গল্পের আড়ালে থাকা এক মহান ব্যক্তি

হাসনাহেনা ।।

এমন একজন ব্যক্তির কথা লিখতে বসেছি, যিনি একাধারে সাংবাদিক, শিক্ষানুরাগী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া উদ্যোগী অন্যায়ের প্রতিবাদী, সমাজসেবক ও সর্বোপরি তিনি একজন বাবা ছিলেন। তিনি হলেন মরহুম এ. কে.এম গোলাম নাসির।
আজ থেকে ঠিক ২০ বছর আগে ২০০১ সালের ২৪ জুলাইর সূর্যাস্তের সাথে আমাদের পরিবারে নেমে এসেছিল সেই দূর্ভাগ্যের রাত। মাত্র ৫১ বছর বয়সেই আমার বাবা এ কে এম গোলাম নাসির আমাদের একা করে, আমার মাকে জীবনের কঠিন বাস্তবের মধ্যে রেখে চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। আর রেখে গেছেন তার কর্মের অনুপ্রেরণা আমাদের মধ্যে, যা তার অনুপস্থিতিতেও আমাদের সর্বদা ধ্রুবতারার মতোই পথপ্রদর্শন করছে।

যিনি নাসির সাংবাদিক নামে সর্বমহলে পরিচিত, তিনি আমার আব্বা। তিনি ১৯৬৭ সালে এসএসসি, ১৯৬৯ সালে বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। বিএম কলেজে পড়াকালীন ছাত্র সংসদে মিলনায়তন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে বি.কম পাস করেন এবং পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে এম.এ করেন।

দুকলম লেখনীর দ্বারা অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে নাসির সাংবাদিকের বিস্তৃত কর্মপরিধি ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ তার প্রগতিশীল মনন ও পরোপকারিতা ছিল আকাশের মতই উদার।
তিনি দীর্ঘদিন বোরহানউদ্দিন প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা ভোলা জেলার সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন। বোরহানউদ্দিন থানা মুক্তিযোদ্ধা কমিটিতে ছিলেন। থানা ক্রীড়া কমিটির যুগ্ম সস্পাদক ছিলেন, ছিলেন জেলা ক্রীড়া কমিটিতেও। তিনি এতটাই ক্রীড়া উদ্যোগী ছিলেন যে, তখন সাদাকালো টিভির যুগে বোরহানগঞ্জ এলাকার মানুষের খেলা দেখার ব্যবস্থা করতেন। সেই ছোটবেলায় আব্বার হাত ধরে পরিচিত হয়েছি ফুটবল, ক্রিকেট, দাবা, ক্যারাম, ব্যাডমিন্টন খেলার সাথে। শিক্ষানুরাগী নাসির সাংবাদিক ছিলেন বোরহানগঞ্জ হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে, এছাড়াও বোরহানউদ্দিন হাইস্কুলসহ অনেকগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। সমাজসেবক হিসেবে বোরহানগঞ্জ বাজার কমিটির সহসভাপতি দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। মাঝরাতে এসেও মানুষ হাজির হতেন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আর তিনি ছুটে যেতেন নিরীহ মানুষকে সাহায্য করতে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। এগুলো করতে গিয়ে তিনি বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখিও অনেক হয়েছেন, এমনকি স্বজনদের কাছ থেকেও। তবুও তিনি পিছু হটেননি কখনো। আসলে ওই সময়ে আব্বার বিস্তৃত কর্মপরিধি ও প্রগতিশীল মনন বোঝার সাধ্য অনেকেরই ছিল না।
পরোপকারী নাসির সাংবাদিক নিজের সম্পত্তি বিক্রি করে জনসেবামূলক কাজ করে বেড়াতেন। অসামর্থ্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের বই কিনে দেয়া, পরীক্ষার ফিস দেয়া, বিভিন্ন ক্রীড়া সামগ্রী কিনে দেয়া, বিনামূল্যে অনেককে পড়ানো এগুলো ছিলো তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। তিনি খাবার, চলাফেরা ও পোষাক-পরিচ্ছদেও ছিলেন অত্যন্ত রুচিশীল।

আব্বার মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক ওমর ফারুক তারেক লিখেছিলেন- তার মনে হয়েছিল, আব্বা তাঁর তিন মেয়ের উজ্জল ভবিষৎ গড়ে তোলার ব্যাপারে সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। তিন মেধাবী কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা ছিলেন তিনি। ফারুক কাকা ২০ বছর আগে বোরহানউদ্দিন সাহিত্য একাডেমির মুখপত্র ‘উৎস’তে ‘প্রিয়জন গোলাম নাসির’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধে এসব তথ্য উল্লেখ করেছেন।
আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে তখন থেকেই আমাদের বোরহানগঞ্জ বাজারস্থ বাসায় রেখে আব্বা আমাদের পড়ালেখায় নজরদারী শুরু করেন। তিনি আমাদেরকে মেয়ে নয়, সন্তান হিসেবে দেখতেন। উৎসাহ দিতেন, স্বপ্ন দেখাতেন বড় হবার। আব্বা পারিবারিকভাবে অনেক ঠকেছেন, এছাড়া সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সম্পত্তির লোভ লালসা করেননি, ধ্যান ছিলো তার সম্পদ তিন মেয়েকে মানুষ করার। সবসময় বলতেন- পরিবারের কোনো ছেলে থেকে আমরা যেন পিছিয়ে না থাকি। আল্লাহর অশেষ রহমতে আব্বার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
সাংবাদিক হিসেবে নিয়মিত একাধিক সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস ছিল আব্বার, সেই সাথে আমাদেরকেও অভ্যাস করিয়েছিলেন। আমরা তিন বোনই আবৃত্তি ও বক্তৃতায় ভালো ছিলাম। মফস্বল শহরের ছোট্ট একটি এলাকা থেকে বিভাগ পর্যন্ত আমাদেরকে নিয়ে প্রতিযোগিতায় ছুটতেন তিনি। তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না, তারপরও মেয়েদের মেধা ও প্রতিভা বিকাশে তার দৃঢ় প্রচেষ্টা ছিল।

১৯৯৪ সালে আব্বা ৪৪ বছর বয়সে ১ম স্ট্রোক করেন এবং বাঁ পায়ে সমস্যা হয়। তখন থেকেই ডায়াবেটিসে ভূগছিলেন। ঢাকায় কিছুদিন চিকিৎসার পর মোটামুটি সুস্থ হয়ে পায়ে কিছুটা সমস্যা নিয়েও আবার কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ২য় বার স্ট্রোকের পর পুরোপুরি প্যারালাইসড হয়ে পড়েন। তখন আমরা তিন বোনই শিক্ষার্থী, আম্মা মোটামুটি সরকারি চাকুরী দিয়ে আমাদের দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আম্মা জোড় করার পরেও আব্বা জমিজমা বিক্রি করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত যাননি মেয়েদের ভবিষ্যৎ ভেবে। সামর্থবান স্বজনরা এগিয়ে না এসে এড়িয়ে চলতেন। কেহবা আমাদের সম্পদ ভোগ করেও করুণার মনোভাব দেখাতেন। আমার পরোপকারী, মাথা উচু করে বাঁচা বাবা স্বজনদের কাছ থেকে কিছু আশাও করেননি। বরং প্রতিনিয়ত বিদ্রুপের শিকার হয়েছেন মেয়েদের উচ্চশিক্ষা ও স্বাধীনতা নিয়ে। তারপরও এই বিষয়ে তিনি ছিলেন অনড়। আর আম্মা জীবনের কঠিন সংগ্রামে কখনো শ্বশুড়বাড়ি আবার কখনোবা বাপের বাড়ির নির্মমতার শিকার হয়েছেন। ন্যায্য অধিকারটুকু থেকেও অনেক বঞ্চিত হয়েছেন।

আব্বার মৃত্যুর পর সেদিন জানাজায় এত মানুষের ঢল ছিল যে, বোরহানগঞ্জ বাজারে তিল পরিমাণ জায়গা ছিল না, অসংখ্য মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা নিয়ে চলে গেলেন আমার আব্বা। এরপর স্বজনদের সহযোগিতা ছাড়াই আম্মার কঠোর পরিশ্রম, সাহসী মনোবল আর আব্বার ইচ্ছা পূরণে আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজ আমরা তিন বোন প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে আমি বরিশালে ও ছোট বোন লুবনা ঢাকায় শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত এবং মেজ বোন রুনা অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার হিসেবে বরিশাল মেট্রোপলিটনে কর্মরত।

তবে চলার পথে অসংখ্য মানুষের অনুপ্রেরণা, দোয়া, স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি, যারা বিভিন্নভাবে আব্বার কাছের লোক ছিলেন। যেখানেই ঠেকেছি, নাসির সাংবাদিকের মেয়ে পরিচয় দিতেই সবকাজ যেন সহজ হয়ে যেত। বুঝেছি আব্বার জীবনের কর্মফল বৃথা যায়নি, আজও আড়াল থেকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন। তবে আজ আমাদের চারপাশে আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাঙ্খীদের কোনো অভাব নেই।
আব্বা বুঝিয়ে দিলেন লোভ-লালসা, সম্পত্তি বড় নয়, মৃত্যুর পর কর্মের মাধ্যমেই বেঁচে থাকা যায়। নিজের একটা সম্মানজনক পরিচয় থাকা সত্বেও আমি নিজেকে নাসির সাংবাদিকের মেয়ে পরিচয়ে চলতে বড্ড ভালোবাসি।

আব্বার কাছ থেকে শিখেছি কেউ ঠকালে, আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হয়, আর নিজের জন্য নয় সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হয়। আর নিজের জীবনের মাধ্যমে শিখিয়ে গেলেন সম্পত্তি নয়, সন্তানের দিকে বেশি মনোযোগী হতে হয়। আব্বা আপনি জান্নাতে থেকে দোয়া করবেন, আল্লাহর রহমতে আমরাও যেন আমাদের সন্তানদের ভাল মানুষ করতে পারি।
হে পরম করুণাময় রাব্বুল আলামিন আল্লাহ, আব্বাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আর আমার আম্মাকে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন, যিনি তার নিরলস পরিশ্রম দ্বারা মরহুম নাসির সাংবাদিকের স্বপ্নগুলি সত্যি করেছেন।
.
হাসনাহেনা
মরহুম সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে.এম গোলাম নাসিরের বড় কন্যা।

Next Barisal banner ads

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *