বাংলা সাহিত্যে নদী

রুকাইয়া সুলতানা মুন ।।

ভৌগলিক অবস্থানগত কারনে বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে মাকড়শার জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য নদ-নদী। নদীর প্রতিশব্দ হল গাঙ বা গাঙ্গ। গাঙ্গ শব্দটি এসেছে গঙ্গা থেকে। সে অর্থে গঙ্গাও নদীর নামবাচক শব্দ। এছাড়াও সাধারণত নদী অর্থ দড়িয়া, স্রোতস্বিনী, তটিনী, কল্লোলিনী ইত্যাদি শব্দ গুলো ব্যবহার করা হয়। সাধারণ অর্থে যে জলপ্রবাহ নাদ বা কলধ্বনি করে প্রবাহিত হয় তাকে নদী বলে।

নদীর গঠনরূপ, পর্যায় প্রকৃতি ও ক্রিয়াকান্ত নিয়তই পরিবর্তনশীল। নদীর জলে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তুলে এঁকেবেঁকে বয়ে চলাতে নারীর চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তাই নদীকে স্ত্রীবাচক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের পরিমার্জিত সংস্করণে নদী প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে- নদ হল নদী শব্দের পুংলিঙ্গ । কপোতাক্ষ, বলেশ্বর , দামোদর , সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্রকে নদ নামে অভিহিত করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন নদীর তীরে গড়ে উঠেছে নানান সভ্যতা। নদীর তীরে জনবসতি গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে যাতায়াতের সুবিধা, সুপেয় পানি, মৎস আহরণ ও চাষাবাদে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের মত গুরুত্বপূর্ণ কারন। আমাদের নদীমাতৃক এই দেশে মানুষের জীবনযাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে নদী।

বঙ্গোপসাগরের কোলে হাজারো নদীর পলিবিধৌত আমাদের এই বাংলাদেশে নদী মিশে আছে অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, দিনযাপন, পেশা এবং কৃষ্টি কালচারের সাথে। এখানে সকলেই প্রতক্ষ নয়তো পরোক্ষভাবে নদীর সাথে জড়িত। সে কারনেই নদী আমাদের সবশ্রেণির মৌলিক সাহিত্যের সাথে যুক্ত। বাংলা সাহিত্যের অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, লোকগাঁথা, কবিতা ও গানে সমানভাবে বিরাজ করছে নদী।

বাংলা সাহিত্য বৃক্ষের প্রধানতম দুটি শাখা হল উপন্যাস ও কবিতা। বহু কথাসাহিত্যিক তাদের রচনায় নদী প্রসঙ্গ টেনেছেন। কিন্তু অনেক উপন্যাস আছে যেগুলো নদীর উপর ভিত্তি করেই নির্মিত। বাংলা সাহিত্যে নদীভিত্তিক উপন্যাস: পদ্মা নদীর মাঝি- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৬)। কোপবতী – প্রমথনাথ বিশী (১৯৪১)। তিতাস একটি নদীর নাম- অদ্বৈত মল্লবর্মণ(১৯৫৬)। কর্ণফুলী – আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৮৬২) । পদ্মার পলিদ্বীপ – আবু ইসহাক (১৯৮৬)। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত – দেবেশ রায় (১৯৮৮)। পদ্মা মেঘনা যমুনা – শামসুদ্দীন আবুল কালাম। ময়ূরাক্ষী – হুমায়ূন আহমেদ (১৯৯০)। গঙ্গা একটি নদীর নাম – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় (২০০১)। পদ্মা উপাখ্যান – সিরাজুল ইসলাম মুনির (২০০৬)। তিস্তা- হারুন পাশা (২০১৭)।

এছাড়া নদীর প্রসঙ্গ এসেছে যেসব উপন্যাসে সেগুলো হলো- সত্যেন সেনের ‘নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে‘ (১৯৭১), সৈয়দ শামসুল হকের ‘নদী কারো নয়‘ (২০১৮), অমিয় ভূষণ মজুমদারের ‘গড় শ্রীখন্ড‘ (১৯৫৭), কাজী আবদুল ওদুদের ‘নদীবক্ষে‘ (১৯১৮), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী‘ (১৯৪০), সরোজ কুমার রায় চৌধুরীর ‘ময়ূরাক্ষী‘ (১৩৪৩বঙ্গাব্দ), নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘উপনিবেশ‘ (১৯৪৪ প্রথম খন্ড),  হুমায়ুন কবিরের ‘নদী ও নারী‘ (১৯৪৫), অমরেন্দ্রনাথ ঘোষের ‘চরকাশেম‘ (১৯৪৯), মনোজ বসুর ‘জল জঙ্গম‘ (১৯৫১), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাসুলী বাকের উপকথা‘ (১৯৪৭), সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা‘ (১৯৫৭), শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সারেং বৌ‘ (১৯৬২), সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘গহীন গাঙ্গ‘ (১৯৮০), শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘সমুদ্র বাসর‘ (১৯৮৬), ঘনশ্যাম চৌধুরীর ‘অবগাহন‘ (২০০০) , সৈয়দ ওয়ালীউল্লার ‘কাঁদো নদী কাঁদো‘ (১৯৬৮), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৌকাডুবি‘ (১৩১৩ বঙ্গাব্দ), শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে‘ (১৩৭৩ বঙ্গাব্দ)।

নদীপারের জীবন সংগ্রাম, শস্যশ্যামল ফসলের মাঠ, বেদে জনগোষ্ঠী,ইলিশ আহরণ, খেয়া পারাপার, বালু উত্তোলন, চর দখল, রথের মেলা, দেবী বিসর্জন, পুন্যস্নান প্রভৃতি বিষয়কে উপজীব্য করে গড়ে উঠেছে এক একটি উপন্যাস।

পদ্মা নদীর মাঝি : নদীর নাম ভিত্তিক প্রথম উপন্যাস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। সংকীর্ণ জেলেপল্লী, জেলেদের সংগ্রামের গল্প, ইলিশের দরদামের হঠকারিতা, রথের মেলা, পূজো, প্রেম, মাদকতা, ময়নার দ্বীপে বসতি স্থাপন, হোসেন মিয়ার দৌরাত্ম্য ইত্যাদি চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসের পরতে পরতে। পদ্মা পারের দরিদ্র জেলে শ্রেণির নিখুঁত প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার নিজস্ব শৈলীগুণ দেখিয়েছেন। উপন্যাসিকের বর্ননায়- ‘দিন কাটিয়া যায়। জীবন অতিবাহিত হয়। ঋতুচক্রে সময় পাক খায়, পদ্মার ভাঙন ধরা তীরে মাটি ধসিতে থাকে, পদ্মার বুকে জল ভেদ করিয়া জাগিয়া উঠে চর, অর্ধ-শতাব্দীর বিস্তীর্ণ চর পদ্মার জলে আবার বিলীন হইয়া যায়। জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে শিশুর ক্রন্দন কোনোদিন বন্ধ হয় না। ক্ষুধাতৃষ্ণার দেবতা, হাসিকান্নার দেবতা, অন্ধকার আত্মার দেবতা, ইহাদের পূজা কোনোদিন সাঙ্গ হয় না। এদিকে গ্রামের ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণতর ভদ্র মানুষগুলি তাহাদের দূরে ঠেলিয়া রাখে, ওদিকে প্রকৃতির কালবৈশাখী তাহাদের ধ্বংস করিতে চায়, বর্ষার জল ঘরে ঢোকে, শীতের আঘাত হাড়ে গিয়া বাজে কনকন। আসে রোগ, আসে শোক। টিকিয়া থাকার নির্মম অনমনীয় প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি কাড়াকাড়ি করিয়া তাহারা হয়রান হয়। জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ণ। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সঙ্কীর্ণতায়। …ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাঁহাদের খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’

পদ্মা নদীর মাঝি, গঙ্গা ও তিতাস একটি নদীর নাম এই তিনটি উপন্যাস সম্পর্কে পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন যে – ‘পদ্মা নদীর মাঝি, গঙ্গা ও তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসত্রয়ে যে মানুষ এসেছে তারা তো নদী অন্বিতই। নদী ছাড়া তাদের অস্তিত্ব নেই, নদী তাদের বাঁচা মরা, তাদের সাফল্য ব্যথর্তা, তাদের জয় পরাজয়ের অনিবার্য পটভূমি। লক্ষণীয় তিনটি উপন্যাসে জেলে মালোর জীবনের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতার স্বপ্নে কৃষিবিশ্ব, চাষীর জীবন উঁকি মেরেছে কিন্তু নদীর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এ জীবন নদীর বাহিরে যেতে পারে না।’

ইছামতি : উপন্যাসের বণর্না এরকম – ‘ইছামতি নদী বর্ষ ার জলে কূলে কূলে ভর্তি। খোকাকে নিয়ে গিয়ে একটা নৌকোর ওপর বসলেন ভবানী। দুই তীরে ঘন সবুজ বনঝোপ, লতা দুলছে জলের ওপর, বাবলার সোনালি ফুল ফুটেছে তীরবর্তী বাবলা গাছের নত শাখায়। ওপার থেকে নীল নীরদমালা ভেসে আসে হলদে বসন্তবৌরি এসে বসে সবুজ বননিকুঞ্জের ও ডাল থেকে ডালে।…” জীবনবাস্তবতার স্থিরচিত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নদীভিত্তিক উপন্যাস ইছামতি প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। ঔপন্যাসিক তার গ্রামকে ,গ্রামের কাশবনকে ,নানা বণের্র ফুল ফলকে এবং গাঁয়ের ওপর দিয়ে বাহিত নদীকে জীবনের সঙ্গে বিনিয়ে উপস্থাপন করেছেন। অন্যান্য নদীভিত্তিক উপন্যাসের মতো এতেও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রৈখিক ও তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে ব্যক্ত হয়েছে। উঠে এসেছে আফগান যুদ্ধ, তিতুমীর, নীল বিদ্রোহ, ছোট লাটের নদী পরিদশর্ন। এসেছে গতিময়তা ও কালচেতনার প্রবাহমান ছবি। ইছামতি খুব বড় নদী নাহলেও বিভূতিভূষণ ইছামতি কে খুব নান্দনিক ভাবে কল্পনা করেছেন। বহু যত্নে তিনি বট ,অশ্বথ ,বাঁশ ঝাড় ,গাঙ শালিকের গতর, লতাগুল্ম ,জীবন সায়াহ্নে চিতার ছাই ,সুন্দরী বধূর পায়ের ছাপ ইত্যাদি জীবনঘনিষ্ঠ উপাদানে সাজিয়েছেন উপন্যাসের প্লট। ইতিহাস জীবন যৌবন সব মাখামাখি করে চঞ্চলাবেগে গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।

তিতাস একটি নদীর নাম – ছিন্নমূল মানুষের জীবনালেখ্য হল অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম‘ (১৯৫৬)। মাঝারি নদী তিতাসের পদ্মা মেঘনার মতন দানবীয় হুংকার নেই। লেখক তিতাস পারের দৈনন্দিন জীবনচিত্র, হাসি কান্না, লোকসাহিত্য, ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে নতুন যুগের সূচনা ধরেছেন চমৎকারভাবে। তিতাস নদীর বর্ননা দিতে গিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন ‘সে সত্যের মত গোপন হইয়াও বাতাসের মত স্পর্শপ্রবন।‘

কর্ণফুলী – আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলী (১৯৬২) উপন্যাসের কাহিনী জুড়ে নদীতীরের মানুষের টানাপোড়েনের চিত্র। লেখকের বর্ননায় সবুজের সমারোহ, সাগর পাহাড়, সাম্পানের ধেয়ে চলা, নদীতীরের মানুষের সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে পাঠকের আগ্রহ তৈরি হলেও তা ঘুরে যায় রোমান্টিকতার দিকে। ধর্মীয় বেড়াজাল টপকে ইসমাইলের চাকমা ধবলি কে বিয়ে করা, তার জীবনে সফল হবার স্বপ্ন, সারেং হবার স্বপ্ন উপন্যাসে যুক্ত করছে অনন্য মাত্রা।

পদ্মার পলিদ্বীপ – আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ‘ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। উপন্যাসটিতে পদ্মা পারের জনজীবন ,শ্রেনী পেশা ,জাতি বর্ন ,কৃষিভিত্তিক ও কৃষি বহির্ভূত পেশা ,হিন্দু মুসলিমের মাছ ধরা এবং গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর সন্ধান মেলে। চর দখল, ভুমি মালিকের চর দখলে দ্বন্দ কলহ ,পুলিশী শাসন, বিরোধ, জগুরুল্লার চরিত্রের আদলে গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষ যারা কুচক্রী মাতব্বরের হাতে নিরুপায় বন্ধী তাদের দৃশ্য ফুটে উঠেছে। নদীর ভাঙনের করুন রূপ আবু ইসহাক তার রচনায় বিবৃত করেছেন এভাবে – ‘চরের বসত আজ আছে কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির ওপর নিভর্র করে চরের আয়ু। তার খুশিতে চর জাগে। তার খেয়ালে ভেঙে যায় আবার। এ যেন পানি আর মাটির চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ,দশ, বিশ বছরের মেয়াদে বুকের ওপর ঠাঁই দেয় পানি। মেয়াদ ফুরালেই আবার ভেঙে-চুরে নিজের জঠরে টেনে নেয়। চরবাসীরা তাই স্থায়ী হয়ে বসতে পারে না কোনোদিন। তাদের বাপ-দাদার ভিটে বলতে কিছু নেই। বাপ-দাদার কবরে চেরাগ জ্বালাবার প্রয়োজন হয় না তাদের কোনো দিন।’ উত্তরাধিকার বাংলা একাডেমি মাসিক পত্রিকা ১৯৮৭-তে প্রকাশিত- ‘পদ্মার পলিদ্বীপে চিত্রিত হয়েছে পদ্মার চরাঞ্চলের জীবন, এই জীবনের সঙ্গে আবু ইসহাক ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত।… তিনি একটি জটিল জীবনের চিত্র এঁকেছেন, এই জটিলতা সূর্যদীঘল বাড়িতে নেই। আবু ইসহাক পল্লীজীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন। পদ্মার পলিদ্বীপে পল্লীজীবনের একটা বিশেষ দিক চরাঞ্চলের সংঘাতময় জীবনের কথা নিয়ে লিখেছেন’।

তিস্তা-  প্রতিবেশী দেশের পানিহিস্যার কবলে তিস্তা পাড়ের বিপর্যস্ত জনজীবন নিয়ে লেখা হারুন পাশার উপন্যাস তিস্তা প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। জলের অভাবে সরু হয়ে ওঠা তিস্তা জীবনকেও খাটো করে দেয়। হঠাৎ জলের মিশেলে ভাঙে ধার নদী আবাদি জমি ঘরবাড়ি কেড়ে নেয়। গৃহহীন মানুষ ভিড় করে উত্তোলিত বালির বুকে খাস জমিতে। সরকারের প্রয়োজনে বোর্ড লাগানো হয়। আশ্রিতরা মাথাগোঁজার যায়গার জন্য হাপিত্যেশ করে। প্রকৃতির প্রতিক‚ লতার সঙ্গে জীবন ছুটছে কচুরিপানার মতো দারিদ্র্যের চাপে কৃষক। গরিবের পড়াশোনা সৎমায়ের সংসার, ভঙ্গুরজীবন কমবয়সে বিবাহ, উপযুক্ত পাত্রের অভাব, সংসারের টান, জমির বিনিময়ে কন্যাসম্প্রদান, পরিবতির্ত সমাজ ফেসবুক, ইমো কল, গোলাপ গ্রামের সাইতুনরের সঙ্গে মিরাজের প্রেম ও গভর্ধারণ, এনজিওর কিস্তি, পানির জন্য আন্দোলন, লংমার্চ, পানিশূন্যতার কারণে অনাবাদি জমি, কৃষকের বেহালদশা, তিস্তার পাড়ের জীবনযাপনের বিপযর্স্ত বহুমাত্রিক সমস্যা ঔপন্যাসিকের মননে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। হারুন পাশার তিস্তার পূবের্র চিত্র বর্ননায়….. আগে নদীতে পানি আছিন। নদীতে ডেউ আছিন। নাউ বাওয়া রিস্ক আছিন। নাউ পাহো পড়লে আর খুঁইজ্জা পাওয়া গেছে না। যা জিনিসপাতি আছিন সবই লইয়া গেছে। পিন্দনের কাপড় লইয়া বাড়িত আইছি। শইল্লো খালি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি আছিন। বতর্মান চিত্র বণর্নায়… ‘এ্যাহন তো নদী নাই। পানি নাই। ইনকাম নাই। বাড়িওয়ালির অসুখ। জয়েন্ডো জয়েন্ডো ব্যথা অষুধ খাওয়াইলে ব্যথা বালা অয়, না খাওয়াইলে আবার শুরু অয়। আতো ট্যাহা নাই, হ্যার লাইগ্গা চিকিৎসার বন্দ রাখছি।

বাংলা কবিতায় নদী

শুধু যে বাংলা কথাসাহিত্যে নদী দাপটে বিরাজ করছে তা কিন্তু নয়। কবি ও কবিতার বুকের জমিনে নদী জায়গা করে নিয়েছে সানন্দে। অসংখ্য বাংলা কবিতায় নদীর উপমায় অলংকৃত হয়েছে পঙতি। তাছাড়া নদীকে ধারণ করেও লেখা হয়েছে বহু কবিতা।

বাংলা সাহিত্যে সনেটের প্রথম আমদানিকারক মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘মেঘনাদবধ‘ কাব্যে নদীর প্রসঙ্গ এসেছে। ‘কপোতাক্ষ নদ‘ কবিতায় কবি তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত নদকে করুনঘন ও ভালোবাসা মিশ্রিত অভিব্যক্তিতে ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে – ‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে, বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ- দলে, কিন্তু এ দেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে? দুগ্ধ স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে!’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যে এত অসংখ্যবার নদী এসেছে যে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের মানসে সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিল নদী। পদ্মার বুকে বোটে চড়ে তিনি লিখেছিলেন অমর কাব্য সোনারতরী। সমাপ্তি গল্পের মৃন্ময়ীকে তিনি খুজে পেয়েছিলেন নদীর পাড়েই। খোকাবাবুসহ তার বহু গল্প, উপন্যাস, গানে এসেছে নদী প্রসঙ্গ। অনেক সমালোচকই রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র কে পদ্মার আখ্যান বলে থাকেন। নদী অনুসঙ্গ নিয়ে তার অনন্য কবিতা- ‘নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস ওপাড়েতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ওপাড় বসি, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; কহে, যাহা সুখ তাহা সকলি ওপাড়ে।”

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আমরা নদীকে নানা বর্ননায় দেখতে পাই। ‘কর্ণফুলী‘ তার নদী বিষয়ক উল্লেখযোগ্য কবিতা। নজরুল তার প্রেমের বিচিত্র অনুভব কর্ণফুলী কবিতার কারুকাজে চিত্রিত করেছেন…. “ওগো কর্ণফুলী! তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি। তোমার স্রোতের উজানে ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে, সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে? আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা কান-ফুল গেল খুলি সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে কি কর্ণফুলী।”

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বিশ্বপ্রকৃতির সাথে নদীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে দারুনভাবে তার কাব্যনুভূতিতে লিখেছেন- ‘গভীর অন্ধকারে ঘুম থেকে নদীর ছলচ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার! তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া লুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম পউসের রাতে কোনদিন আর জাগবো না জেনে’।

প্রিয় কবি আহসান হাবীবের ‘মেঘনা পাড়ের ছেলে‘ বিখ্যাত কবিতায় নদীর কথা এসেছে যেভাবে- ‘আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে, মেঘনা নদীর নেয়ে আমি, মেঘনা পাড়ে বাড়ি। ইচ্ছে হলেই এপাড় থেকে ওপাড়ে দেই পাড়ি। তালে তালে তালের নৌকা দু’হাতে যাই বেয়ে, আমি মেঘনা পাড়ের নেয়ে।”

আল মাহমুদ তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত তিতাস নদীকে নিয়ে লিখেছেন ‘তিতাস‘ শিরোনামে একটি কবিতা।কবিতায় তিতাসের বন্দনায় দরদভরা কিছু পঙতি- ‘আবার দেখেছি সেই ঝিকমিক শরীর তিতাস কী গভীর জলধারা ছড়ালো সে হৃদয়ে আমার। সোনার বৈঠার ঘায়ে পবনের নাও যেন আমি বেয়ে নিয়ে চলি একা অলৌকিক যৌবনের দেশে।’

প্রেমের কবি মহাদেব সাহা ‘এই যে বর্ষার নদী‘ কবিতায় লিখেছেন-

‘দ্যাখো এই বর্ষাকাল, গাঁ-গেরামে ফুঁসে ওঠে নদী, হাঁসেরা নেমেছে জলে আমাকে বিভোর করো যদি,

কীর্তনখোলার বুকে উঠিয়াছে পূর্ণিমার চাঁদ সেখানে পরানসখা- তুমি আমি দুজনে বিবাদী। ##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *