নয়ন আহমেদ : আপন শব্দভূবনে যিনি তুলনাহীন

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

নয়ন আহমেদ। নব্বই দশকের প্রতিশ্রুতিশীল একজন খাঁটি কবি। জম্ম ঝালকাঠি জেলায়। পেশা অধ্যাপনা, তবে তাঁর নেশা এবং ধ্যান-জ্ঞান সবই কবিতা কেন্দ্রিক। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি কাব্যচর্চা তাঁর পেশার বড় একটি অংশও বটে। তাঁর কাব্যের পরতে পরতে লেগে আছে কোরআনিক পরিভাষা; যেমন- আয়াত, সেজদা, রুকু, মুসা, মোহাম্মদ প্রভৃতি। বিষয় নির্বাচনে তাঁর অবস্থান বহুমুখী। ভাবের গভীরতা এবং বর্ণনাভঙ্গির চমৎকারিত্বে তিনি পাঠককূলকে মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। উপস্থাপনের পারঙ্গমতা তাঁকে অনন্য মহিমায় সমুদ্ভাসিত করেছে। আত্মপ্রত্যয়ী, বিশ্বাসে অনড়, লক্ষ্যে অটুট এক কবির নাম নয়ন আহমেদ। তাঁর কাব্য মৌলচেতনা- নিজস্ব বাগবিধি সম্পন্ন। কৃষক যেমন সবটুকু সামর্থ উজাড় করে দিয়ে মাঠে ফসল ফলান, নয়ন আহমেদ তেমনি নিজস্ব কাব্য বীজ উপ্ত করেছেন হৃদয়ে; যার নমুনা হচ্ছে ২০০৯ সালে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘আমার বিবাহিত শব্দরা’।

শব্দকে তিনি বিয়ে করেছেন, মানে আপন করে নিয়েছেন। শব্দ নিয়েই তাঁর ঘর গেরস্থালি। কোরআনের চেতনাকে ধারন করে, ইতিহাসকে অবলম্বন করে, মিথ ও দর্শনের বর্ননা উপস্থাপন করে তিনি তাঁর কাব্য সাজিয়েছেন। গ্রন্থের নামকরণে যেমন অভিনবত্ব রয়েছে, তেমনি আদুরে শব্দ চয়নে তিনি বুনন করেছেন কাব্যের চাদর। সে চাদরে তাঁকে বেশ ভালই মানিয়েছে, হয়েছে যুৎসই । সোনায় সোহাগা বললেও অত্যুক্তি হবেনা।

নয়ন আহমেদের কাব্যে কুরআন-হাদিসের প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে বিশ্বাসী চেতনায় । মানুষের আদি অবস্থান, পৃথিবীতে তাঁর আগমন, খাদিজা-মুহম্মদের সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়কে তিনি তার কাব্যে তুলে এনেছেন শিল্পীত বর্ননায়। যেমন: ‘আমি খাদিজার মুহম্মদের মতো তাকবিরে তাহরিমা বলি, প্রিয়তমা’ (সঙ্গি)। কবিতায় আত্নকথন কিংবা ব্যক্তিগত কড়চাও এসেছে অবলীলাক্রমে। তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নিজস্ব বাগবিধি ও যৌগিক শব্দের প্রয়োগ। যেমন: প্রশংসার ফ্রিজ, সূর্যের পাঞ্জাবি, স্মৃতিজ ভেষজ, কামরাঙা রোদ, বয়স্ক শয্যা, ঝনঝন করা হতাশা, নির্বাচিত অনুতাপগুচ্ছ, আলোর তবারক, বেয়াদব বিস্ময়, প্যাকেটজাত আরাধনা, সাদাভাত সকাল, দোল খাওয়া ক্রুদ্ধতা, খোঁপা করা পৃথিবী, প্রহরারত ক্রোধ, গোলাভরা কলরব, বাতাসের সমুদ্র, সেলাই করা অন্ধকার, সবুজ লবন, ফরশা কামনা প্রভৃতি। শব্দের নিজস্ব ভূবন তৈরিতে প্রয়াস বিশেষভাবে লক্ষনীয়।
‘এসব ভালোনা’ এবং ‘মানুষ’ কতিায় এর প্রমাণ মেলে; কিংবা তাঁর উক্তি ‘আমি দুনিয়াকে আলু ভর্তার মতো স্বাদযুক্ত করে দেব’ ‘নক্ষত্রের সাথে মুসাহাফা’ প্রভৃতি।

তার কবিতায় অবলীলাক্রমে এসেছে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার। এছাড়াও বিশ্বায়নের চিত্রও তার কবিতায় এসেছে স্যাটায়ার্ড ভায়ায়, যেমন – কিন্ডার গার্টেন পড়ূয়া বাচ্চাটি যাচ্ছে দ্যাখো/ আহ! সে নুজ্ব্য হয়ে আছে বইয়ের ভারে বেকে আছে মেরুদন্ড/ না না ! বাচ্চাটি নয় / বেদনা ও অপমানের ভারে জর্জরিত তৃতীয় বিশ্ব’
স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কবিতায় এসেছে প্রেমের অনুসঙ্গ। যেমন সভ্যতা কবিতায় এসেছে- ‘তোমার সুন্দর করে শাড়ি পরা দেখে আমি একটি উজ্জ্বল শান্তি প্রস্তাব রচনা করতে পারি’। সভ্যতার বিবরণ দিয়েছেন দুটি পাখির জীবনাচরন দিয়ে। বানানের ক্ষেত্রে তার রয়েছে নিজস্বতা। উপমার ক্ষেত্রেও রয়েছে অভিনবত্ব। যেমন: ‘প্রভাতের মতো দেবর ননদ’, ‘রৌদ্রের মত পাঠ’ ‘বর্ণময় যৌথ আলো’ ‘আগুনের কনিষ্ঠ বাচ্চা’ ‘আঁধারের উর্বর বীজ’ ‘দোচালা ঘরের মত জিজ্ঞাসা’।

প্রিয় দেশ নিয়ে রয়েছে তাঁর গভীর মমত্ববোধ। তাঁর কবিতায় রয়েছে নবতর সৃষ্টি। যেমন: ‘বিক্রি হচ্ছে রোদ, বিক্রি হচ্ছে ক্রোধ’ (বিকল্প), গার্মেন্টস এর কাটিং মাস্টারের মতো টুকরো টুকরো করি মানবতা’ (গুজরাট)। সুতীক্ষ্ণ সমালোচনা রয়েছে তাঁর কবিতায়- ‘চতুর বুশের মত জিহ্বা নড়ে তোমার’ (ডামি)। অর্থনীতি-১, অর্থনীতি-২ কবিতায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দৈন্যতা প্রতিফলিত হয়েছে। ফখরুদ্দিনের সই করা পাঁচ কিংবা দশ টাকার নোটে সুন্দর দৃশ্য রয়েছে কিন্তু এর বাস্তবতা নেই। অভিনব ভঙ্গিতে হয়েছে প্রকৃতির বন্দনা (ষোড়শী মেঘের ওলান)। ‘রান্না’ নয়ন আহমেদের একটি অসাধারন কবিতা। এতে তিনি ব্যবহার করেছেন- নি:শ্বাসের চচ্চরি, ক্রোধের তরবারী, পুষ্টিকর দ্রোহ, মানবতার বড়া, সবশেষে কবিতার রান্না করা তরকারীর নাম দিয়েছেন ‘ইতিহাসের সালুন’। তাঁর আরেকটি ঐতিহাসিক কবিতা মিনামাটা। গ্রন্থশেষে তিনি নতুন পৃথিবী গড়ার জন্য জওয়ানদের আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন- ‘তাহলে কে পড়তে জানো ——- বোমার বিরুদ্ধে ঘাস ও গুল্মের মতোন সজীবতা’ কে পড়তে জানো কে?

অসাধারণ এ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে শেকড় সাহিত্য সংসদ, বরিশাল। প্রচ্ছদ একেছেন চারু পিন্টু। গ্রন্থটির মূল্য ৬০ টাকা। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

আযাদ আলাউদ্দীন, বরিশাল ব্যুরো চিফ, দৈনিক নয়া দিগন্ত ০১৭১২-১৮৯৩৩৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *