এম আকবর আলী : বাঙালি রেনেসাঁর অগ্রনায়ক

মাহমুদ ইউসুফ

বাংলাদেশের ইতিহাসের কৃতী সন্তানদের মধ্যে এম আকবর আলী প্রথম সারির। শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, ইতিহাসানুরাগী, ঐতিহ্য সন্ধানী প্রভৃতি অভিধায় তাঁকে ভূষিত করা যায়। ১৯১১ সালের ১ মার্চ, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করার পর সরকারের আয়কর বিভাগে নিরীক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। খুলনা ও চট্টগ্রাম অফিসে কয়েকবছর কর্মরত থেকে কলকাতায় বদলি হয়ে আসেন। এ সময় থেকেই কলকাতায় শুরু হয় মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা। ফলে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলে তিনি ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। ১৯৫৪ সালে তিনি করাচিতে যুগ্ম আয়কর কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পরবর্তী সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারী ও পরে উপ-সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন।

বাংলাভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান-সভ্যতার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাথে আধুনিকতার যোগসূত্র স্থাপনকারী প্রথম ও প্রধানতম ব্যক্তিত্ব হলেন মালিক আকবর আলী। সপ্তম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক দুনিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আরবরা। বিজ্ঞান, সাহিত্য, কলা, স্থাপত্য, গণিত, মহাকাশবিদ্যাসহ জ্ঞানের সকল সেক্টরে ছিলো তাদের অবাধ বিচরণ। আরবরাই জ্ঞান বিজ্ঞান সভ্যতার জনকের মর্যাদায় অভিসিক্ত। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক মানবেন্দ্র নাথ রায় লিখেছেন, ‘মুসলমানদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করেই ইউরোপ আধুনিক বিশ্বের অধিনায়ক হয়ে রইলো। এমনকি আজও তার শ্রেষ্ঠ মনীষীরা অতীত ঋণের বোঝা স্বীকার করতে সঙ্কুচিত হন না। দুর্ভাগ্য আমাদের, উত্তারিধকারসূত্রে প্রাপ্ত ইসলামের সংস্কৃতি সম্পদ থেকে ভারতবর্ষ তেমন উপকৃত হতে পারেনি, কেননা অনুরূপ সম্মানের অধিকারী হবার যোগ্যতা তার ছিলো না। এখনও এই বিলম্বিত রেনেসার সৃষ্টি বেদনায় মানবেতিহাসের এই অবিস্মরণীয় অধ্যায় থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করে হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে ভারতবাসীরা প্রভূত লাভবান হতে পারে। মানব সংস্কৃতিতে ইসলামের দান সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ আর উক্ত দানের ঐতিহাসিক মূল্যের যথার্থ অনুধাবন তাদের উদ্ধত আত্মপ্রসাদের প্রাসাদ থেকে বাইরে টেনে নিয়ে এসে হিন্দুদের চকিত বিস্ময়ে অভিভূত করে দেবে আর আমাদের এ যুগের মুসলমানদের সঙ্কীর্ণতা মুক্ত করে তারা যে ধর্মে বিশ্বাসী, তার মর্মবাণীর সঙ্গে তাদের মুখোমুখি পরিচয় করিয়ে দেবে’। (মানবেন্দ্র নাথ রায়, ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, পৃষ্ঠা ৮৮)।

মানবজাতির কল্যাণ সাধনে মুসলিম আলেমদের প্রচেষ্টার অন্ত ছিলো না। বর্তমানের পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র নির্মাণ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। পরস্পরকে ধ্বংস করা, অন্যদেশকে পশ্চাতে বা বিপদে রাখতেই তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। কিন্তু মানুষের মৌলিক অভাব পূরণে তাদের কর্মকৌশল নেই বললেই চলে। প্রতীচ্যের ধনিক শ্রেণির রাষ্ট্রগুলো এশিয়া আফ্রিকায় লুন্ঠন প্রবৃত্তি চালানোকেই গণতন্ত্র বলে মনে করে। ইসরাইল ইন্ডিয়া জোটও ওই একই পথের অভিযাত্রী। কিন্তু আরব বিজ্ঞানীরা মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ- এরূপ কোনো গবেষণায় অগ্রসর হয় নি। তারা আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে মানুষ ও জাতিরাষ্ট্রের কল্যাণীয় কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেন। ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, রুমী, জামী, শেখ সাদী, খৈয়াম, ইবনে নাফিস, আবদুল মজিদ, ইবনে ফিরনাহ, ইবনে খালদুনসহ অসংখ্য মনীষীদের কৃতিরাজী আজও সূর্যের মতো দেদীপ্যমান। মালিক আকবর আলী সেইসব মনি মুক্তোর সন্ধান করে খুঁজে খুঁজে জাতির সম্মুখে পেশ করেছেন।

এম আকবর আলীর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা হলো ১২ খণ্ডের বিজ্ঞানে মুসলমানের দান। প্রায় সাত হাজার পৃষ্ঠার বইটিতে রয়েছে তিন খণ্ড গণিতশাস্ত্র, দুই খণ্ড রসায়নশাস্ত্র, চার খণ্ড চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং তিন খণ্ড ভূগোল। তাঁর সর্বপ্রথম বই চাঁদ মামার দেশ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানে কুরআন (তিন খণ্ডে), এসপেক্ট অফ সাইন্স ইন রিলিজিয়ানস, এ কমপারেটিভ স্টাডি (তিন খণ্ডে), জাবির ইবনে হাইয়ান, আলবেরুনী, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম, ইস্তাম্বুলের পথে পথে, ভবিষ্যতের বিজ্ঞান ইত্যাদি। দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর সহযোগিতায় তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হলো সাইন্টিফিক ইনডিকেশন ইন দি কুরআন এবং মুসলিম কন্ট্রিবিউশন টু সাইন্স। এছাড়া তিনি প্রবাসী, মোহাম্মদী, সওগাত এবং আজাদ পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। 

ইবনে হাওকালের ভূগোল মালিক আকবর আলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদকর্ম। ‘ইবন হাওকালের ভুগোল’ ৪র্থ থেকে দশম শতাব্দীর সেরা ভূগোলবিদ ইবন হাওকাল এর লেখা একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ । তাঁর রচিত কিতাবুল মাসালিক ওয়ালা মামালিক গ্রন্থটি মুসলিম জগতের সর্বপ্রথম ভূগোল গ্রন্থ যা ইংরেজিতে তরযমা হয়ে পাশ্চাত্য দেশেও প্রকাশিত হয়েছিলো । ইবনে হাওকালের ভূগোল বইটি বাংলায় তরযমা হয়ে প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সনের জানুয়ারি মাসে । বইটির প্রকাশনা সংস্থা নওরোজ সাহিত্য সম্ভার এবং প্রকাশক ইফতেখার রসুল জর্জ । বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সুখেন দাস । ইবন হাওকাল এর পুর্ন নাম আবুল কাসেম মুহাম্মাদ ইবন আলি ইবন হাওকাল আননাসিবি আলবাগদাদি । তিনি উত্তর মেসোপটেমিয়া অন্তর্গত নাসিবিন শহরে জন্মগ্রহন করেন । জন্ম তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় নি । তিনি খুব সম্ভবত তাঁর প্রথম জীবন জন্মভুমিতেই অতিবাহিত করেন। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সময়ে তিনি একদম অভাবের মধ্যেই ছিলেন যদিও তিনি আগে বেশ ভালো অবস্থায় ছিলেন পরিবারের সহিত । এরপর বাগদাদ থেকে তাঁর কার্যকলাপ পরিচালিত হয় । এখান থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু হয় । তিনি প্রায় ত্রিশ বছর পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান ভ্রমন করেন। তবে তার দেশ থেকে দেশে ঘুরাঘুরির আসল উদ্দেশ্য কি ধর্ম প্রচার নাকি ব্যবসা সেই ব্যাপার এ তেমন কিছু বোঝা যায় না । তবে তিনি ধর্ম প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন তা বোঝা যায় । ইসলাম এর ভূগোল চর্চা শুরু হলে ভুগোলবিদরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়েন । একদল সমগ্র পৃথিবীর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তা পরিবেশন করতে থাকেন এবং এদের তথ্য নিরপেক্ষ তথ্য । আরেক দল যারা ছিলেন তারা কেবল মুসলিম জগত নিয়েই আলোচনা করেছেন । ইবনে হাওকাল দ্বিতীয় গোষ্ঠীর । তাই তার বইতে তৎকালীন মুসলিম জগত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে , তাই মুসলিম সম্রাজ্য ও এর ভৌগোলিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জানতে আগ্রহী পাঠক সমাজের কাছে বইটি বেশ উপকারী ও দরকারি বই হবে সেই ব্যাপারে আশা করা যায় । [Tultul Zabin, রকমারি]

এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ২০০১ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। সাতবাড়িয়া বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ তাঁর কৃতিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *