নোবেল জয়ী দুই সাংবাদিকের লড়াই

আহমেদ বায়েজীদ

সাংবাদিকতা করে নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার ঘটনা ইতিহাসে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। বহুদিন পর২০২১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছেন দুই সাংবাদিক। ফিলিপাইনের মারিয়া রেসা ও রাশিয়ার দিমিত্র মুরাতভ। নোবেল কমিটি তাদের আখ্যায়িত করেছে এই আদর্শের জন্য সংগ্রামরত সব সাংবাদিকের প্রতিনিধি হিসেবে। দুটি দেশেই শাসক শ্রেণি গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করছে; কিন্তু তার মাঝেও তারা সরকারের রক্তচক্ষুকে ভয় না করে কলম ধরেছেন। করেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা।

মারিয়া রেসার জন্ম ১৯৬৩ সালে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায়। যদিও তার শৈশব কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। জন্মের এক বছর পর তার বাবা মারা যায়। মারিয়াকে রেখে তার মা ভাগ্যান্বেষণে আমেরিকায় পাড়ি জমান।মারিয়ার বয়স যখন ১০ বছর তখন তিনি মায়ের কাছে চলে যান। স্কুলে পড়াশোনার পর নিউজার্সি অঙ্গরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকেইংরেজীতে ডিগ্রি নেন।পাশাপাশি থিয়েটার বিষয়েও পড়াশোনা আছে তার। এরপর শেকড়ের সন্ধানে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৃত্তি নিয়েই মাস্টার্সে ভর্তি হন ফিলিপাইনের একটি বিশ^বিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করেন পিটিভি ফোর নামের সরকারি চ্যানেলে।এরপর যোগ দেন মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএসের ম্যানিলা ব্যুরোর প্রধান হিসেবে। ১৯৯৫ সালে তাকে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা ব্যুরোর প্রধান করে পাঠায় সিএনএন। সেখানে কাজ করেন ২০০৫ সাল পর্যন্ত।সিএনএনে তার কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রশংসা কুড়ায় আন্তর্জাতিক মহলে।বিশেষ করে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক বিষয়ে তার প্রতিবেদনগুলো ওই সময়ে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। পূর্ব এশিয়ায় আল কায়দার কার্যক্রম ও স্থানীয় সংগঠনগুলোর সাথে আলকায়দার সংযোগ নিয়ে তিনি অনেকগুলো প্রতিবেদন করেছেন। ২০০৪ সালে যোগ দেন ফিলিপিনো টিভি চ্যানেল এবিএস-সিবিএনের বার্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে। পাশপাশি সিএনএনের জন্য রিপোর্টিং ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের জন্য কলাম লিখতে থাকেন।

২০১২ সালে আরো তিন নারী সাংবাদিকের সাথে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন র‌্যাপলার নামের একটি অনলাইন মাল্টিমিডিয়া পোর্টাল। শুরু থেকেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে থাকে সেটি। প্রেসিডেন্ট দুর্দার্তের মাদক বিরোধী লড়াই নিয়ে ভিন্নধর্মী সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে র‌্যাপলার। ওই অভিযানে অনেক মাদক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। র‌্যাপলার এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরতে থাকে। তাছাড়া অনলাইনে সরকার সমর্থকদের প্রোপাগাণ্ড ছড়ানোর বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তারা। এসব কারণে সরকারের রোষানলে পড়তে হয় মারিয়া রেসাকে। ২০১৮ সালে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় সাইবারক্রাইম আইনে। শুধু সরকারই নয়, সরকারপন্থী সাংবাদিকরাও তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে।ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তে সব সময়ই র‌্যাপলারকে ‘ফেক নিউজ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

মুক্তমতে পক্ষে এই অবস্থানের জন্য ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাকে বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনোনীত করে। পরের বছর টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের তালিকায়ও স্থান হয় মারিয়া রেসার। আর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ের মাধ্যমে পেলেন সাহসী সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি।

দিমিদ্রি মুরাতভের জন্ম ১৯৬১ সালে রাশিয়ার সামারা নগরীতে। বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই সাংবাদিকতার ঝোঁক তৈরি হয় এবং স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে খণ্ডকালীন কাজ শুরু করেন। পড়াশোনা শেষ করে যোগ দেন সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে। তবে সাংবাদিকতার নেশায় এক বছর পরই সামরিক বাহিনীর চাকরি ছেড়ে যোগ দেন আরেকটি সংবাদপত্রে। এক বছর পর কসমোলস্কায়া প্রাভদা পত্রিকার যুব বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর নিউজ আর্টিকেল এডিটর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে সেখানে কাজ করেন ১৯৯২ সাল পর্যন্ত।

১৯৯৩ সালে কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে প্রাভদা থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নোভায়া গেজেটা। দুই রুমের অফিস আর দুটি কম্পিউটার নিয়ে যাত্রা শুরু করা পত্রিকাটি শুরুতে কর্মীদের বেতনও দিতে পারেনি। তবে তাদের স্বপ্ন ছিলো নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার উদাহরণ তৈরি করা। তখন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী রুশ রাজনীতিক মিখাইল গর্বাচেভ তার নোবেল প্রাইজমানির একটি অংশ দান করেন পত্রিকাটিকে।

চেচনিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে মুরাতভ যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যান রিপোর্টিং করতে।রুশ বাহিনীর গণহত্যা নিয়ে তার অনেকগুলো অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছাপা হয়েছে নোভায়া গেজেটায়। ১৯৯৫ সালে পত্রিকার এডিটরিয়াল বোর্ডের প্রধান নির্বাচিত হন মুরাতভ। রাশিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি, ভøাদিমির পুতিনের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি নিয়ে অনেকগুলো রিপোর্ট আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গেজেটা পরিচিতি পেয়েছে রাশিয়ার সবচেয়ে অকুতভয় সংবাদমাধ্যম হিসেবে।

তবে এসব করতে গিয়ে পত্রিকাটিকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির ছয় জন সংবাদকর্মী খুন হয়েছেন।তবে তা সত্ত্বেও মুরাতভ দমে যাননি। সাহসী সাংবাদিকতার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড, ২০১০ সালে ফ্রান্স সরকারের কাছ থেকে লিজিওন অব অনার অর্ডার ছাড়াও নেদারল্যান্ডের ফোর ফ্রিডমস অ্যাওয়ার্ড ও আন্তর্জাতিক গোল্ডেন পেন অব ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন এই সাংবাদিক।

আহমেদ বায়েজীদ, সাংবাদিক ও প্রফেশনাল কন্টেন্ট রাইটার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *