নয়ন আহমেদ ।।
এক অপরিহার্য কবিসত্তার নাম মতিউর রহমান মল্লিক। আমাদের মল্লিক ভাই। তাঁকে সর্বদা স্মরণ করি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়; হৃদয়ের গোলাপ ফুটিয়ে স্নিগ্ধ সৌরভে।
তাঁর সাথে প্রথম আলাপ হয় বরিশালে, একটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনে উদ্যোগে। সেটার দিন তারিখ এখন আর মনে নেই। সম্ভবত ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে। আমরা তখন শেকড় সাহিত্য সংগঠনের সাথে জড়িত। সংগঠনের পত্রিকা বের হয় নিয়মিত। মাসিক পত্রিকা। মল্লিক ভাইকে পাঠাই। অন্যান্য কবিকে পাঠাই। তখনও তাঁকে সরাসরি দেখিনি। তাঁর কবিতা পড়ি বিভিন্ন পত্রিকায়। কবিতা পড়ে আপ্লুত হই। ভালোবাসা জন্মে। প্রথম দেখাতেই সেই ভালোবাসা ডালপালা ছড়ায়। ভালোবাসার গাছটির শেকড় বহুদূর বিস্তৃত হয়। মজবুত হয়। মনে আছে মল্লিক ভাইয়ের প্রতিটি কথা, প্রতিটি উচ্চারণ। কথা বললে তাঁর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে সরলতার আবহ। দেখেছি, সবার প্রতি তার সমান ভালোবাসা। মনে কোনো ঈর্ষা নেই, অহংকার নেই। কারো প্রতি বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ নেই। মাটির মানুষ। বিনীত স্বভাবে তিনি সবার আপন হয়েছেন। সবার ভাই হয়েছেন।
মল্লিক ভাইয়ের সাথে আড্ডার স্মৃতিগুলো রজনীগন্ধার মতো সতেজ হয়ে আছে। তিনি গল্পে গল্পে আসর মাতিয়ে তুলতেন। সবার খোঁজ-খবর নিতেন। গান শুনাতেন। ইসলামী আদর্শের গান। কবিতা শুনাতেন। কবিতা শুনতে চাইতেন। কেউ ভুল উচ্চারণ করলে শুধরে দিতেন। তাতে স্নেহ ছিল, দরদ ছিল। কেউ তাঁকে কর্কশ স্বরে কিছু উচ্চারণ করতে দেখেনি। কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা তাঁর স্বভাবে ছিল না। সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। বিরক্ত হতেন না। নবীনদের প্রতি তাঁর অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন- নবীনরা উন্নত সাহিত্য সৃষ্টি করবে। তিনি উপদেশ দিতেন। সেই উপদেশ ছিল মধুমাখা। তরুণদের কাছে ডাকতেন। পবিত্র কুরআন থেকে আশশুয়ারা সুরাটি তিলাওয়াত করতেন। ঐ সুরায় কবি ও কবিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিশ্বাসী কবি আর অবিশ্বাসী কবি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা দেওয়া হয়েছে। তিনি সেই কথা কী যে সুন্দর করে বলতেন! কথাগুলো শুনে কবিতার পথ সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট উপলব্ধি হতো।
মল্লিক ভাই ও আমরা একদিন ঝালকাঠিতে যাচ্ছিলাম বাসে চড়ে। সাথে ছিলেন কবি আল হাফিজ। সেই সফরে আমরা খুব মজা করছিলাম। বাসে পুরো সময়টা কাটছিল গল্প করে। ফাঁকে ফাঁকে চলছিল সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা। মল্লিক ভাইকে নানান প্রশ্ন করেছি। আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান- সবার কথাই হলো। তাঁদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা দেখে আমাদের খুব ভালো লেগেছিল। তিনি মানবতাবাদী সাহিত্য সম্পর্কে অনেক কথা বললেন। ইসলামই যে সর্বজনীন কল্যাণকর সাহিত্য উপহার দিতে পারে সে কথা বললেন খুব সুন্দর করে। এরই আলোকে গড়ে উঠবে সর্বোত্তম সাহিত্য। আর সেই সাহিত্যে নতুন ভাষা ও বাগ্বিধির প্রয়োগ ঘটবে। এ প্রজন্মের তরুণরা ইসলাম অধ্যয়ন করছে। ইসলামকে তারা বাস্তবিক অর্থেই ব্যবহার করবে। শিল্প-সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটবে। অশ্লীল সাহিত্যে মানবতার কল্যাণ নেই। এই কথাগুলো তিনি সবখানেই বলেছেন। তিনি সুন্দর বাচনভঙ্গিতে, সংহত স্বরে এই বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন। সে দিন ঝালকাঠিতে তিনি সবার মন জয় করেছিলেন শিল্প ও সাহিত্যের নানাদিক সম্পর্কে আলোচনা করে।
সমসাময়িক বন্ধুকবিদের তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। কারও একটি লেখা ভালো লাগলে, সেটি জানাতে বিলম্ব করতেন না। শুকরিয়া জানাতেন। আরও লেখার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। মোশাররফ হোসেন খান, হাসান আলীম, গোলাম মোহাম্মদ, সোলায়মান আহসান প্রমুখ কবির কবিতায় মুগ্ধ ছিলেন তিনি। বলতেন- এঁদের প্রত্যেকের কবিতায় আগুন আছে; তেজ আছে। সবসময়ই আশাবাদী মানসিকতা পোষণ করতেন তিনি।
বরিশালে তাঁর সাথে বহুবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। তিনি হেরাররশ্মি, বরিশাল সাংস্কৃতিক সংসদ, সমন্বিত সংস্কৃতি সংসদ (সসাস) ও শেকড়-এর আমন্ত্রণে বরিশালে এসেছিলেন কয়েকবার। একবার টাউনহলে বিশাল সমাবেশ হচ্ছিল। সেই সমাবেশে তিনি কবিতা পড়লেন, গান গাইলেন, প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তৃতা দিলেন। ইসলামী সংস্কৃতি বিষয়ে তিনি মনকাড়া আলোচনা করলেন। আমাদের কবিতা শুনলেন। কবিতা শুনে উদার প্রশংসা করলেন।
আরেক দিনের কথা। খুব সকাল বেলা মল্লিক ভাই এসেছেন ঢাকা থেকে। লঞ্চে চড়ে। লঞ্চভ্রমণ যে খুব আরামদায়ক, সে কথা তিনি বলতে ভুললেন না। ঢাকা-বরিশাল ভ্রমণ তিনি খুব উপভোগ করতেন। তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। আমাদের পেয়ে তিনি খুব খুশি হলেন। তারপর সবাইকে একটু বসতে বললেন। বললেন, ‘কবিরা এসেছে, তাদের সাথে একটু ঘুরে আসি’। সদর রোডের বিবির পুকুরের আশপাশ ঘুরলেন। পাশের ভাতের দোকান থেকে গরম ভাতের সুবাস আসছে। আল হাফিজ বললো, ‘মল্লিক ভাই, গরম ভাত খাবেন? ভর্তা দিয়ে। ৮/৯ পদের ভর্তা আছে’। সেদিন মল্লিক ভাই রাজি হয়ে গেলেন। একটা দোকানে ঢুকলাম। আমরা ভর্তা দিয়ে ভাত খেলাম। আলুভর্তা, বেগুনভর্তা আর ধনেপাতাভর্তা। বরিশালের ভর্তায় মরিচ একটু বেশি ব্যবহার করা হয়। ধনেপাতার ভর্তাটা খেয়ে তিনি বললেন, ‘অপূর্ব’!
তিনি এই সাধারণ খাবার খেয়ে খুশি হয়েছিলেন খুব।
মল্লিক ভাই ছিলেন একজন অভিভাবক। ঢাকার প্রত্যাশা প্রাঙ্গণে গেলে তিনি সময় দিতেন। যত্ন করতেন। খাওয়াতেন। পকেটে টাকা গুঁজে দিতেন। বলতেন, নাও। লাগবে।
তাঁর সাথে দেখাসাক্ষাৎ ছিল সৌভাগ্যের বিষয়। মন ভালো হয়ে যেত। হৃদয় পবিত্র হয়ে যেত। তিনি বলতেন, ‘নয়ন আমার ছোট ভাই’। মল্লিক ভাইয়ের চেহারার সাথে কিছুটা মিল থাকার কারণে আমাকে ছোট ভাই ডাকতেন। মল্লিক ভাই- একজন মহান কবির স্মৃতি নকশিকাঁথা হয়ে রইলো আমার মনে।
কবি নয়ন আহমেদ সভাপতি, শেকড় সাহিত্য সংসদ, বরিশাল।