আবদুর রহমান সালেহ
এক
থানা সংলগ্ন বিকাশ-ফ্লেক্সিলোডের ব্যস্ততম দোকান। অগণিত মানুষের ভীড় ঠেলে জীর্ণ-শীর্ণ এক বৃদ্ধার কণ্ঠে আকুতি। ‘আমারে এট্টু যাইতে দ্যান’। বৃদ্ধাকে বিকাশের দোকানদারের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ দেয় পাশে দাঁড়ানো লোকজন।
জীর্ণ কাপড়ের মধ্যে গচ্ছিত রাখা থলে বের করে দোকানদারের কাছে দিতেই দোকানদার বুঝে ফেলে। হাতের মুঠোফোনে অন্য গ্রাহকদের নাম্বার প্রেস করতে করতে আনমনে বলে- ‘আইজ কত কামাইলেন নানী?’ বৃদ্ধাও ক্লান্ত শরীরে জানালো- কত আর অইবে বাবজান, অই দুই-তিনশ অইতে পারে, গুইনা দ্যাহো’। এবার সরাসরি বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধার থলে থেকে টাকা বের করতে করতে বললো- আজ তো দ্যাহি ম্যালা টাকা কামাইয়া ফালাইছেন নানী, আইজ তো আফনের ঈদ।
‘আর ঈদ’ বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বৃদ্ধা। বলেই টাকাগুলো পাঠাতে বললেন। দোকানদার জানে কার নাম্বারে টাকা পাঠাতে হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই বৃদ্ধা তাঁর দোকানে আসে। দোকানদারও যথারীতি বৃদ্ধার থলে থেকে টাকা গুণে গুণে প্রতিদিন টাকা পাঠায়। কোনোদিন ২০০ আবার কোনো কোনোদিন ৫০০ টাকার মতও পাঠায়। যেদিন মানুষের মন ভালো থাকে, সেদিন বৃদ্ধার থলেতে কিছু টাকাকড়ি বেশিই পড়ে। ক্লান্ত দেহে বেশিক্ষণ হাঁটাচলা করতে পারে না বলে অন্য ভিক্ষুকদের থেকে তার আয় কিছুটা কম। তা না হলে ৬০০-৭০০ টাকা আয় করা যেত।
দুই
মফস্বলের ব্যস্ত সড়কের পাশে জরাজীর্ণ কিছু কাপড় টানিয়ে কোনোরকমে রাত কাটানো এক বৃদ্ধাকে ঘিরে কৌতূহলী মানুষদের ভীড়। একেকজন একেক কথা বলছেন। কেউ বলছেন ‘হয়তো শরীর ক্লান্ত, তাই শুয়ে আছেন’। কেউবা বলছেন বৃদ্ধা হয়তো আর বেঁচে নেই। তা না হলে এতবেলা অবধি ঘুমিয়ে থাকার কথা না। মহামারীর কারণে মানুষজন কাছে ঘেঁষতেও ভয় পাচ্ছে। দীর্ঘদিন একই স্থানে থাকার কারণে অনেকেরই মায়া তৈরি হয়ে গেছে বৃদ্ধার প্রতি। যে কারণে কাছাকাছি থাকা লোকগুলো বৃদ্ধাকে ফেলে চলেও যেতে পারছে না আবার কাছেও যাচ্ছে না। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে ভীড় ঠেলে একজন কাছে গিয়ে বৃদ্ধার শ্বাস চেক করলেন। বিকাশ- ফ্লেক্সিলোডের সেই দোকানদার। বৃদ্ধার সাথে যার দীর্ঘদিনের চেনাজানা। এই ব্যস্ত শহরে একমাত্র দোকানদারের সাথেই বৃদ্ধার দিনে একবার কথা এবং সাক্ষাৎ হতো। বৃদ্ধার মনের সুখ-দুঃখের খবর কেবল এই দোকানদারই জানতেন। আর জানতেন থানার একজন এসআই। এই দু’জন ছাড়া বৃদ্ধার আপন মানুষ বলতে ভিন্ন কেউ নেই।
রক্তের নানী না হলেও অনেকটা দুঃখভরা মন নিয়ে দোকানদার জানালেন, নানী আর দুনিয়ায় নেই। বলেই কেমন যেনো নিজের নানী হারানোর মত করে ডুকরে কেঁদে উঠলো। দোকানদারের কান্না দেখে উপস্থিত কারো কারো চোখে পানির সামান্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অবহেলায় পড়ে থাকা এই বৃদ্ধা মহিলার প্রতিও অনেকের মায়া তৈরি হয়ে গেছে মনের অজান্তেই।
তিন
মৃত বৃদ্ধার নাতি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বৃদ্ধা ভিক্ষা করে প্রতিদিন তার নাতির কাছেই টাকা পাঠাতো। একমাত্র দোকানদারই এই ঘটনা জানতো। কল দিয়ে বৃদ্ধার নাতিকে ঘটনা জানাতেই নাতি বৃদ্ধার কাছে আসতে অস্বীকৃতি জানালো। বললো- আপনারা উদ্যোগ নিয়ে দাফন করে ফেলেন। আমার আসার সময় হবে না।
দোকানদার বৃদ্ধার নাতীর কথা শুনে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলো। কোনো ভাবনারই কূল কিনারা করতে না পেরে বৃদ্ধা যেভাবে প্রতিদিন ভিক্ষার থলের টাকা গুণে জানালে বৃদ্ধা যেভাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তো- দোকানদারের মুখ থেকেও তেমন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেলো। দুনিয়ার হালচাল দেখে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ব্যতীত এই মুহূর্তে দোকানদারের কিছুই করার নেই। এলাকার মানুষদের নিয়ে দাফনের কাজটা তাকেই করতে হবে ভেবে বৃদ্ধার কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। কিছুটা হাঁটতেই থানার সেই এসআইয়ের সাথে দেখা। এসআইও ইতোমধ্যে ঘটনা শুনেছে। দোকানদারের কাছে জানতে চাইলো যে- বৃদ্ধার নাতীর কাছে সংবাদ পৌঁছানো হয়েছে কিনা? এসআইও বিষয়টি জানতো। দোকানদার যথারীতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালো- জানাইছি। কিন্তু জানাইয়া লাভ হয় নাই। নাতী আসতে পারবে না। সে ব্যস্ত। আমাদেরকেই দাফন করতে বলতাছে।
সারাদিন মানুষ নিয়েই কাজ করতে হয় পুলিশ সদস্যদের। এসআই ব্যাপারটা খুব সহজেই বুঝে ফেললেন। দোকানদারকে জানালেন- তার নাম্বারটা দিন তো। আমি একটু কথা বলি। দোকানদার এসআইকে নাম্বার দিলো। এসআই কৌশলী ভূমিকা নিলেন।
এসআই কল দিয়ে তার নাতীকে বললো- দেখুন, আপনার নানী দীর্ঘদিন এখানে ভিক্ষাবৃত্তি করতো। প্রতিদিন কিছু টাকা আপনাকে পাঠাতো এবং কিছু টাকা আমার কাছে রেখে দিতো। বলতো যে কখন কাজে লাগে তার ঠিক নাই। জমাতে জমাতে এখন প্রায় ৩০ হাজার টাকার মত হয়ে গেছে। এখন এই টাকার কি করবো? কার কাছে দিব? বৃদ্ধার নাতী বেশ ব্যস্ততা নিয়ে বললো- আমি আসতেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আসতেছি। আমি তার নাতী। আমার নানী হয়। আপনারা অপেক্ষা করেন। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসতেছি…।
আবদুর রহমান সালেহ, নেট মিডিয়া, সদর রোড,, আমতলী, বরগুনা-৮৭১০। মুঠোফোন: ০১৭৮৯১৫৯৯০৫