বাঙালি জাতির মুক্তির দূত বখতিয়ার খলজি

আরিফুল হক

 

বাংলার মুসলিম ইতিহাসের সঙ্গে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, যার আগমন না ঘটলে বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না, বাংলা মুল্লুকে ইসলামের প্রসার ঘটতো না, বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই বিস্ময়কর পুরুষ, রূপকথার রাজপুত্রের মত তেজোদীপ্ত, অসীম সাহসী, বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পথিকৃত, যাঁর নাম মালিক বখতিয়ার খিলজি।

সুদূর আফগানিস্তান থেকে ছুটে এসে এই বাংলাদেশে প্রথম মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা তাঁর মহান কৃতিত্বেরই পরিচয় বহন করে। তিনিই ছিলেন বাংলার মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার নিশান বরদার। দুই শতাব্দীর পরাধীনতার গ্লানি মোচন করে বাংলাদেশের মুসলমানরা স্বাধীন ভূখণ্ডের বাসিন্দা। নানাবিধ ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে উপমহাদেশের ৫৫ হাজার ৮১৩ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে যে স্বাধীন বাঙালি মুসলিম নিবাস নিশ্চিত হয়েছে, যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন রয়েছে তার পথপ্রদর্শক, দিশারী পুরুষ তো ওই মহান সিপাহসালার বখতিয়ার। কিন্তু দু:খের বিষয় এই মহান পথপ্রদর্শকে আমরা বিস্মৃত হয়েছি। বানের পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানার মত আমাদের স্বাধীনতার গৌরবের অসংখ্য ভাগিদারদের ভীড়ে বাংলার সমতল ভূমি ছেয়ে গেছে। কেবল অনুচ্চারিত থেকে গেছে সেই মহান পুরুষটির নাম, যার পদার্পণ না ঘটলে এই বাংলার মাটিতে ইসলাম আবাদ হতো না, মুসলমানরা রাষ্ট্রক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচশ বছর দেশ শাসন করতে পারতো না, স্বাধীন বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডের জন্ম হতো না। দু:খের বিষয় আমাদের ইতিহাসের সেই মহান নায়ককে আজ আমরা ভুলে গেছি, হারিয়ে ফেলেছি। সত্য ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে আমাদের বড় অনীহা। আমরা ভুলে যাই, সত্য ইতিহাসই বর্তমানের সাথে অতীতের যোগসূত্র রচনার একমাত্র উপায়। ঐতিহ্যই জাতির প্রত্যাশার রূপ, আকাক্সক্ষার ফসল। ইতিহাস বিকৃতির ফলে, সত্য ইতিহাস চর্চার দূরে দৃষ্টি মেলাতে পারি না, আমাদের ঝলমলে সুদূর অতীত ধোঁয়াটে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। আজ তাই স্বাধীনতার অগ্রনায়ক বখতিয়ার খিলজীকে আমাদের বড় প্রয়োজন। প্রয়োজন ১৩০৩ খৃ. অত্যাচারী রাজা গৌরগোবিন্দের হাত থেকে বাংলা অঞ্চলকে রক্ষাকারী মহান মুসলিম মুজাহিদ হযরত শাহজালালকে। প্রয়োজন নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ-এর যোগ্য সিপাহসালার দক্ষিণ বঙ্গ বিজয়ী বীর সেনানী খানজাহান আলীকে, যারা এখনও অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে, ঐতিহ্যের পাহাড় হয়ে বাংলাদেশের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সীমান্ত পাহারা দিয়ে রেখেছেন। ঐতিহ্যের এসব মহান নায়কদের যোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হলে, আমরা শিকড়-বিচ্যুত হয়ে পড়বো, আমাদের স্বকীয়তা, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।

বখতিয়ার খিলজি যখন বাংলা জয় করেন, তখন বাংলাদেশে চলছিল মাৎসন্যায়ের যুগ। পাল বংশের পতনের পর, কর্নাটক থেকে আগত সেন বংশীয় রাজারা, ব্রাহ্মণ্য বর্ণ-বৈষম্য প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের মাটির মানুষদের উপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছিলেন। তের শতকের বৌদ্ধ কবি রামাই পণ্ডিতের ‘শূণ্য পুরাণ’-এর কবিতায় সেই অমানুষিক অত্যাচারের কিছুটা বর্ণনা পাওয়া যায়। রামাই পণ্ডিত লিখেছেন- ‘‘উড়িষ্যার ষোলশ’ ঘর বৈদিক ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশকে তাদের লাখেরাজ সম্পতি মনে করতো। কানে পৈতা জড়িয়ে তারা এদেশের ঘরে ঘরে দক্ষিণা আদায় করে ফিরতো। দাবীমাত্র দক্ষিণা দিতে কেউ অস্বীকার করলে ক্রুদ্ধ হয়ে তারা তার সর্বনাশ ঘটাতো। দল বেঁধে তারা বৌদ্ধ জনসাধারণের বিনাশ সাধন করতো। তাদের ভয়ে দেশের জনসাধারণ সদ্য কম্পমান থাকতো’’।

ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রমবাদীদের খড়গাঘাতে যখন নিষ্ঠুরভাবে বৌদ্ধ নিধন চলছিল, দেশজুড়ে যখন অরাজকতা বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল, ঠিখ সেই সময় বাংলার সাধারণ মানুষের মুক্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী। বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয় দেশের জনগণের প্রত্যাশাকে কি পরিমাণ ধারণ করেছিল তার বিবরণ পাওয়া যায় ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ নামক পুস্তকে। তিনি লিখেছেন- ‘‘বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আধিপত্য ও নির্মুল অভিযানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে বাংলার মুসলিম বিজয়কে দু’বাহু বাড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিল’’।

অভিনেতা আরিফুল হক এর ছবির ফলাফল

অতএব দেখা যাচ্ছে যে, বখতিয়ার খিলজী শুধু মুসলিম শাসনের অগ্রনায়ক হিসেবেই এদেশে আসেননি, আপামর নির্যাতিত জনগণের মুক্তিদূতরূপেও বাংলায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের সমর্থনের উপর ভিত্তি করেই সম্পন্ন হয়েছিল তাঁর বঙ্গবিজয়।

বিপুল জনসমর্থন না থাকলে মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে প্রবল পরাক্রমশালী রাজা লক্ষণ সেনকে বিতাড়িত করে বঙ্গ বিজয় হয়তো সম্ভব হতো না। বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয় পৃথিবীর ইতিহাসের এক চমকপ্রদ ঘটনা।

বখতিয়ার খিলজির নদীয়া বিজয়ের দুশো বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় সমগ্র এলাকা মুসলিম শাসনাধীনে চলে আসে। ডঃ এম এ রহীম তাঁর ‘বাংলার সমাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ বইতে লিখেছেন- ‘মুসলিম বিজয় ছিল বাংলার প্রতি বিরাট আশীর্বাদস্বরূপ। যা বাংলা ভাষাভাষী লোকদেরকে একটা রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐক্যমঞ্চে সংঘবদ্ধ করে বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসের ভিত্তি স্থাপন করে দেয়। যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং প্রদেশে আর কয়েক শতকের জন্য হিন্দু শাসন অব্যাহত থাকতো, তাহলে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেতো এবং অবহেলিত বিস্মৃত হয়ে অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো।’

অভিনেতা আরিফুল হক এর ছবির ফলাফল

বর্তমান বাংলাদেশ পাশ্ববর্তী ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসি শক্তির নিগড়ে বন্দী। তাদের চক্রান্তে দেশজুড়ে চলছে অরাজকতা। সাধারণ মানুষ অসহনীয় জুলুম, নির্যাতন আর লাঞ্ছনার শিকারে পরিণত হয়েছে। জাতীয় ঐক্য আজ বিপর্যস্ত। দেশ শাসনের নামে অরাজকতাতন্ত্র, সামাজিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলাতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের নামে লুটপাটতন্ত্র, গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীদের নিধনতন্ত্র, সংস্কৃতির নামে পৌত্তলিকতন্ত্র দেশের অভ্যন্তরে আজ ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে। মুসলমান নামধারী কিছু মানুষই আজ ইসলাম উচ্ছেদে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে তারা আধুনিকতা এবং ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের স্তম্ভগুলোকে ধ্বংস করে ফেলাকে প্রগতি বলে আখ্যা দিচ্ছে। এমন সময় আমাদের শিকড় অন্বেষণে করতেই হবে। এ সময় আমাদের বড় প্রয়োজন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজির মতো অগ্রনায়ককে- যিনি কুসংস্কার, সামাজিক বৈষম্য, বর্ণাশ্রম প্রথার মতো অন্ধকার পথ থেকে আমাদের সাম্য, সুবিচার ও কল্যাণ বোধের পথে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

(সূত্র:  আরিফুল হক: বঙ্গবিজয় ও আজকের প্রেক্ষাপট, প্রথম প্রভাত, পৃ ২৭-৩০, সংক্ষেপিত, শিরোনাম আমাদের দেয়া)
লেখক : চলচ্চিত্র শিল্পী, অভিনেতা, লেখক, কলামিস্ট, গ্রন্থকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *