরং অপরের অধিকার বুঝিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকেন। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতি, হৃদ্যতা প্রভৃতি বেড়ে যায়। এভাবে সমাজব্যবস্থায় হয়ে উঠে সাবলীল-সুখময় একটি পরিবেশ । মাহে রমজানে মুসলিম সমাজ সকল প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, কটুকথা ও অশ্লীলতা-বেহায়াপনা পরিহার করে একটি সুন্দর জীবন পরিচালনায় সচেষ্টবান হন। কেউ কোনো রোযাদারকে গালি দিলেও সে হাদিসের বাণী অনুসারে বলে দেয়, ‘আমি রোজাদার।’ রমযানের রোযার প্রভাবে মুসলিম সমাজে সকল প্রকার লোভ-লালসা হ্রাস পায়। ফলে যাবতীয় হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একে অপরকে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। সকলেই ওয়াদা-আমানত রক্ষা করে চলতে থাকেন। এছাড়া রোজার প্রভাবে যেহেতু কু-প্রব্রত্তিসমূহ অবদমিত হয়, সেহেতু সমাজের মানুষের মধ্যে কোনো প্রকার শঙ্কা থাকে না, নিরাপত্তার কোনোরূপ অভাব বোধ হয় না। গোটা সমাজেই এরূপ অবস্থার প্রতিফলন ঘটে। রমযান মাসে মুসলিমরা তাদের অধীনস্তদের প্রতি অন্য সময়ের তুলনায় বেশি সদয় হন। অনেকেই তাদের খাটুনিকে কমিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। প্রিয়নবি (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসে অধীনস্তদের বোঝা হালকা করে দিবে তাকে আল্লাহ মাফ করে দেবেন ও জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন। মাহে রমযানে আমাদের সমাজে এক অভূতপূর্ব ঐক্য, সাম্য-মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ বিরাজ করে থাকে। ধনীব্যক্তিরা রোযা রাখার ফলে দরিদ্রের কষ্ট কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারেন। ফলে তারা হতদরিদ্র মানুষদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। এছাড়া একত্রে তারাবি নামায আদায় করা কিংবা একত্রে ইফতারির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি সামষ্টিক কাজের দরুণ উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ অনেকাংশেই বিলীন হয়ে যায়।
রমযানের সিয়াম সাধনা মুসলমানদের ইমানকে শানিত করে এবং তার মধ্যে এক অনন্য নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত করে। মহান আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশ্রিত ভয় রোযাদারকে পৌছে দেয় উন্নত মানবিক সত্ত্বায়। যা একজন ইমানদারকে পরিপুর্ণ মুসলমান হওয়ার প্রস্তুুতির দিকে অনেক ধাপ অগ্রসর করে দেয়। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে যেসব বিধান মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে সেগুলোর মধ্য দিয়ে ব্যক্তিকে আল্লাহর ঘনিষ্ঠ করে তোলা, সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ এবং তার নির্দেশিত পথে চলায় অভ্যস্ত করা এবং মুসলমানিত্বকে পরিপূর্ণ করে তোলার অনন্য মাধ্যম হলো সাওম। কারণ সিয়াম সাধনার পুরো বিষয়টি ব্যক্তির সততা, আন্তরিকতা নিষ্ঠার সাথে জড়িত। কেউ বাহ্যিকভাবে প্রকাশ্যে পানাহার ও কাম-সম্ভোগ থেকে বিরত থাকলেও গোপনে তার পক্ষে সবই করা সম্ভব। কিন্তু কোনো রোযাদার সত্যিকার অর্থেই রোযা রাখেন এই বিশ্বাস থেকে যে, কেউ না দেখলেও আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখছেন। একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ পালন, তার সন্তুষ্টি অর্জন, তার সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যেই তিনি রোযা পালন করছেন। এই যে অগাধ বিশ্বাস, চেতনা রোযাদারের মধ্যে মাসব্যাপী জাগ্রত থাকে সেটিই রোযাদারকে পরিশীলিত করে এক উন্নত আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছে দেয়। আল্লাহ তায়ালা হাদিসে কুদসিতে এজন্যই বলেছেন, ‘রোযা আমার জন্যই আর এর প্রতিদান আমি নিজেই দেব। আর একমাসব্যাপী সিয়াম পালনের মাধ্যমে একজন মুমিন ইমানিয়াত পরহেযগারী ও নৈতিকতার যে প্রশিক্ষন গ্রহন করে থাকে তার মাধ্যমে বাকি এগারোটি মাস পরিচালনা করার একটি পরিপূর্ণ ও উপযুক্ত দীক্ষা গ্রহণ করে থাকে।
তাকওয়া কি ?
তাকওয়া আরবি শব্দ । ওয়াকিউন শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ -ভয়ে সরে থাকা, বেঁচে থাকা । আর তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ভয় করা, বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, রক্ষা করা, পরহেজগারী, আত্বশুদ্ধি, নিজকে কোনো বিপদ ও অকল্যাণ থেকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা বা কোনো অনিষ্ট হতে দূরে রাখা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে ‘সকল প্রকার অন্যায় ও অনাচার বর্জন করে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ মতো জীবনযাপনের মাধ্যমে আল্লাহকে প্রতিনিয়ত ভয় করে চলাকে তাকওয়া বলে।’ সতর্কতা ও সচেতনতার সাথে মহান প্রভুর নিকট জবাবদিহিতার প্রত্যয় নিয়ে আল্লাহকে ভয়ের বুনিয়াদে নিষ্ঠা ও একাগ্রচিত্তে জীবনের ক্রিয়াকর্ম আল্লাহর মর্জি মোতাবেক সম্পাদন করা ও আল্লাহর মর্জির বিপরীত কথা ও কর্মকে বর্জন করা বা পরিত্যাগ করার নামই তাকওয়া। আর যিনি এই অতীব মহৎ গুণের অধিকারী তিনিই মুত্তাকী বলে অভিহিত। তাকওয়া বাহ্যিক কোনো ধ্যান-ধারণা, বেশ-বুশা এবং বিশেষ কোনো সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়। তাকওয়া মূলত মানব মনের সেই অবস্থাকেই বলা হয় যা আল্লাহর গভীর ভীতি ও প্রবল দায়িত্বানুভূতির দরুণ সৃষ্টি হয় এবং জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তা স্বতস্ফূর্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে। একদা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) উবাই ইবনে কাব (রা.) এর নিকট তাকওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কি কণ্টকাকীর্ণ পথে চলেন? তিনি জবাবে বললেন হ্যাঁ , উবাই ইবনে কাব (রা.) তখন আপনি কীভাবে চলেন? তিনি বলেন, খুব সতর্কতার সাথে কাঁটার আচড় থেকে শরীর ও কাপড় বাচিঁয়ে চলি, উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন এটাই তাকওয়া।
তাকওয়ার গুরুত্ব:
তাকওয়া মহান রব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে বান্দাহর জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। যাদেরকে তিনি এ নিয়ামত ও মর্যাদার গুণে গুণান্বিত করেন, তারা খুবই সৌভাগ্যশীল। তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থাস্থী জান্নাত। তাকওয়াপূর্ণ জীবন জান্নাতি জীবন। ইসলামি জীবন-দর্শনে তাকওয়াই সকল নেক কাজের মূল উৎস। তাকওয়া একটি মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মানুষের ব্যক্তি ও সামাজিক চরিত্র গঠনে তাকওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। যার মধ্যে তাকওয়া বিদ্যমান সে সর্বদা আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করে। আর যে আল্লাহকে হাজির-নাজির মনে করে, সে কোন পাপ কাজে জড়াতে পারে না। অপরপক্ষে যে তাকওয়া শূন্য তার দ্বারা সকল অপকর্ম করাই সম্ভব। আল্লাহর কাছে মর্যাদার মূল্যায়ন কী হবে তা তিনি নিজেই বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে যারা তাকওয়ার অধিকারী তারাই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত।”(সুরা হুজুরাত: ১৩) আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় (তাকওয়া অবলম্বন কর) তাহলে তিনি তোমাদেরকে ভালোমন্দের মধ্যে, পার্থক্য করার মানদ- বা যোগ্যতা ও শক্তি দান করবেন। তোমাদের গুনাহ মাফ করে দিবেন। কেননা, আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল।’ (সুরা আনফাল-২৯) ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতার কোনো মূল্য নেই, যদি সেখানে তাকওয়া বা আল্লহর ভয় না থাকে। তাকওয়াবান মানুষ নিশ্চিতভাবে জান্নাতলাভ করবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘আর যে ব্যক্তি নিজের প্রভুর সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে জান্নাতই তার বাসস্থান।’ (সুরা নাযিয়াত ৪০-৪১) আল্লাহ আরও বলেন ‘তোমরা আমাকে ভয় কর। কেননা, জেনে রেখ আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আল বাকারাহ: ১৯৪)। প্রবন্ধের শেষ প্রান্তে এসে সুরা আল ইমরান এর ১০২ নং আয়াতের প্রতি সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাই। আল্লাহ ঘোষণা করেন ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ না করে মৃত্যুবরণ করো না।’ (সুরা আল ইমরান ১০২)। এইযে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ বা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করতে বারণ করা হয়েছে। এটা যে কত উচ্চমানের এবং কতটা সতর্কতাপূর্ণ একটি আহবান সেটা আমাদের অন্তরচক্ষু দিয়ে উপলদ্ধি করতে হবে। সালাত, সাওম ও তাকওয়া বিষয়ে যা কিছু আলোচনা করা হয়েছে এবং একজন মুত্তাকি হিসাবে আমরা অত্যন্ত বিনম্রতার সাথে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যে তাকওয়া নীতি অবলম্বন করে থাকি তার প্রধান কারণই হলো আমরা বিশ্বাস করি আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের কার্যাদির হিসাব নিকাশ মৃত্যুর পরের অনন্ত জীবনের সাথে সরারসরি সম্পৃক্ত। দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী খেল-তামাশার জীবনের বেপরোয়া লক্ষ্যহীন উদাসীন খেয়ালখুশি মত মন চাই জীবন পরিচালনার কোনো সুযোগ একজন ইমানদারের নেই। পবিত্র মাহে রমজান আমাদের সম্মুখে সমাগত। আসুন ইমান প্রশিক্ষনের এই মাসকে পুরোপরি কাজে লাগিয়ে তাকওয়ার জীবনে নিজকে ভাসিয়ে দেই। ইমানের সাথে যেন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে পারি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেন আমাদেরকে সে তৌফিক দান করেন, আমিন।
লেখক: ব্যাংকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব