জলবায়ু পরিবর্তনে জেলেদের দুর্ভোগ

নুরুল আমিন।।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে জেলেদের জীবন-জীবিকার ওপর। জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে। বাড়ছে দুর্ভোগ। তারা খুব অসহায় হয়ে পড়ছে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে যাদের অবদান অবিস্মরণীয়, সেই জেলেরা জলবায়ুর পরিবর্তনে ঋণগ্রস্ত হচ্ছে, অর্ধাহারে-অনাহারে দিনযাপন করছে, বেঁচে থাকার জন্য ভিন্ন পথ খুঁজছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর পড়ছে। কারও জীবন নিরাপদ নয়। তবে জেলেরা সবচেয়ে বেশি জীবন ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
জেলেদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে মাছ ধরে বিক্রি করা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়ছে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তান্ডব, বাড়ছে জোয়ারের তীব্রতা ও নদী ভাঙন, কমে যাচ্ছে মাছ। এছাড়াও নানামুখী সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যার কারণে বহু জেলে এ পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু অন্য পেশা তাদের জন্য সুখকর নয়। কারণ বিকল্প পেশা সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। নদীর তীরে বসবাস করতে গিয়ে নদীর সঙ্গে তাদের জীবনের একটা অন্যরকম সখ্যতা গড়ে ওঠেছে। তাই তারা প্রকৃতির বিরূপতা, ডাকাতের ভয় ও দাদনদারের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছের আশায় নদীর তীরে থাকে আর নদীর বুকে নৌকা ভাসায়।
একটা প্রবাদ আছে এরকম, ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ।’ আর এরকম বাঘের থাবার মধ্যেই আতংক ও দুর্ভোগে কাটে জেলেদের জীবন।

জেলেরা নদীতে গেলে তুফান ও ডাকাতের ভয়। আর তীরে এলে দাদনদার ও সুদখোরদের ভয়। সারা জীবন কষ্ট করে জেলেরা কোন সম্পদ গড়তে পারে না। অথচ জেলেদের ঘাড়ে ভর অনেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়। জেলেদের জন্য সরকার যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়, তার সুষম বন্টন হয় না এবং জেলেরা তা পায় না। বেশিরভাগ সুবিধা চলে যায়, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পছন্দের লোকদের মাঝে। আবার ঘটনা এরকমও ঘটে, জেলেদের জন্য বরাদ্দের পুরোটাই চেয়ারম্যান সহ সংশ্লিষ্টদের পেটে চলে যায়। জেলে তালিকা প্রণয়নে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে প্রকৃত জেলেরা সুবিধা বঞ্চিত হয়। তারা জীবনভর কষ্টের বোঝা বহন করে যায়। নদীর ভাঙাগড়ার মতোই জেলেদের জীবন। তবু্ও তারা নদীকে ভালবাসে এবং নদীর পাড়ে থাকে।
দাঁড়-বৈঠার সঙ্গে মাঝি-মাল্লার জীবনের নিবিড় সখ্যতা তিলে তিলে গড়ে ওঠে। দুঃখে ভরা জীবনে নদীর বুকে ঢেউয়ের তালে তালে মাঝি-মাল্লার কণ্ঠে দোলে ভাটিয়ালি সুরের ঝংকার। তাদের মনের মাধুরীতে মিশে আছে গান। তারা দুঃখ-কষ্ট ভুলে মনের সুখে গান গেয়ে জীবনের সাধ মেটায়। এই ভাটিয়ালি গান বাংলার এক অমূল্য সম্পদ। অথচ জলবায়ুর পরিবর্তনে তাদের জীবন ওলট-পালট হয়ে পড়েছে। তাদের কণ্ঠ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গান। দুঃখ গাথা জীবন যেন হয়ে ওঠে বিষাদময়। শতকোটি কষ্টের আঘাত সহ্য করে যে জেলেরা নদীকে ঘিরে সুখের স্বপ্ন দেখে, সেই নদীতে মাছ না থাকায় জেলেদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর হতাশার যেন শেষ নেই।
জলবায়ু অনুকূলে থাকার কারণে অদূর অতীতে আমাদের জলাশয়গুলো মাছে ভরপুর ছিল। সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও সহজপ্রাপ্য মাছ আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ মাছ থেকে পাওয়া যায়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৬ -এর তথ্য মতে, ‘দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৩.৬৫ শতাংশ, মোট কৃষিজ আয়ের ২৩.৮১ শতাংশ মৎস্য উপখাত থেকে আসে।’ বাংলাদেশের মাছের বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। বিশ্বে আমরা মাছে ভাতে-বাঙালি জাতি হিসেবে পরিচিত। আমাদের দেশে ৪৫.৭৫ লাখ হেক্টর নদী, সাগর, খাল, হাওর ও জলাশয় রয়েছে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এসব প্রাকৃতিক জলাশয়ের নাব্যতা ঠিক রাখতে, দখলমুক্ত রাখতে ও খনন করতে এদিকে নজর দেয়া উচিত। অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, ‘দেশের প্রায় ১ কোটি ৮২ লাখ লোক জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য উপখাতের ওপর নির্ভরশীল।’ আমাদের জীবন-জীবিকা ও দেশের অর্থনীতিতে মৎস্য খাত তথা জেলেদের অবদান অবিস্মরণীয়।
জীবনবাজি রেখে মৎস্য আহরণ করে আমাদের জেলেরা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে যাতে তারা টিকে থাকতে পারে, সেজন্য জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি যাতে মাছের আবাসস্থল ধ্বংস বা সংকুচিত না হয় ও প্রজনন সুবিধা বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদীর পানি বেড়ে জলোচ্ছ্বাসে উপকূল প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও নদীতে ড্রেজিং করে নাব্যতা বজায় রাখা সময়ের দাবি। জেলেরা প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের মধ্যে সময় পার করে। ভবিষ্যতে বড় সংকটে পড়ার আশংকা তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের মন্দ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার ও টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জনে জেলেদের সহযোগিতা করতে হবে। দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের সবাই এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। এতে জেলেদের জীবন সুন্দর হবে। তাদের জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন হবে। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

নুরুল আমিন, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। লালমোহন, ভোলা। [email protected]. 01759648626.

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *