ক্ষুধার তাড়নায় শিল্প কাঁদে

আবু সায়েম আকন ।।

সৃষ্টিকুলের সকল প্রাণিকে ক্ষুধা প্রতিনিয়তই তাড়িয়ে বেড়ায়। মানুষ, পশু পাখি, কীটপতঙ্গ সকলেরই প্রতিদিন ক্ষুধার তাড়না পোহাতে হয়। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য অন্যতম। আর ক্ষুধা নিবারণের জন্য হয় খাদ্যের প্রয়োজন। মানুষকে সেই খাদ্য কোননা কোনো উপায়ে রোজগার করে খেতে হয়।
তাইতো সমাজের মানুষ একেকজন একেক উপায়ে খাবারের ব্যবস্থা করে। মানুষের মধ্যে কিছু রয়েছে স্বাধীন চেতা। পরাধীনতার ভিতরে থাকতে তারা একদমই অভ্যস্ত নয়। এই মানুষগুলো আবার নিজের মত করেই ভবিষ্যত সাজায়। এদের মধ্যে শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে কেউ কেউ হয় শিল্পী। আবার অনেকে শিল্পটাকেই করে নেয় খাদ্য রোজগারের মাধ্যম।

পৃথিবীর অনেক শিল্পের মধ্যে আর্ট শিল্প একটি। সুন্দর এ পৃথিবীর প্রকৃতিকে আরো প্রাণবন্ত করতে, শিল্পী তার মনের মাধুরি মিশিয়ে রং, তুলি, শব্দের মিলনের মাধ্যমে অন্যের মনে আনন্দ ফোটানোকেই শিল্প বা আর্ট বলে। যেটাকে তুলি শিল্প, চারুশিল্প, কারুশিল্প, ললিতকলা, চারুকলাও বলা হয়। রং আর তুলির ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তোলা হয় মানুষের মনের ভাষা। আবার শিল্পী রং তুলির খেলার মাঝে খুজে নেয় নিজের আনন্দ। নিজ এবং পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বটাও তুলে দেয় এই রং তুলির হাতেই। আমরা জানি শিল্পীদের থাকেনা কোন বিলাসী জীবনের চাহিদা। যতটুকু আয় হয় তা দিয়েই শিল্পী তার সংসারের খরচের খাতাটা সাজায়।

আর্ট শিল্পের কথা বলতেই চোখে ভাসে শহরের রিক্সার গায়ে, টেম্পোর গায়ে ও ট্রলারের গায়ে, দেয়ালের গায়ে, শিল্পীদের মনের মাধুরি মিশিয়ে আঁকা হরেক রকমের ছবি। ছিনেমা হলগুলোর সামনে টাঙ্গানো চলমান সিনেমার দৃশ্য আঁকা হতো শিল্পীর রং তুলিতে। এসব স্থানে তাকালে এখন আর দেখা মিলেনা এসব শিল্পের।
ঝালকাঠির রাজাপুর সদরের বিশ্বাস বাড়ি এলাকার পঞ্চাশোর্ধ অঞ্জন মিস্ত্রী। উচ্চ শিক্ষিত হাসিখুশি সদালাপি একজন মানুষ। ছয় জনের পরিবারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। ছোট বেলা থেকেই শিল্পী মন নিয়ে বেড়ে ওঠা। মঞ্চ অভিনয় আর আর্টের উপরে ছিল তার দুর্বলতা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও রয়েছে তার প্রশিক্ষণ। এক সময় সংসারের ভার মাথায় পরতেই সখের বসে করা শিল্পটাকেই নিয়ে নিলেন পেশা হিসেবে। রাজাপুর ডাকবাংলো মোড়ের ভাড়ার দোকানে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে এই শিল্পটাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন সঙ্গী করে। একটা সময় নিজ উপজেলা সহ পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকেও ব্যানার, সাইনবোর্ড, ফেস্টুন লেখা, ছবি আঁকা, বাঁধাই, ওয়ালমেট বাঁধাই সহ বিভিন্ন কাজ করানোর জন্য তার রং তুলি নিয়ে বসা ছোট ঘরটিতে সর্বদা মানুষের ভীড় লেগেই থাকত। হাসিমুখে রংতুলির মিলন ঘটিয়ে কাপড়, কাঠ, টিনের বুকে, দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তুলতেন গ্রাহকের মনের ভাষা। আর গ্রাহকের খুশিতেই খুশি হয়ে যেত শিল্পী ও তার পরিবার।

কিন্তু এখন আর আগের মত রং তুলির খেলা চোখে পরেনা। অঞ্জন মিস্ত্রীর মুখেও নেই আগের মত হাসি। দোকানেও নেই আগের মত গ্রাহকের ভিড়। দিনের যেকোন সময়ই দোকানের সামনে দিয়ে গেলে অঞ্জন মিস্ত্রীকে দেখা যায় মন মরা হয়ে বসে আছে দোকানে। এ যেন বয়স থাকতেই অবসরে যেতে বাধ্য করার মত। গায়ে নেই আগের মত বাহারি পোষাক। হাতে নেই কাজ, তবুও মাথার উপরে রয়েছে সংসারের চাপ। দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধগতির বাজারে প্রতিটি দিনই কাটে তার অনাহারে, অর্ধাহারে।
কথা হয় শিল্পী অঞ্জন মিস্ত্রীর সাথে, জানতে চাওয়া হয় শিল্পীদের সম্পর্কে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করেন, জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান, সমরজিত রায়, রফিকুননবিদের থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়ার গল্প। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প। শিল্প আজ তাকে কোথায় রেখেছে তার গল্প। একে একে বলতে থাকেন মনে জমানো কষ্টের কথা।

তিনি বলেন, আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি আমরা যাদের অনুপ্রেরণায় এই শিল্পের হাল ধরেছি তারা যদি জানতেন তাহলে তারাও হয়তো এই শিল্পের প্রসার ঘটাতেন না। শিল্প আজ ডিজিটাল হয়ে গছে। আর শিল্পীও কোন রক্ত মাংসের মানুষ নয়। শিল্পী হলো উন্নত দেশের লোহার তৈরি যন্ত্র। তার কাছে মানুষ যেমন করে চায় সে তেমন করেই প্রয়োজন মেটায়। আমাদের সকল কাজ এখন তার দখলে। আর আমাদের জীবন কাঁটছে অর্ধাহারে, অনাহারে। শিল্পী মানুষ, শুধু এই কাজটাই শিখেছি। লেখা পড়া শেষ করে চাকরির পেছনেও ছুটিনি। আর এই বয়সে সেই সুযোগটাও নাই। আমার মত দেশের সকল আর্ট শিল্পীদের একই অবস্থা। না পারছি ছাড়তে আর না পাচ্ছি কাজ। এমন চলতে থাকলে এই শিল্পটা যেমন হারিয়ে যাবে, তেমনি ঘটবে সকল আর্ট শিল্পীদের অকাল মৃত্যু। এ যেন ক্ষুধার তাড়নায় শিল্প কাঁদে।

আবু সায়েম আকন
সম্পাদক ও প্রকাশক
আমাদের ধানসিঁড়ি.কম
০১৭১১১৮৩১৪৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *