কাব্যগ্রন্থ : জীবন এক জলকণা

লুৎফ-এ-আলম

২০২০ সালে অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে বরিশালের কবি মোহাম্মদ এমরানের কাব্যগ্রন্থ ‘জীবন এক জলকণা’। কাব্যগ্রন্থটির মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবি, অভিনেতা ও কথাশিল্পী এবিএম সোহেল রশিদ কাব্যের অগ্রভাগে লিখেছেন – নগর যন্ত্রনার নীল রং তাঁকে কাব্যিক দৃশ্যপট আঁকতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তার মর্ম আমিও দেখতে পাই এই কাব্যের কয়েকটি কবিতায়। তবে সব কবিতার ক্ষেত্রে একরকম প্রেক্ষাপট নয়। গ্রন্থের শেষে কবির পরিচিতি দিতে গিয়ে প্রকাশক এম নন্দিনী খান মন্তব্য করেছেন- মোহাম্মদ এমরান প্রকৃতির নির্যাস মন্থন করে শব্দের কথামালায় কবিতা নির্মানের কৌশল আত্মস্থ করেছেন। রপ্ত করেছেন অনুভূতির আবিরে রাঙানো চিত্রকল্প নির্মানের দক্ষতা।

৬৬ টি কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি রচিত হলেও ছড়ার ন্যায় কিছু কবিতা ছড়িয়ে রয়েছে। পড়তে ভালো লাগে। পড়া শেষ কবিতাও শেষ। মনে রাখার মতো নয়। তবে ৭/৮ টি কবিতা ভোরের তাজা প্রস্ফুটিত ফুলের ন্যায় ঘ্রাণ ছড়ায়। প্রাকৃতিক শোভায় হৃদয়গ্রাহী আবার পড়ার আগ্রহ জাগায়। শেষ হয়ে হয় না শেষ। তাই গ্রন্থটি সযত্নে কালেকশনে রাখা যায়। কারণ তরুণ কবি হৃদয়ের আবেগ, সংযম এবং কাব্যের ভাষা সুরুচি ও বৈচিত্র বোধের পরিচায়ক।

কবি মোহাম্মদ এমরান প্রকৃতি প্রেমী, শিক্ষাদীক্ষায় বুদ্ধিদীপ্ত ও রাজনীতি সচেতন। যারা দেশকে ভালোবাসেন, প্রকৃতিকে ভালবাসেন, দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবেন, তারাই তার এ কাব্যের প্রেরণা। ৬৫0 সালের দিকের       এ ভুখন্ড, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাংলার এ ভূবনে বৌদ্ধ ভিক্ষু সহজিয়ার চর্যাপদে রচনা করেছিলেন এখানকার বসবাসরত সহজ সরল মানুষের ছবি। তারপরও থেমে থাকেনি শতাব্দীর পর শতাব্দী। ১৪০০ বছর পর ২০২০ সালে এ যুগের এমরান তার রচিত কিছু কবিতায়ও স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন। কবিতার বিষয়বস্তু উপস্থাপনে বাক্য নির্মাণে শব্দ চয়নে, দক্ষতা চোখে পড়ার মতো। বাবা কবিতাটি গ্রাম বাংলার শাশ্বত জীবনের কথা। খেটে খাওয়া অবহেলিত সহজ সরল এক পিতার প্রতিচ্ছবি-

গায়ের শার্টটা তিল ভরা শত / কলারটা ফেটে হয়ে গেছে ক্ষত

তবুও যে শার্টটা পাল্টাতে না চায় / সন্তান-সংসারের চিন্তা করতে করতে

অনায়াসেই যে জীবনটা পার করে দেয় / হ্যাঁ, ঠিক তাই। এমন মানুষইতো ‘বাবা’ হয়।

শেষের চরণটি এভাবে যোগ না করলেও পাঠকের হৃদয়ের তন্ত্রীতে বাবার প্রতি যে শ্রদ্ধা তা অনুরণন হয়েছে। অনুরুপ এমরানের ‘মা’ শিরোনামের কবিতাটিও একই দৃষ্টিভঙ্গি ও একই ছন্দে রচিত। কোন হেরফের নেই। মানুষকে ভালবাসার জলন্ত দৃষ্টান্ত এ কবিতাদ্বয়। মানুষকে ভালবাসার আর এক বাস্তব নিদর্শন ‘আমি একজন বীমাশিল্পী’ কবিতাটি। কবি এই কবিতায় গর্ব করে বলেছেন—

আমি একজন বীমা শিল্পী /এটাই আমার অহংকার

আমি মানুষকে্ ‍ঋণমুখিতা থেকে ফিরিয়ে সঞ্চয়মুখী করি-

আমি মৃত্যুর পরও মানুষের লাশকে / পরিবারের নিকট অমূল্য সম্পদ করে তুলি।

এছাড়াও আরো কয়েকটি কবিতায় মানুষের কথা রয়েছে।। কবি আবার কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবেন। প্রেমাষ্পদের চিত্র আকে তার বিদীর্ন হৃদয়ে। স্যাঁতস্যাঁতে জলমাখা তোমার আঁখির পরে চেতনা হারিয়ে অবচেতন মনে এক অনন্য উচ্ছলতা ঘিরে।

তরুণ কবি মোহাম্মদ এমরান চিরন্তন বাংলার চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছেন-তার কবিতায়-

চৈতালি ফুলের পুস্পরেণু, আম্রকাননে ভ্রমরেরা, আঁকাবাঁকা মেঠোপথে, পালতোলা নায়ে, গায়ের ছেলে, উদোম গায়ে গ্রীষ্মের খরতাপে, নায়ের লগি পায় না মাটি, গরম জিলাপি মুড়িয়ে কলাপাতা, বোহেই পাতা নকুল দানা, ব্যাঙের ছানা, শাপলা লতা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সবই চিরন্তন।

তালগাছের ভেলায় চড়ে, ধান ক্ষেতের আইলে কৈ মাছ ধরার চাই পাতা।

কবির নেতা কথন পেুরনো কাসুন্দি নতুন করে শুনতে ভাল লাগে।

ভোট আসে ভোট যায় / নেতার বেটাই নেতা হয়

আমজনতা হায় হায় / পায়ের কাছেই পড়ে রয়।

এখানে কবির বাস্তবদর্শী সচেতন মানুষের জীবন দর্শনের কথা ব্যক্ত হয়েছে। সমাজে শিক্ষাঙ্গনে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু চিহ্নিত দুর্বৃত্তের নগ্ন কার্যকলাপ ও তাদের ঘৃণিত ব্যবহার অসহ্য। কবি তাদের হিংস্র কুকুরের সাথে তুলনা করেছেন। বুয়েটের শিক্ষার্থী কুষ্টিয়া নিবাসী আবরার ফাহাদকে নিয়ে—

আর কত কামড়াবি তোরা

তোদের নির্মম অত্যাচারে মরল মেধাবী ছাত্র আবরার

তোরা পাষাণ তোরা কুৎসিৎ…

ঘৃণিত তোরা লজ্জিত জাতি

আহ। পেতি না রেহাই কখনোই কুকুরের দল-

বেঁচে থাকতো যদি আজি বাঙ্গালী জাতির পিতা।

কবিতার শেষ চরণে এসে দেখতে পাই তরুণ কবি এমরানের উপলব্দি আর হৃদয়ে ভক্তিশ্রদ্ধা। এ যে তার দীক্ষা। জাতির পিতার আদর্শের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধাঞ্জলি। এরকম কবিতা আগামীতে প্রত্যাশা।

মানবতা বা বিবর্তিত মানবতা এবং নদীকে নিয়েও কবিতা রয়েছে। এই শব্দদুটি কবি এমরানের খুবই প্রিয় বিষয় বলে মনে হয়েছে।

ঢাকার নোলক প্রকাশন কর্তৃপক্ষ প্রকাশনার মত বিরাট দায়িত্ব গ্রহণ করলেও ৬৬ টি কবিতার মধ্যে ‘জীবন এক জলকণা’ নামের কোন কবিতা নেই। এরকম দৃষ্টান্ত অনেক কাব্যগ্রন্থে আছে। বইটির প্রচ্ছদ একেছেন ওয়ালিউল ইসলাম। সামিরা রশিদ প্রিতুলার কম্পিউটার কম্পোজ ও আইডিয়া প্রিন্টার্স মুদ্রণের কাজটি সুচারু রূপে সম্পন্ন করেছে৤ নোলকের এম এম খান ও এম নন্দিনী খানসহ প্রকাশনে যুক্ত সকল কর্মকর্তা কমচারীর যৌথ এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়৤ গ্রন্থের মূল্য ২০০ টাকা৤ পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮০৤

‘জীবন এক জলকণা’ কাব্যগ্রন্থটি কবি মোহাম্মদ এমরান উৎসর্গ করেছেন তাঁর মা জননীকে। পৃথিবীর সবচেয়ে যিনি আপনজন। মোহাম্মদ এমরানকে কখনো মনে হয়েছে মানবদরদী, সংবেদনশীল। কখোনো খানিকটা রোমান্টিক। তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনুভূতি আর যুক্তি বিচারই ‘জীবন এক জলকণা’ কাব্য গ্রন্থে প্রতিফলিত।

আমার বিশ্বাস, কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্য নিয়ে যারা চর্চা করেন সেই সুধী মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হবে। তরুন কবি মোহাম্মদ এমরানের দীর্ঘ জীবন ও সাফল্য কামনা করি।।

 

লুৎফ-এ আলম চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও দৈনিক শাহনামার সাহিত্য সম্পাদক।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *