কবিতার ভাষা ও নির্মাণ কৌশল

নয়ন আহমেদ

জীবন-ভাষ্যের বিশুদ্ধ পাঠ-ই কবিতা। জীবন গড়ে ওঠে নানান উপাচারে- কর্ম কোলাহলকে আশ্রয় করে, জিজ্ঞাসাকে পরিব্যাপ্ত করে এবং তার ভেতর মানবিক প্রত্যয়কে প্রবৃদ্ধি করে। কবিতা আবার তাকে উপাদেয় করে। রসময় করে তোলে। জীবন আছে- এটা সবাই টের পায় না। বেঁচে থাকার আনন্দ আস্বাদন করতে পারে সবাই? এর জবাব দেয় কবিতা। বলে পালিয়ে বেড়িয়ো না। জীবনের সঙ্গে থাকো। জীবনের জন্য থাকো। পরিপূর্ণ হয়ে থাকো। ফ্যাকাশে হয়ো না। সবুজ হও। উদ্ভিদ সবুজ। রঙে-রূপে প্রবর্ধিত হও। এই তার নির্দেশ। এই বাণী সে বলে এসেছে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষায়। এ ভাষা কবিতার ভাষা।

কিন্তু কবিতার ভাষার প্রত্যক্ষ রূপটি কেমন? এই প্রশ্ন সহসা সমাধান করা কঠিন। বিজ্ঞান জগতের একটা নির্দিষ্ট ভাষা আছে। অংকশাস্ত্রের ভাষাও তৈরি করা আছে। কিন্তু কবিতার ভাষা? তার নির্দিষ্টতা নেই। সমাজ-রাষ্ট্র এর ভাষা তৈরি করে না। এর কাঠামো নেই- কোনো অবয়ব নেই। কবিকেই এ ভাষা তৈরির দায় নিতে হয়। তিনি জানেন প্রাত্যহিকতায় ধরা দেয় না কবিতা। চাল-ডাল-তেল-নুনের হিসেবেও নেই এর রূপ-প্রতীকী। আটপৌরে ভাষায় সমাজ চলে, রাষ্ট্র চলে। এমন কি জীবনও চলে। তবু এ ভাষা কবিতার ভাষা নয়। তবু কবির কাছে ভাষা আসে। অপূর্ব রূপে ধরা দেয় সে। সুন্দরী, রহস্যময়ী। ভাষা-সুন্দরী। কবি তার রূপে মুগ্ধ হন। বরণ করে নেন জীবনের সঙ্গী করে। তার ছোঁয়ায় সুন্দর হলো সবকিছু। কবি গোলাপের দিকে তাকান। দেখেন তাঁর অনুভূতির রঙে সেজেছে গোলাপ। তাঁর চৈতন্যে আছে এই রঙ। তাঁর বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়।

সুন্দরে আর পবিত্রতায় জীবনকে ধরে রাখে। তিনি তাকান সন্তানের দিকে। এ কে? কোন পৃথিবীর মায়া এ? এর তো কোনো তুলনা দেখেন না কবি। এর হাসি ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। এর হাঁটিহাঁটি পা, তুলতুলে হাত, মসৃন কোমল শরীরটুকু কবির কাছে অপার বিস্ময় হয়ে ধরা দেয়। জীবন তাঁর কাছে এভাবে আনন্দের উপাচার হয়ে ওঠে। তখন কবি সৃষ্টি করেন। তখন কবি ভাষাশিল্পী। তিনি আবিষ্কারক। এ তাঁর নিজের ভাষা। এ ভাষা ছিলো না। তিনি বানিয়েছেন।
সাধারণ ভাষা থেকে কবিতার ভাষা আলাদা হয় কেন? সে কি কেবল ছন্দ- অলংকারের কারণে? কবিতায় অনুভূতিই মূল কথা। অনুভবের তীব্রতা না থাকলে আমরা তাকে মান্য করতে পারি না। যে অনুভূতি জীবনের দিকে বেশি হেলে পড়ে- তার দিকে ঝুঁকে পড়ি আমরাও। চাঁদ ঝুঁকে থাকে পৃথিবীর দিকে। তার আলো বিদ্যুতের চেয়ে উজ্জ্বল নয়। কিন্তু, তার ছায়াচ্ছন্নতা, মৃদুতা, কোমলতা অন্য কিছুতে নেই। চাঁদের আলোয় প্রকৃতির নৃত্যরতা ভঙ্গি তাই বড় আবেদন সৃষ্টি করে। প্রশান্তি আনে মনে। দাহ দূর করে। ক্লেদ, ক্ষয়-ক্লীবত্ব-চাঞ্চল্য বিদূরিত করে শান্তির প্রলেপ বুলায় সে। প্রকৃতির এ বিজ্ঞান কবি জানেন। তাঁর অনুভূতির তীব্রতা যখন ভাষায় প্রকাশ পায়- সে ভাষা তখন সাধারণ থাকে না। প্রাত্যহিকতার মোড়কে সে প্রকাশ হয় না। কল্পনাশক্তি, সৌন্দর্য আর জীবন সম্পৃক্ত অভিজ্ঞতায় সে উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

সব শিল্পের লক্ষ্যই জীবন। আমরা জীবনকে যাপন করি। এর বাইরে আমাদের অভিজ্ঞতা নেই। তবে বৃহত্তর জীবনের কল্পনা আছে। তাকেও আমরা গণ্য করি। পার্থিব-অপার্থিব দুইয়ের যোগসূত্র স্থাপন করি আমরা। আমাদের শিল্পে তাকেই প্রমূর্ত করি। একটা ছেঁড়া স্যান্ডেলও আমাদের কাছে বেমানান। আমরা এটাকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারি না। জোড়া দিই, শেলাই করি। দুটোকে একত্রে পরি। কারণ- এটা আমাদের জীবন-যাপনের মধ্যে আছে। প্রত্যেকের বাড়িতে কিছু না কিছু আসবাব থাকে, তৈজশপত্র থাকে। এগুলো নির্দিষ্ট স্থানে রাখি। ধোয়া-মোছা করি। একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন রাখি না। কতো যত্ন নেই- সাজাই- গোছাই। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই যেতে হয় মানুষকে। সে জন্য এসব নিয়েই মানুষের সংসার গড়ে ওঠে। এইভাবে বস্তুকেও আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। সুতরাং জীবনে কোনো শূন্যতা নেই, বিচ্ছিন্নতা নেই। কেবল আছে জীবনকে ঘিরে থাকা, জীবনের ভেতরে থাকা। শিল্পে কি এই সুর বেজে ওঠে না? কবিতা কি এই নির্মাণের দিকেই হাঁটছে না?
কবি বিজ্ঞানী। তিনি জীবনের কথা যত সুন্দর করে বলেন- ততটা অন্য কেউ পারেন না। জীবনের পক্ষে দাঁড়িয়ে এর সব উত্তাপ শেখান তিনি। তিনি বলেন পরস্পর যোগ সূত্রের কথা। গাছের পাতা কেন সবুজ হয়- একই কাজ কবি ও বিজ্ঞানীর হলেও কবি খোঁজেন রঙে জীবন ও জগৎ কী রকম আশ্চর্য প্রাণবন্ত হয়- তার ইতিহাস। তার ভেতরে রঙ, বাইরে রঙ। অন্তরে রঙ, সোহাগে রঙ, রঙ যুদ্ধে কিংবা জীবনযুদ্ধে। সে জন্য, কবিতা রাজনীতির উর্ধ্বে। কারণ কবিতাকে দেতে হয় জীবন- প্রেরণার অংশ হিসেবে। পক্ষান্তরে রাজনীতি সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাষ্ট্রযন্ত্র সচল রাখার জন্য। কবিতার এ রকম কোনো দায় নেই। কারণ, কবিতা নিজেই একটা ধর্ম। ধর্মের যেমন সব আছে- কবিতারও তেমনি। সে একা রাজনীতি হয় না, শুধু ধর্ম হয় না, শুধু নীতিবাক্য হয় না। সে সম্মিলিত সুর, সে বৃহৎ আকাঙ্খা। ব্যাপ্তি ও ব্যাপ্ততা।

কবিতার অনেক প্রতিবেশী আছে। যেমন আছে মানুষের। সে যখন গড়ে ওঠে, অন্যের নিকট তখন হাত পাততে হয় অনেক কিছুর জন্য। একটা উপমা দরকার। এ জন্য সবার কাছে যেতে হয় তাকে। নদীর কাছে, স্রোতের কাছে, মাছ, গাছ, হাঁড়ি, বাড়ি- কেউই বাদ পড়ে না। একটা শব্দ দরকার। হাত পাতো সবার কাছে। দেবে সবাই। তবে হিসেব করে নিতে হবে। সমাজের কাছ থেকেই নিতে হবে। ঐতিহ্য আছে, ইতিহাস আছে, ধর্ম আছে, রাজনীতি আছে, মিথ আছে। কেউ তাকে অবহেলা করবে না। দেবে উদার হাতে। কিন্তু, কবিকে জানতে হয় কবিতার শরীর গড়তে দরকার ভাষা। দরকার কৌশল বা টেকনিক। দরকার পবিত্র চাতুরি। এসব না হলে কবিতার ভাষা হয় না। শিল্প হয় না। হয় এক ধরনের পদ্য। বাচ্যার্থের অধিক কিছু হয় না।

কোনো চিত্রশিল্পী গ্রাম এঁকে ফেললেন, কিন্তু সেখানে কিষাণী নেই, মায়ের কোলে শিশু নেই। এটাকে কেউ জীবনধর্মী শিল্পকর্ম বলবে না। যার কবিতায় মানুষের মনোবৃত্তির স্ফূরণ নেই- তাকে পদ্য ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। শিল্পের লক্ষ্য স্বাভাবিকতাকে দৃষ্টির মধ্যে নিয়ে আসা। রঙে তার মধ্যে চেতনা জেগে ওঠে। গতিময় হয়। জীবন লাভ করে। সুষমামন্ডিত চিত্রকর্মটি তখন চোখকে শীতল করে। তারপর, অন্তরে তার সুগভীর ছায়াটির ছাপচিত্র পড়তে থাকে। প্রকৃতিতেও এই মরমী চেতনা বিদ্যমান। যেমন পত্র-পুষ্পে, যেমন নদীর ঐশ্বর্যে। সর্বত্রই বাস্তুসাম্যের দৃষ্টান্ত চোখে পড়বে। চিত্রশিল্পীকে এই ব্যাপ্তির মধ্যে সুগভীর তাৎপর্য খুঁজতে হয়। কবিকেও রঙের ব্যবহার করতে হয় একই দৃষ্টিকোণ থেকে। এটি সম্ভব হয় রঙিন চিত্রকল্প বা উপমার সাযুজ্যে। আর তিনি তো ভাষাশিল্পী। ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে দরকার প্রতীক নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব দেয়া। তাতে বাহুল্য থেকে কবিতাকে মুক্ত রাখা যায়। তখন কবিতা হয়ে উঠে কৃষির মতো অনিবার্য- দ্যুতিময়।

‘না। মানুষ তোমার পক্ষে এর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর হওয়া সম্ভব নয়।
তোমার পায়ে পায়ে পলি পড়ে থাকে-
থোকা থোকা স্নেহের নদী।
তোমার ছায়ায় ছায়ায় মমতার রিবন
রাশি রাশি শস্যগন্ধা স্মৃতি।
…. … ….. … … …. …. …
তোমার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে জুঁইফুল ঝড়ে পড়ে
তোমার বুকের ভিতর ঝাঁকে ঝাঁকে মরমী কবুতর।’

[মানুষ বৃত্তান্তঃ উদ্বাস্তু আমিও ॥ কাশেম নবী]

কবিতার দায় কোথায়? কার কাছে? স্পষ্টতই, মানুষের সমাজকে আশ্রয় করেছে কবিতা। বিশ্বসংস্কৃতিরও অংশ সে। আমাদের বিবেচনায়, কবিতা সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিশুদ্ধ রূপ, সর্বপ্রধান নিয়ামক। সে সভ্যতার পথে পথে হাঁটবে। বিশ্বাস করবে চুনিয়ার মতো মানবিকতায়। শুশ্রুষা জানবে, সান্তনা শিখবে।

‘চুনিয়া শুশ্রুষা জানে,
চুনিয়া ব্যান্ডেজ বাঁধে, চুনিয়া সান্তনা শুধু-
চুনিয়া কখনো জানি কারুকেই আঘাত করে না;
চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তি প্রিয়- শান্তি ভালোবাসে,
কাঠুরের প্রতি তাই স্পষ্টতই তীব্র ঘৃণা হানে।

চুনিয়ারও অভিমান আছে,
শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে;
শিশু হত্যা, নারী হত্যা দেখে দেখে সে-ও
মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে।

চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনে প্রাণে
নিশিদিন আশার প্রদীপ জ্বেলে রাখে
চুনিয়া বিশ্বাস করে;
শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে
পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে।’

[বাংলাদেশের কবিতা # চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া/রফিক আজাদ]

আধ্যাত্মিকতা, জীবন সংগ্রাম, বাস্তবতা আর বৃহত্তর অভিপ্রায় কবিতাকে হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। তখন চেনাজানা শব্দই তুচ্ছতার গন্ডি অতিক্রম করে ছুটে চলে নদীর স্রোতের মতো রূপাতীত গন্তব্যে। তুচ্ছতার ওপর এই যে মহিমা, প্রাত্যহিকতা থেকে এই যে মুক্তি, আত্মগৌরবকে ডিঙিয়ে এই যে বিশ্ববোধের দীক্ষা- এর লক্ষ্য কি জীবনকে স্পর্শ করা নয়? এভাবেই ভাষা জড়তা থেকে মুক্তি পায়; হয়ে ওঠে ভাবের দ্যোতক- মানুষের আকাঙ্খার মতো স্পর্ধিত সাহস। ##

 

কবি নয়ন আহমেদ
প্রভাষক (বাংলা) , বাহেরচর সিনিয়র মাদরাসা, হিজলা।
সভাপতি, শেকড় সাহিত্য সংসদ, বরিশাল- ৮২০০

One comment

  1. চমৎকার। কবি নয়ন আহমেদের নিকট আরো গদ্য ভাষ্য আশা করি। নানা বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে লিখুন। নয়ন আহমেদ এমনই একজন শিল্পী তার হাত দিয়ে যাই আসুক তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। কবিকে অভিনন্দ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *