বাংলা সাহিত্যে রবি ও রবীন্দ্রনাথ

অনির্বাণ চক্রবর্তী ।।
“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলির তলে
সকল অহংকার হে আমার তুমি ডুবাও চোখের জলে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন সব অমর সমর্পিত কবিতাকে ঘিরেই রবীন্দ্র ভাবনা, নোবেল বিজয় তথা তিঁনি বিশ্বকবি। কবিগুরুর অধিকাংশ লেখাই পূজা, আত্মোপলব্ধির, উৎসর্গ, সমর্পন ও নিবেদন। তিঁনি তার কবিতায় এতই সূক্ষভাবে প্রেম, প্রকৃতি ও আত্মনিবেদন জানিয়েছেন তা বুঝতে পারা আমার মতো মানুষের দুঃসাধ্য। যেমন “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাই নি তোমায়, — দেখতে আমি পাই নি। “
.
বাংলা ভাষাকে আমরা যদি একটু উপলব্ধি করি, তবেই বুঝতে পারবো এই ভাষা আমাদের কতটুকু! রবীন্দ্রনাথের পূর্ববর্তী সময়ে সিন্ধু সভ্যতার পার্শ্ববর্তী ভাষাগুলোর মধ্যে খুব কম সংখ্যক ভাষাই আছে যে ভাষাগুলো বাংলায় প্রবেশ করে নাই। আবার সুস্থ মস্তিস্কে চোখ বন্ধ করে একটু বাংলাকে যদি চর্বণ করি, তবেই অনুভব করতে পারবো, ভিন্ন গোত্রের প্রধান ভাষা ইংরেজি আমাদের দন্তে কাঁকরের মতো কতটা বিঁধে আছে। ফারসি, উর্দু, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, আমাদের জিভের স্বাদ কতখানি নষ্ট করে দিয়েছে। মূলত আজ আমরা যে পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মাতৃভাষাকে হাতের তালুতে নিয়ে খেলছি, কিংবা কবিগণ কুমোরের মতো নতুন কিছু সৃষ্টি করছে, আদতে এই ভাষাও ঠিক আমাদের মনুষ্যকূলের মতোই সংকর জাতের। এখন ভিনভাষাকে পরিত্যাগ করলে হয়তো এখন বাংলা ভাষাই কোন কোন জায়গা থেকে ছিঁড়ে যাবে। নতুন নতুন কিছুর আবিস্কার হবে। তখন দেখা যাবে, বাংলাভার ৭৫ শতাংশই রবীন্দ্রনাথ। বাকি সব দেশি বিদেশি।
.
প্রাচীনকাল থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বহু কবি, সাহিত্যিক এসেছেন। এইসব কবিরা প্রত্যেকে এক এক শাখায় খুব সুন্দর বিচরণ করেছেন সত্য, কিন্তু তাঁরা কেউই তখন বাংলা সাহিত্যের মূলে প্রবেশ করতে পারেন নি, বিধায় বাংলা সাহিত্য সেদিন বিশ্বের দুয়ারে পরিচিতিও পায় নি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন একমাত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ আপনি, আমি, আমরা যে সাহিত্যচর্চা করি, সেটিও এখনও রবীন্দ্রনাথের ভাষাকে অতিক্রম করতে পারেনি। আমরা  প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শুধুমাত্র তাঁর ভাষাকেই অনুসরণ করে যাচ্ছি। মোট কথা, আমাদের সাহিত্য রবীন্দ্র-অনুগামী। ফলে, রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব এই সময়েও বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং উত্তরোত্তর কালের স্রেতে ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোট কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হচ্ছেন এমনই এক মহাজন, যিনি হয়তো জন্মগ্রহণ না করলে বাংলা শব্দ তথা সাহিত্য ভান্ডার আজও হয়তো এতটা সূর্যের আলো দেখতে পারতো কিনা সন্দিহান।
.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম বৃত্তান্ত আমরা সবাই কমবেশি জানি। জোঁড়াসাকো – ঠাকুরবাড়ি – দ্বারকানাথ- দেবেন্দ্রনাথ -রবীন্দ্রনাথ। তাঁর শিক্ষাকাল, বিলেত ফেরত এসব প্রত্যেকেরই আজানা নয়। যার কারনে আমরা বারংবার কবিগুরুকে কবিতার আসনে বসিয়ে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করি। আসলেই কী রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র একজন কবি? কিংবা ১৯১৩ খৃষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পাবার পরবর্তী সময়কে বিশ্বকবি হিসেবে চিহ্নিত করে আসছি।
.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বহুধা প্রতিভার দীপ্তমান পুরুষ। সাহিত্য চর্চা ব্যাতীত তিনি অভিনয় করতেন। তিনি ছবি আঁকতেন। এমনকি নিজের গানেকে নিজে সুর করতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি নয়টি ভাষা জানতেন। সব মিলিয়ে কবিকে সব্যসাচী বললেও কম বলা হবে। অর্থাৎ তৎকালীন সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টি যেথায় যেথায় গিয়ে পড়েছিল, সেই ক্ষেত্রগুলিই কখনও শ্যামলে, কখনও সুন্দরে, কখনও সোনার খনিতে পরিণত হয়েছে। আবার এটিও একটি আশ্চর্যকর প্রশ্ন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টি কোথায় পড়ে নি? বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যে শাখায় রবীন্দ্রনাথ নেই! বরং রবীন্দ্রনাথের সে বিচরণ কালজয়ী। বাংলা সাহিত্য ভান্ডারের কোন ক্ষেত্রই তিনি কোনরুপ বিন্দুমাত্র অপূর্ণ রাখেন নি। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু। বিশ্বকবি।
.
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমরা প্রায়ই অজানা। রবীন্দ্র বলয় আমাদের মুখে এসেছে সত্য, কিন্তু অন্তরে এখনও প্রবেশ করে নি বলেই, আমাদের রবীন্দ্র ভাবনার বড় অভাব। আমি আবারও একটু রবীন্দ্রনাথের গানের কথায় আসি। একদিন বিকেলে এই বলেশ্বরের তীরেরই এক মনোরম পরিবেশে আমি একা বসে নিভৃত রবীন্দ্রসংঙ্গীত শুনছিলাম। চোখের সামনে ক্রমেই ঘনিয়ে এসেছিল গোধূলির সন্ধ্যা। সামনে সুদূর আকাশ, সন্মূখে বলেশ্বরের স্রোতধারা, মোবাইল ফোনের স্পিকারে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে…’ । সে এক মহিম ভালোলাগা। হঠাৎ এক ভদ্রলোক কোত্থেকে এসে আমার পাশে বসেই আমাকে প্রশ্ন করলেন। বলেন তো! রবীন্দ্রনাথের গানকে রবীন্দ্র সংগীত কেন বলা হয়? আমি সেদিন তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার পরিচয় জানলাম। তিনি পেশায় একটা সংগীত শিক্ষক। শুনলাম, সব ধরণের গানই তিনি শেখাচ্ছেন তার ছাত্র ছাত্রীদের। আমি তার প্রশ্নের জানিনা বলে আত্মসমর্পণ করার পর তিনি বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গানগুলি তিনি নিজেই সুর করেছিলেন বলেই, কবিগুরুর গানকে রবীন্দ্র সংগীত বলা হয়।
মূলত তার এই কথাটা পুরোপুরি সত্য না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক গানই তার ছেলে রথীন্দ্রনাথ সুর করেছেন। শেষ জীবনে কবি যখন অসুস্থ তখন তার বেশ কিছু গান রেকর্ডিং স্টুডিওতে সুর করা হয়েছে। মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বহু পূর্ব থেকেই নৈমিত্তিক সংগীত চর্চা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে সকল আসরে নিজের গান গেয়ে শোনাতেন। অনুরোধ পেলে নিজের গান তিঁনি গাইতেন। এমনকি প্রতিবছর তার জন্মদিনে তিনি এক একটি গান পাঠকদের সুর করিয়ে উপহার দিতেন। যেমন এই গানটি।
“তবু     মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি     পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি    থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি–
তবু    মনে রেখো।
যদি   জল আসে আঁখিপাতে,
এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু    মনে রেখো।
একদিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে, মনে রেখো।
যদি     পড়িয়া মনে
ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে–
তবু    মনে রেখো।”
এই গানটিও কবিগুরুর নিজের গাওয়া জন্মদিনের উপহার। সেই থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানকে রবীন্দ্র সংগীত বলা হয়ে আসছে।
.
কবিগুরুর জন্ম জমিদার বংশে। তৎকালীন সময়ের বর্ণপ্রথায় তিনি যেমন কুলীন ছিলেন, তেমনি বাপ-দাদার খ্যাতি, নাম, যশ, প্রতিপত্তি কোন অংশে কমতি ছিল না। কিন্তু কবিগুরুর হৃদয়ে এই খ্যাতি, তেজের কোনরুপ প্রভাব কোন সময়েই যেমন লক্ষ্য করা যায় নি, ঠিক তেমনই বাংলা সাহিত্যে কোন সময়ই তার কাছ থেকে কেউ কোনরুপ সমালোচনা পায় নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এজন্যই তিনি লিখতে পেরেছিলেন,
“যে মরিতে জানে, সুখের অধিকার তাহারই।
যে জয় করতে জানে, ভোগ করা তারই সাজে।”
.
 — যা আমি লিখতে পারি না, অন্য কেউ লিখতে পারে না, মূলত তিনিই রবীন্দ্রনাথ। আর একান্ত লিখতে গেলেও সে লেখা ভিন্ন রুপ নিয়ে বসে। অর্থ ভিন্নার্থে বা ব্যঙ্গার্থে রুপ নেয়। কারণ আমার শুদ্ধ মন এখনও জাগে নি। রবীন্দ্র বলয়ে আমরা এখনো প্রবেশ করতে পারি নি।
.
বাংলা সাহিত্যের কাব্য ভান্ডারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তার সাধনা করা ছাড়া আমাদের ভিন্ন কোন পথ নেই। তাঁর কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি  যে রসদ তা অমৃতের চেয়ে কোন অংশে কম হবে না। তিনি তার কবিতায় প্রেম ও ভক্তি এঁকেছেন, কখনো বা  প্রকৃতি ও ভক্তির এতই সূক্ষ প্রয়োগ করেছেন তা বুঝতে গেলে হয়তো আমার মতো অনেকেরই জীবন অতিবাহিত হয়ে যাবে। গীতাঞ্জলি ও সোনারতরী কাব্য তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রমান। যেমন –
তারি ‘পরে ভাসে তরণী হিরণ,
তারি ‘পরে পড়ে সন্ধ্যাকিরণ,
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি  হাসিছ কেন?
আমি তো বুঝি না কী লাগি তোমার বিলাস হেন।
.
১৯১৩ খৃষ্টাব্দের পূর্ববর্তী সময়ে অর্থাৎ, নোবেল পুরস্কার পাবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত রবীন্দ্র জীবনও যে খুব সুন্দর সুখকর ছিল এমন নয়। সংসারে পর্যাপ্ত সামর্থ যদিও তাঁর ছিল, নজরুল কিংবা অন্য সব কবিদের মতো কোনদিনই তাঁকে হা-ভাতে থাকতে হয় নি, ঘটনা সত্য। তবুও এই বিশাল প্রতিপত্তির প্রতি তিনি কখনোই কোন মোহ দেখান নি। প্রয়োজন অতিরিক্ত কোন কিছুর প্রতিই তিনি আসক্ত হন নি। তথাপি, সংসার, জমিদারী দেকভালে তাঁকে প্রতিনিয়ত হাঁপিয়ে তুলতো। সংসারিক ঝামেলা, কাব্যোৎসাহী করা বৌঠানের হঠাৎ মৃত্যু, ছোটছেলের কলেরায় মৃত্যু, মেয়ে বেলা’র মৃত্যু, সহধর্মিণীর মৃত্যুতে তিনি বারংবার শোকাহত হয়েছিলেন। লিখেছেন একে একে বহু গান, বহু কবিতা। যা কালকে অতিক্রম করে আজ কালজয়ী। কালজয়ের নেপথ্যে  তিনিও বারংবার পেয়েছিলেন শোক। যার ফলে সাধনায় তার বহু জায়গায় শোকাতুর সুর এসেছে।
.
কাব্য সাধনায় এসে কবিগুরুকে যে অপবাদ, সমালোচনা পেয়ে যেতে হয় নি, এমন নয়। তৎকালীন সময়ে কবিগুরুর কবিতায় ডিএল রায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করতেন। এমনকি দুই বিঘা জমি কবিতা লিখেও পার্শ্ববর্তী জমিদারদের কাছ থেকেও তাঁকে কম কথা শুনতে হয় নি। ইংরেজদের শোষণের প্রতিবাদ করায় তাকে বহুবার ইংরেজদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ সরকারের পতনের অন্যতম কারণ ছিলেন এই রবীন্দ্রনাথ।
.
রবীন্দ্রনাথের কাব্য নিয়ে কোথাও কোন কথা আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারে নি। অর্থাৎ রবিকাব্য বলতেই যেন মাতৃদুগ্ধ। যা পাঠক আহরণ না করলে অপুষ্টি কিংবা অতৃপ্ততা থেকে যায়। জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সে হতে পারে রবীন্দ্রনাথের শিশুতোষ কবিতা
“মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে,
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।”
কিংবা,
“অন্তর মম বিকশিত করো
 অন্তরতর হে।
 নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
 সুন্দর কর হে।”
সমস্ত জায়গাই যেন রবীন্দ্রনাথের পূর্ণতা। প্রতিটা ক্ষেত্রেই তার নব ধারা, বসন্ত উচ্ছাস।
.
রবীন্দ্রনাথের সব ঋতুর কবিতা, গান রয়েছে। তবে তার লেখনিতে বসন্তের যেমন প্রাধান্য পায় ঠিক তেমনি বর্ষার প্রচুর প্রভাব লক্ষ করা যায়। মূলত আমার ব্যক্তিগত জ্ঞান থেকে বলছি, হয়তো কবি বর্ষা কালকে খুব ভালোবাসতেন। এজন্যই হয়তো তিনি বর্ষাকে নিয়ে এতটা লিখেছেন। সেই “নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঢাই আর নাহি রে, —ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।” থেকে শুরু করে
“এসো শ্যামল সুন্দর —-,
আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।
বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে॥” এমন অমিয় বাণী তিনি বর্ষা ভালোবেসেই লিখেছিলেন। এখানে এখন একটা লাইন না বললেই না যে,  হয়তো কবি বর্ষাকালকে এতই ভালোবাসতেন; যার জন্যই বিধাতা তিনি বাইশে শ্রাবণকে নতুন এক রুপ দিয়েছেন।
.
কবিগুরু বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বার্থক ছোটগল্পকার। তাঁর গল্পের সহস্রধারা আজও বইছে আমাদের সাহিত্যকথনে। মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  তাঁর পত্রিকার খোরাক মেটানোর জন্যই প্রথম প্রথম এই ছোট গল্পগুলি  লিখতেন। পত্রিকায় ছোটগল্পের জনপ্রিয়তা পাবার পর তিঁনি ছোটগল্পে মনোনিবেশ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মোট ছোটগল্প ১১৯ টি। তার ছোট গল্পের প্রথম পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল — ‘কঙ্কাল’, ‘অতিথি’, ‘ত্যাগ’, ‘একরাত্রি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ভিখারিনী’, ‘ছুটি’, ‘নিশীথে’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘নষ্টনীড়’ প্রভৃতি।
.
রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্প ‘ভিখারিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথের ষোলো বছর বয়সের রচনা ‘ভিখারিনী’ই গল্পগুচ্ছের উজ্জ্বল যাত্রাবিন্দু, ‘ভিখারিনী’ থেকেই রবীন্দ্রগল্প সমাজ ও সময়ের সযত্ন প্রহরায় বহুবর্ণিল পরিচর্যায় এক বিশাল শিল্পসৌধ-নির্মাণে হয়েছে সমুদ্রগামী। ‘ভিখারিনী’র প্রাণশক্তি, সৃষ্টিউত্তাপ ও প্রকরণ-উষ্ণতা, বস্তুত গল্পগুচ্ছের সর্বশেষ প্রান্তস্পর্শী; এবং এ-প্রশ্নে ‘ভিখারিনী’ বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক নির্মাণ। ‘ভিখারিনী’র পর রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছরে (১৮৯১-১৯৩৩) প্রায় নব্বইটি গল্প রচনা করেছেন। যা বাংলা সাহিত্যকে আজীবন রসময় করে রাখবে।
.
যোগাযোগ, গোরা, করুণা, রাজর্ষী, বউ ঠাকুরাণীর হাট, চোখের বালি, দুই বোন, শেষের কবিতা, মালঞ্চ, চার অধ্যায় মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসের সংখ্যা তেরোটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র ষোল বছর বয়সে ‘করুণা’ উপন্যাস লিখেছেন। এই উপন্যাস লেখায় তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তার বউঠান কাদম্বরী দেবী। ১৮৭৭-৭৮ সালে করুণা প্রথমে পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।  কিন্তু কবি এই উপন্যাসটি গ্রন্থরুপে প্রকাশ করেন নি। হয়তোবা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ভারত সরকার করুণা’কে গ্রন্থে রুপ দেয়।
.
ঠাকুরের শেষ উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’। প্রকাশকাল ১৯৩৪ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসুস্থ হবার পূর্ব মুহুর্তে। মূলত এটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। তবু এলা ও অতিনের ভালোবাসার রুপ দেয় এই ‘চার অধ্যায়’। উপন্যাস হিসেবে ‘চার অধ্যায়’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা সাহিত্যে শেষ দান।
.
রবিঠাকুরের মোট তেরোটি উপন্যাসের প্রতিটি উপন্যাসই কালজয়ী। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসই বাংলা সাহিত্যকে আগলে রেখেছে। সমৃদ্ধ করে রেখেছে। আমি প্রথমেই বলেছিলাম, বাংলা ভাষা কতটুকু! বাংলা ভাষা থেকে বিদেশি ভাষা বাদ দেওয়া হলে বাংলার ঝুলিতে যতটুকু বাংলা পরে থাকত, তা এখন আর নেই। রবীন্দ্র বলয় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, এ নিসন্দেহে বাংলা গবেষকেরা স্বীকার করে আসছেন।
.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাকে ভালোবাসতেন। ঈশ্বর, মা, মাটি, মানুষ ও মাতৃভূমিকে ভালবাসতেন। তার সকল কৃতকর্মই রবির মতোই তেজদীপ্ত। তিঁনি শুধুমাত্র একজন কবিই ছিলেন না। তিঁনিই বাংলার ইতিহাসের আধুনিক কবিতার জনক, শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার, আত্মতৃপ্তয়ী উপন্যাসিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন দার্শনিক। তিনি ভবিষ্যৎ জানতেন৷ ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতেন। তাঁর প্রতিটি লেখাই দর্শন। ১৪০০ কবিতা তার জলন্ত প্রমাণ। কবিকে আমরা না জানতে পারলেও কবি জানতেন তিঁনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর কবিতা হবে অক্ষয়কবজ।
.
কবিগুরু ভ্রমনপিপাসু ছিলেন। একটু সময় পেলেই তিনি দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন। ঘুরে বেড়াতেন সিলেট, কুষ্টিয়া, রংপুরে। ১৯১৩ সালে নোবেল বিজয়ের পর তিনি বহু দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিঁনি দেশি বিদেশি প্রায় দশটা ভাষা জানতেন। কবিগুরু ১৯২৬ সালে ঢাকায় আসেন। তৎকালীন ঢাকার জনগণ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকায় আসা। ঢাকায় এসে ১০ ফেব্রুয়ারি ও ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে দুটি আলাদা আলাদা বক্তব্য দেন। ১৯৩৬ সালে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আবারও আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবিকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি দেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের পাঠ্যসূচিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য ও দর্শন বিভাগে অনেক আগে থেকেই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে এ মূল্যায়ন বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে।
সবশেষ ওই কথাটাই চিরসত্য। প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথ জন্মায় না। রবি ও রবীন্দ্রনাথ এক এবং অদ্বিতীয়। কবি চরণে তাই চিরায়ত বন্দণা জানাই। ‘একটি নমস্কারে প্রভু, একটি নমস্কারে।’
.
তথ্যসূত্র: রবীন্দ্র রচনাবলী, সঞ্চয়িতা সমালোচনা, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ইন্টারনেট।

২ comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *