পলাশি ট্রাজেডির ২৬৬ তম বার্ষিকী স্মরণে

আযাদ আলাউদ্দীন ও মাহমুদ ইউসুফ

‘পলাশী ! হায় পলাশী ! / এঁকে দিলি তুই জননীর বুকে / কলঙ্ক কালিমা রাশি’-

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

২৩ জুন। ঐতিহাসিক পলাশি দিবস। ২৬৬ বছর পূর্বে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশির আম্রকাননে ইংরেজ ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের মধ্যে এক প্রহসমূলক যুদ্ধ নাটক মঞ্চায়িত হয়। প্রহসনমূলক সে যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাহিনী জয়লাভ করে। আর মুর্শিদাবাদের কলঙ্ক ইতিহাস ধিকৃত মীরজাফর, ঘষেটী বেগম, উঁমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, কৃষ্ণচন্দ্র, জগৎশেঠচক্রের ষড়যন্ত্রে স্বাধীনতার প্রতীক নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও তাঁর বাহিনী পরাজয়বরণ করেন। সেই সাথে বাংলাসহ উপমহাদেশের স্বাধীনতাসূর্য প্রায় দুইশত বছরের জন্য অস্তমিত হয়।

পলাশি ইতিহাস রক্তাক্ত ইতিহাস, ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, পরাধীনতার ইতিহাস, মুসলিম সালতানাতের বিলুপ্তির ইতিহাস, আর্য হিন্দু সম্প্রদায়ের পুণরুত্থানের ইতিহাস, বৃ্টিশদের ভারতবর্ষ দখলের ইতিহাস। পলাশি ট্রাজেডির পটভূমিকায় তিনটি শক্তির উপস্থিতি ছিল। একদিকে ছিল বাংলা মসনদ রক্ষার সিপাহসালার, বাঙালির গৌরব নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং মীর মদন, মোহনলালসহ স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি। বিপরীত দিকে ছিল বাংলার শাসনক্ষমতা লাভের গোপন দূরভিসন্ধি নিয়ে বহুবছর যাবৎ ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়োজিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বৃটিশ বাহিনী। আর একটি গ্রুপ ছিল বিশ্বাসঘাতকদের। রাজনৈতিক যাত্রামঞ্চের ভাঁর মীরজাফরকে কেন্দ্র করে হিন্দু পূজিপতি, ব্যাঙ্কার, মুৎসুদ্দি, প্রশাসনের আমলা ও রাজ মহারাজারা নবাব বিরোধী ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সহযোগিতার ফলেই ইংরেজরা সাহসী হয়ে ওঠেছিল এদেশে আধিপত্য বিস্তারের। সাম্রাজ্যবাদীদের হিংস্র থাবায় সেদিন বাংলার আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। যার কুফল আজও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। আর সুফল ভোগ করছে আধুনিক ইউরোপ ও আমেরিকা।

মুর্শিদাবাদ থেকে ১৫ ক্রোশ দক্ষিণে পলাশির প্রান্তর। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। জগৎশেঠ, মীরজাফরদের সাথে গোপন চুক্তি মোতাবেক ক্লাইভ বাহিনী সেদিন মধ্যরাতে এসে হাজির হয় পলাশির আম্রকাননে। কোম্পানির বাহিনীতে ছিল মাত্র ৯০০ ইউরোপিয় সৈন্য ও ২০০০ দেশিয় সিপাহী। অন্যদিকে নবাব বাহিনীতে ছিল ৫০ হাজার পদাতিক, ১৫ হাজার ঘোড়সওয়ারী বাহিনী ও ৫৩টি কামান। আপাতদৃষ্টিতে নবাব বাহিনী বড় হলেও যুদ্ধের ফলাফল হয় সম্পূর্ণ বিপরীত। যুদ্ধে মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ তাদের অধীনস্থ বাহিনীর প্রধান অংশ নিয়ে পুতুলের মত যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকে। মীর মদন, মোহনলাল সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে লড়াই করে ইংরেজদের মেরুদন্ত ভেঙে দেয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রীদের কুমন্ত্রণায় দুপুরের দিকে যুদ্ধ বন্ধ হলে নবাব বাহিনীর ক্লান্ত সৈনিকদের উপর পিছন দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোম্পানি বাহিনী। নবাব বাহিনী পরাজয় বরণ করলে সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী মুর্শিদাবাদের দিকে গমন করেন নতুন করে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য সংগ্রহের লক্ষ্যে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বিহারের দিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ভগবান গোলার নিকট ধৃত হয়ে মুর্শিদাবাদে নীত হন। ৩ জুলাই মীরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ তাঁকে হত্যা করে। এভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের জীবনাবসান ঘটে। আর এরই সাথে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নির্বাসিত হয়ে বৃটিশদের পিঞ্জরে।

স্বাধীনতা হারিয়ে এদেশের মানুষ একদিনের জন্যও নীরবে বসে থাকেননি। বিভিন্ন সময় ফকির নেতা মজনু শাহ, বালকী শাহ, নিসার আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়ত উল্লাহ, হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে ফুঁসে ওঠে এদেশের জনগণ। ১৮৫৭ সালে আজাদীর জন্য সংঘটিত হয় মহাঅভ্যুত্থান। সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় বৃদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধ জুড়ে চলে কংগ্রেস, মুসলিম লীগের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন অধ্যায়। অবশেষে ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা এদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আমরা প্রথমবারের মত স্বাধীন হলাম। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করি। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সেই মুসলিম শাসনামলের ‘সোনার বাংলা’ ‘বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ’ হওয়ার গৌরব আজও ফিরে পায়নি এ জাতি। ফলে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল ফারাক। ##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *