মুক্তবুলি প্রতিবেদক।।
নববর্ষ । বছরের প্রথম দিন । নতুন স্বপ্নের শুরু। অতীতের ভুল, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব ভুলে নতুন স্বপ্নে বিভোর হয় হয় বছরে এই দিনে। স্নপ্ন দেখে নতুনের। নতুন সম্ভাবনার। অতীতের দুঃখ-গ্লানি ধুয়ে-মুছে নতুনভাবে জীবন শুরু করার স্বপ্ন রচনা করেন সবাই। তবে বছরের এই প্রথম দিনটি উদযাপনের রীতি কিন্তু সেই প্রাচীন সভ্যতা থেকে। রয়েছে উদযাপনের ভিন্নতা । পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা ১ জানুয়ারি Happy New Year ডে, আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই হিজরি নববর্ষ, অন্যদিকে বাঙালিরা বাংলা নববর্ষ “পহেলা বৈশাখ” পালন করছে। আজকে আমরা জানবো দেশে দেশে যেভাবে পালিত হয় নববর্ষ।
ভারতীয় উপমহাদেশ- বাংলা নববর্ষ ও দীপাবলী
বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল আর ভারতে ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশের নানা স্থানে সারা বৈশাখ মাস ধরে বিশেষ করে পয়লা বৈশাখে মেলা বসে। স্থানীয় লোকেরাই এসব মেলার আয়োজন করে থাকে। গ্রামগঞ্জে বৈশাখের আমেজ খানিকটা লোপ পেলেও শহরে এটি এখন বেশ জনপ্রিয়। আবৃত্তি, আলোচনা, যাত্রা, পালাগান, বাউল, কীর্তন, শহরের পান্তা-ইলিশ ভোজের দৃশ্যে বর্ষবরণ এখন জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে পড়েছে। গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজার, ঢাকার রমনা বটমূল, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকাসহ সারাদেশের গ্রাম-শহরে আবালবৃদ্ধবনিতা এই দিনে সকাল থেকে মেতে ওঠে নাচ-গান, কবিতা, নাটক, হা-ডু-ডু খেলা, গ্রাম্য মেলা, নাগরদোলা ও ঘুড়ি উড়ানো ও হালখাতা উৎসবে। নতুন সাজে, পোশাকে উৎসবে মেতে ওঠে সবাই।
ভারতে বর্ষবরণ উৎসবকে দীপাবলী উৎসব বলে অভিহিত করে। দীপাবলী অর্থ আলোর উৎসব। ভারতসহ বিশ্বজুড়ে থাকা শিখ, হিন্দু ও জৈনরা দীপাবলী উদযাপন করে থাকে। হিন্দু নববর্ষের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দীপাবলী উদযাপন করা হয়ে থাকে। হিন্দু লুনার বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের কোনও দিনে দীপাবলী হয়ে থাকে। পাঞ্জাবে নববর্ষ উৎসব পরিচিত বৈশাখী নামে। নববর্ষে পুষ্পসরা প্রায় সর্বভারতীয় রেওয়াজ। দক্ষিণ ভারতের অঞ্চলবিশেষের মজাদার খাবার ও পুষ্পাহার গুরুত্বপূর্ণ প্রথা।
গ্রেগোরিয়ান নববর্ষ
রোমান ক্যালেন্ডারে নতুন বছর শুরু হতো ১ মার্চ থেকে। ল্যাটিন ভাষায় সেপ্টেম্বরের অর্থ সাত, অক্টোবর আট, নভেম্বর নয় এবং ডিসেম্বর দশ। সে সময় রোমান সরকারের নতুন অধিবেশন শুরু হতো জানুয়ারি মাস থেকে। জুলিয়াস সিজার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭ সালে এ ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন করে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি করেন। এতে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সালে মার্ক অ্যান্টোনির কনসুল এক দফা পরিবর্তন করার পর খ্রিষ্টপূর্ব ৮ সালে এম্পরর অপাসটাস সিজার আরেক দফা পরিবর্তন করেন। সর্বশেষ পোপ ১৩তম গ্রেগোরি ১৫৮২ সালে এই ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন করে বর্তমান কাঠামোতে নিয়ে আসেন। এই পরিবর্তিত ক্যালেন্ডারে নতুন বর্ষের শুরু হয় ১ জানুয়ারি। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনটি মধ্যযুগে ধর্মীয় দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
চীনের “চুন জি”
চীনের নববর্ষ উৎসব চলে ১ মাসব্যাপী। ফেব্রুয়ারিতে চীনের চান্দ্র নববর্ষ। এই উৎসবকে বলা হয় “চুন জি” ইংরেজিতে স্পিং ফোস্টভ্যাল বা স্পিং ফেস্ট। চীনের মহাপ্রাচীরের একটি অংশে এই দিন বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পর্যটকদের জন্য থাকে বিশেষ প্যাকেজ। লাল পোশাক, লাল সন্ধ্যা বাতিতে নতুন সাজে সেজে ওঠে চীনের জনজীবন “ওসেইল” নামক বিশেষ ভোজনের আয়োজন করা হয় এই দিনে। ১ মাসব্যাপী আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের মধ্যে সপ্তম দিনটি পালিত হয় “শস্য দিবস” নামে।
মেসোপটেমিয়া ও ব্যাবিলন
বসন্তের বৃষ্টি শুরু হলেই মেসোপটেমিয়ানরা প্রাচীনকালে তাদের নববর্ষের উৎসব উদযাপন করতেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, দেবতা মার্ডাক এই সময়েই আসন্ন বছরের ভালোমন্দের দিক নির্ধারণ করে থাকেন। আকিতু নামক ধর্মীয় উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করতো প্রাচীন ব্যাবিলনের মানুষেরা। আকিতু শব্দটি এসেছে বার্লি বা যবের সুমেরীয় নাম থেকে। ব্যাবিলনে তখন নববর্ষ উদযাপন করা হতো ১১ দিন ধরে। প্রতিদিনই ভিন্ন ভিন্ন রীতির উৎসব পালন করা হতো। নববর্ষের পাশাপাশি আতিকুকে অশুভ সমুদ্র দেবী তিয়ামাতের বিরুদ্ধে ব্যাবিলনীয় আকাশ দেবতা মার্ডুকের পৌরাণিক বিজয় হিসেবেও উদযাপনের সংস্কৃতি ছিল। এর নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। ওই সময়ে নতুন রাজাকে মুকুট পরানো হতো কিংবা বিদ্যমান শাসকের কথিত দৈব আদেশের প্রতিকী নবায়ন হতো।
আলেকজান্দ্রীয় বর্ষপঞ্জি- প্রাচীন মিসর
প্রাচীন মিসরে প্রচলিত ছিল “কোপটিক” বা আলেকজান্দ্রীয় বর্ষপঞ্জি। তাতে ছিল ৩০ দিন সম্বলিত ১২ মাস, সঙ্গে ৫ দিনের ছোট এক মাস (সর্বমোট ৩৬৫ দিন) তৃতীয় সময় (খৃস্টপূর্ব ২৩৮) তার সংস্কার হয়। নববর্ষের দিন মিসরীয়রা পালন করতো Niyaronon (নদীর উৎসব)। এটা থেকেই এসেছে ইরানের নববর্ষের ‘‘নওরোজ” উৎসব। প্রাচীনকালে মিসরীয়রা নীলনদের ধারে দাঁড়িয়ে খুঁজে বেড়াতেন বিশেষ একটি নক্ষত্র। শীতের রাতে সেই নক্ষত্রের আভা নজরে পড়লে কারো আনন্দের সীমা থাকত না। তাদের বিশ্বাস ছিল, আকাশে এ নক্ষত্র দেখা মানেই নীলনদে প্লাবন ডাকবে। শুরু হবে নতুন বর্ষ। প্লাবিত জমিতে ফলবে সোনার ফসল। তাদের সারা বছরের প্রথম দিনটিতে ফসল ফলানোর উদাত্ত ডাক থাকত।
প্রাচীন রোম
প্রাচীন রোমানরা নববর্ষের উৎসব শুরু করতেন বিশেষ গাছের শাখা বিনিময়ের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে তাদের এই বৃ-শাখা বিনিময়ের প্রথাটিতে নতুনত্ব আসে। একটি বাদামকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে অথবা বিভিন্ন ধরনের নকশাকাটা ছবিযুক্ত মুদ্রা আদান-প্রদান আরম্ভ হয়। এ মুদ্রায় দেবতা জানুর ছবি থাকত। জানুর নামেই জানুয়ারি মাসের নামকরণ করা হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে জানুয়ারিকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা সমগ্র বিশ্বের মানুষই দিন ও মাসের হিসাব রাখতে ব্যবহার করে থাকেন। রোমান সম্রাট নুমা পমিপিলিয়াস জানুয়ারি ও ফেব্র“য়ারিকে তাদের দশ মাসের রোমান ক্যালেন্ডারের সাথে যুক্ত করেন। ঘটনাটি ঘটে ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। এরপর রোমানরা জানুয়ারিকেই বছরের প্রথম মাস বলে গ্রহণ করেন।
রোমান ক্যালেন্ডারে নতুন বর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ থেকে। এর প্রভাব বছরের কয়েকটা মাসের ওপর দেখা যায়। জুলিয়াস সিজার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭ সালে এ ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন ঘটিয়ে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি করেন। এতে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সালে মার্ক অ্যানটোনির কনসুল এক দফা পরিবর্তন ঘটানোর পর খ্রিষ্টপূর্ব ৮ সালে এম্পেরর অগাসটাস সিজার আরেক দফা পরিবর্তন ঘটান। সর্বশেষ পোপ ১৩তম গ্রেগোরি ১৫৮২ সালে এই ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন ঘটিয়ে এর বর্তমান কাঠামোতে নিয়ে আসেন। এই পরিবর্তিত ক্যালেন্ডারে নতুন বর্ষের শুরু হয় ১ জানুয়ারি। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনটি মধ্যযুগে ধর্মীয় দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে পশ্চিমা সভ্যতার সম্প্রসারণের কারণে এখন ১ জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাপী নববর্ষ পালন করা যায়।