মানুষ মাতৃক্রোড়ে মাতৃভাষার পাঠ গ্রহণ করে। মায়ের মুখ নিঃসৃত বাণীতেই শিশুর মুখে খড়ি। শিশুর এই বাচন, কথন, প্রকাশভঙ্গি কোনো ব্যাকরণের ধার ধারে না। ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব, পদ, কারক, সমাস, সন্ধি, প্রকৃতি-প্রত্যয় মেনে শিশু কথা বলে না। কোনো একাডেমি বা সংস্থা ভাষার গতি নির্ধারণ করতে পারে না। এতসব আইন-কানুন, বিধি-বিধান মেনে মুখ খুলতে হলে কোনো নবজাতকই কথা বলা শিখতে পারত না। মা-মাটির মমতায় সৃষ্ট বোল-বুলিতেই শিশুর শব্দ বিকাশ ঘটে। ভাষা বাহির থেকে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। দেশজ, গ্রামীণ ও পল্লিমননই ভাষার জন্মস্থান। রাজধানীর এসি রুমে বসে বহির্দেশে থেকে শব্দ, ভাষা বা প্রমিত সংস্কৃত বানানের নিয়ম আমদানি করে মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধি আনয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দাদা দাদি, নানা নানি, মামা মামি, চাচা চাচি, আব্বা আম্মা, উস্তাদ, ইমাম, খতিব, আলেম, উলামা, পির মাশায়েখ, চাষি, মজুর যে ভাষায় কথা বলেন, যে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করেন সেটাই বাংলাভাষা। সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদের ভাষায়, ‘মহিষচারক মৈশালদের মুখের ভাষাই আমার মাতৃভাষা।’ এই ভাষার অধিকার আদায়ের জন্যই ভাষা আন্দোলন হয়। প্রাণদান করেন বেশ কয়েকজন তরুণ যুবক। অথচ তাদের রক্তের সাথে বেইমানি করে এখন জাতীয় পর্যায়ে মৃতভাষা সংস্কৃতকে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
সংস্কৃত হিন্দু-বৌদ্ধদের দেব ভাষা। তাদের ধর্মীয় ভাষাও বটে। আর্যদের আদি নিবাস মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ রাশিয়া ও পোল্যান্ড। ইউরোপ থেকে তারা আর্য বা বৈদিকভাষা অর্থাৎ সংস্কৃতভাষা নিয়ে জঙ্গি রথে চেপে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে ইসায়ি পূর্ব ১৫০০ সালের দিকে। অর্থাৎ আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে এ উপমহাদেশে সন্ত্রাসী বেশে আগমন করে আর্যরা। তারা ছিলো যোদ্ধার জাত। তারা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে দ্রাবিড় প্রতিষ্ঠিত সিন্ধু উপত্যাকার হরপ্পা মহেনজোদারোসহ অগণিত নগর-বন্দর ধ্বংস করে। পর্যায়ক্রমে আর্যহিন্দুরা উপনিবেশ গড়ে তোলে দক্ষিণ ভারত, পূর্বভারত ও বাংলাদেশ পর্যন্ত। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ আবদুল গফুর বলেন, ‘উপমহাদেশের বহুল প্রচলিত হিন্দুধর্মও বহিরাগত।’ সুতরাং হিন্দুরা বিদেশাগত এবং তাদের ভাষাও পোল্যান্ড রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত। তাছাড়া সংস্কৃত বর্তমানে লুপ্ত ভাষা। এ মৃত ভাষার নিজস্ব কোনো লিপিও নেই। অনার্য তথা বাঙ, দ্রাবিড় ও আদিভারতীয় জনগোষ্ঠীর রক্তনদীর ওপর হিন্দুরা রাষ্ট্র কায়েম করে। একইভাবে সংস্কৃত ভাষাকেও তারা চাপিয়ে দেয় প্রাগার্য জাতিসমূহের ওপর। প্রাচীন সেই আদিবাসীদের উত্তরসূরী আমরা। লাখ কোটি আদিবাসী নিধন করে আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কায়েম করেছিল উপনিবেশ। অথচ কী দুর্ভাগ্য এ জাতির! আক্রমণকারীদের ভাষা সংস্কৃতিকেই আপন করে নিচ্ছি। এমন তো হবার কথা ছিলো না।
অনার্য বা বাংলার তৎকালীন বঙ্গজনপদকে আর্য ভাষাভাষীগণ তষ্কর, বর্বর, পক্ষী, অচ্ছ্যুত, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি অধ্যূষিত দেশ বলে গণ্য করত। (কাবেদুল ইসলাম: প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতিগোষ্ঠী, পৃ ২৫)। আর্যরা শুধু আমাদের ভাষা সাহিত্যকেই খুন করে নাই; স্থান, কাল, বস্তুরও নতুন নামকরণ করে। প্রাচীন সমৃদ্ধশালী গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের ঐতিহ্যও বিনষ্ট করে। সেই প্রাগার্য ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস উদ্ধার আদ্যাবধি সম্ভব হয় নাই। অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে বর্তমানে প্রচলিত বাংলাভাষার উদ্ভব হয় পাল আমলে। বৌদ্ধ পাল আমল ছিলো প্রাচীন বাংলার একটি সমৃদ্ধশালী যুগ। প্রাচীন গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের জৌলুস হারায় আর্য ব্রাহ্মণদের আগ্রাসনে। তাদের দর্পহুঙ্কারে ভেঙে পড়ে এখানকার সমাজ ব্যবস্থা। কালক্রমে বাঙালিরা উপায়ন্তর না পেয়ে আর্যহিন্দুদের অধীনতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ততদিনে বাংলা ও বাঙালি অন্ত:সারশূণ্য দেশ ও জাতিতে পরিণত হয়। বর্ণবাদী বর্ণহিন্দুরা চাণক্য নীতি দিয়ে বাঙালিদের বানায় দাসের জাতি। এই ক্রান্তিকালীন অবস্থা চলতে থাকে কয়েকশ বছর। অষ্টম শতাব্দীতে আসে এক শুভদিন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসেন পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল। প্রায় চারশ বছর রাজত্ব করেন পালরা। এই সময়েই বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণদের ক্রসফায়ারে জন্মলাভ করে বর্তমান বাংলাভাষা। বৌদ্ধরা ছিলো বাংলার স্বপক্ষ শক্তি আর ব্রাহ্মণরা ছিলো বাংলার বিপক্ষ শক্তি। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা শুধু বাংলার বিরুদ্ধবাদী শক্তি ছিলো সেটাই নয়; বাংলাকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্যে আত্মনিয়োগ করে। ব্রাহ্মণরা এগারো শতকে ক্ষমতায় আসলে বাংলাভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের স্পষ্ট অবস্থান ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সেন-বর্মনদের শতবছর শাসনে বাংলাভাষা বিলুপ্ত পর্যায়ে চলে যায়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘হিন্দু সেন রাজাগণ সংস্কৃতের উৎসাহদাতা ছিলেন। ব্রাহ্মণ্যেতর ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট বলে সম্ভবত: তারা বাঙ্গালা ভাষার প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন। তারা বলতেন, অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানিচাং।/ভাষায়াং মানব: শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।। অর্থাৎ ১৮ পুরাণ এবং রামায়ণ ভাষায় (বাংলা) শুনলে/মানব রৌরব নরকে অবশ্য যায়।’ (ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ: বাঙ্গালা ব্যাকরণ, পৃ ১৯)। ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম শাসন কায়েম হলে বাংলাজবান তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পায়। জৌলুসে জলমল হয়ে ওঠে বাংলাভাষা ও সাহিত্য। ১৮০০ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে এ অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বা কলেজ অফ ফোর্ট উইলিয়াম ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়েলসলি প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচ্যবিদ্যা শিক্ষাকেন্দ্র। ১৮০০ সালের ১০ জুলাই কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম চত্বরে এই কলেজ স্থাপিত হয়। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের শত্রু এবং দানবিক, পাশবিক, বিকারগ্রস্ত ক্রুসেডার ব্রিটিশরা এ কলেজের উদগাতা। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের সংস্কৃতকরণে এই কলেজে আবির্ভূত হয় কয়েকজন ভিলেন। নাম তাদের ডানকান, ফরস্টার, মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার, উইলিয়াম কেরি, এইচ. টি. কোলব্রুক, মদন মোহন তর্কালঙ্কার, রামরাম বসু, রামমোহন বাচস্পতি প্রমুখ। বাংলাভাষার স্বাভাবিক গতি প্রকৃতিকে তারা বদলে ফেলে। আর্য-বৈদিক-সংস্কৃত ভাষাকে চাপিয়ে দেয় বাঙালিদের ওপর। আমজনতাকে বিভ্রান্ত করে ওইসব পথভ্রষ্ট, ব্রিটিশদের নাজনেয়ামত প্রাপ্ত কথিত ভাষাপণ্ডিতরা।
কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘সিহাবুদ্দিন নামা’ কাব্যে লিখেছেন, আরবি থেকে ফারসি এবং ফারসি থেকে বাঙালা ভাষা পয়দা। তাঁর মতে, আরবি তনয় ফারসি এবং ফারসির নন্দন বাঙালা। স্বনামখ্যাত রাজা রাধাকান্ত দেব ‘শব্দকল্পদ্রুম’ এর পরিশিষ্ট খণ্ডে বলেছেন, বঙ্গবিদ্যা তথা হিন্দীং পারসীং মারবীং ততঃ। অর্থাৎ বাঙালা ভাষা হিন্দি, ফারসি, আরবি শব্দময়। কবি শাকের মাহমুদ তাঁর মধুমালতী কাব্যে তখনকার বাংলাভাষার নাম ‘ফারছী-বাঙ্গালা’ বলে উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলার মূল আরবি।’ শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন ১৮০৪ সাল তক কোনো হিন্দু কবির রচনায় ‘বাঙালা ভাষা’ নাম খুঁজে পাননি।
সজনীকান্ত দাস তার বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে বলেন, ‘এক হিসেবে ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে যে ভাষার প্রামাণিক আত্মপ্রকাশ দেখিতেছি তাহা বাংলাদেশের মুসলমান প্রভাবের ফল। … পরবর্তীকালে হেনরি পিটার ফরস্টার ও উইলিয়াম কেরি বাংলাভাষাকে সংস্কৃত জননীর সন্তান ধরে আরবি পারসির অনধিকার প্রবেশের বিরুদ্ধে রীতিমত ওকালতি করেছেন। কিন্তু ইংরেজের আগমন না ঘটলে আজও আমাদেরকে ‘গরিব নেওয়াজ শেলামত’ বলে শুরু করে ফিদবি বলে শেষ করতে হতো। … ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে এই আরবি পারসি নিসূদন যজ্ঞের সূত্রপাত এবং ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আইনের সাহায্যে কোম্পানির সদর মফস্বল আদালতসমূহে আরবি পারসির পরিবর্তে বাঙলা ও ইংরেজির প্রবর্তনে এই যজ্ঞের পূর্র্ণাহূতি। বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মও এই বছরে। এই যজ্ঞের ইতিহাস অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। আরবি পারসিকে অশুদ্ধ ধরে শুদ্ধ পদ প্রচারের জন্য সেকালে কয়েকটি অভিধান রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। সাহেবরা সুবিধা পাইলেই আরবি ও পারসির বিরোধিতা করে বাংলা ও সংস্কৃতকে প্রাধান্য দিতেন। ফলে ১০-১৫ বছরের মধ্যেই বাঙলা গদ্যের আকৃতি ও প্রকৃতি সম্পূর্ণই পরিবর্তিত হয়েছিল।’ এ প্রসঙ্গে আবদুল মওদুদ বলেন, ‘সজনীকান্তের মতো গোঁড়া হিন্দুর কলম থেকে এরকম উদার অসাম্প্রদায়িক উক্তি বিষ্ময়কর। সেজন্য তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে বর্তমানকালে আমরাও বলি, বাঙলাদেশে মুসলমানের দান হিসেবে যে বাংলাভাষার প্রচলন ছিলো, কেরি প্রমুখ ‘মাহাত্মা’দের কল্যাণে তার উৎখাত না হলে মঙ্গলের কি অমঙ্গলের হতো, আজ সে বিচার করে লাভ নেই। কিন্তু এ নির্মম কর্মের ফলে বাঙলার হতভাগ্য মুসলমান সেদিন নিশ্চয়ই ফরিয়াদ জানিয়েছিল: আমায় সর্বপ্রকারে কাংগাল করেছে গর্ব করেছে চুরি। আমার রাজ্য ও জীবনধারণের সব উৎস লুট করেছে কোম্পানি-সৃষ্ট নব্য বাবু সম্প্রদায়: এবার মুখের ভাষা ও সংস্কৃতিও কেড়ে নিলো কোম্পানির তল্পীবাহক মিশনারীরা !’ (উদ্বৃতি: আবদুল মওদুদ: মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃ ২৪০-২৪১)
বাঙালা ভাষায় ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ রচনার জন্য কৃষ্ণদাস কবিরাজকে শাস্তি দেয়া হয়। তাঁর বই নিষিদ্ধ করা হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষাবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান বলেন, ‘হাজার বছরের ঐতিহাসিক বাঙালা দেশে, বাংলা ভাষায় রচিত এটাই বোধ হয় প্রথম নিষিদ্ধ বই; যা তখনকার সরকার নিষিদ্ধ করেনি, মুসলমানরা করেনি, করেছিল বৈষ্ণব গোস্বামীগণ।’
স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন বলেন, ‘বাঙালা ভাষায় শতকরা নব্বইটা প্রকৃত বাঙালা শব্দ ছিলো। তা তাড়িয়ে সে-সব জায়গায় সংস্কৃত থেকে শব্দ এনে বসিয়ে বাঙালা ভাষাকে সংস্কৃতায়িত করা হয়েছে।’ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয় বাংলাভাষা, সাহিত্য এবং ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কোম্পানি একদল এজেন্ট, দালাল, অনগত কেরানি তৈরি করতে প্রতিষ্ঠা করে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। বর্ণহিন্দুদের সার্বিক সহযোগিতা পায় এর উদ্যোক্তারা। এখানকার সাম্প্রদায়িক প-িতরা বাংলাভাষার স্বাভাবিক গতিপথকে রুদ্ধ করে মূলধারা ও আসল সিলসিলা থেকে। পরকীয়ায় যুক্ত হয় বাংলাভাষা। মুসলিম হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগণের মুখের জবানকে বামুনরা ‘ইসলামি বাংলা’ আখ্যা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। প্রকৃত বা আরবি ফারসিমুখী বাংলাভাষাকে বানায় সংস্কৃতমুখী বাংলা। সেমিটিক ভাবধারার ৯০% শব্দভা-ারকে বদলিয়ে তদস্থলে আমদানি করে দুর্বোধ্য সংস্কৃতভাষাকে। সংস্কৃত একটি অপ্রচলিত অখ্যাত ভাষা। নামজাদা ভারতীয় মনীষী অনির্বাণ বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, ‘সংস্কৃত ভাষা মানুষের মুখের ভাষা নয়, দেবতাদের মুখ-নিঃসৃত ভাষাও নয়- তাই এটি দেবভাষাও নয়, সংস্কৃত লিপিও দেবনাগরী নয়। সংস্কৃত ভাষা অখ- ভারতবাসীর আদি ভাষা নয়। সংস্কৃত বহিরাগতদের সৃষ্ট একটি কৃত্রিম বা বানানো ভাষা, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তৈরি করা হয়েছে।’ দুনিয়ায় একজন নাগরিকও বলায় বা লেখায় এ ভাষা ব্যবহার করে না। সংস্কৃতভাষা কঠিন, দুর্বোধ্য, উচ্চারণ অসাধ্য এবং মানুষের বচনের অনুপযোগী। হিন্দুদের এই ধর্মীয় ভাষার অপ্রচলিত শব্দ জোর করে ঢুকিয়ে দেয় বিতর্কিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা। পরবর্তীতে হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। বাংলাভাষার বিকাশে তদানীন্তন ইংরেজ সরকার এবং বর্ণহিন্দু উভয়ের ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ! ভাষা বহতা নদীর মতো। কিন্তু কোলকাতাকেন্দ্রিক ভাঁড়াটে বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিকরা বাংলাভাষাকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে উনিশ শতকে।
আর মুসলমানরা! তাদেরকে তো আরও অর্ধশত বছর পূর্বেই ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। মুসলিম শাসনামলে মুসলিমদের অবস্থান ছিলো উচ্চস্তরে। কিন্তু খ্রিস্টান-বর্ণহিন্দু মিলেমিশে পলাশি নাটকের পরপরই প্রশাসন, রাজস্ব, সেনাবাহিনী, শিল্প-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে মুসলিম বিতাড়ন। ছিয়াত্তরের মন্বান্তরে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে পৌনে এককোটি ইনসানকে হত্যা করা হয়। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নামে মুসলমানদের বাস্তুভিটাও কেড়ে নেয় বর্ণহিন্দু ও কোম্পানি সরকার। তাই বাংলাভাষায় এই আগ্রাসনের মুখে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতিকূলে মুসলমানরা সময়োপযোগী কিছু দাঁড় করাতে পারেনি। ফল যা হবার তাই হয়। শুধু ভাষা নয়; নদীর গতি, পানির প্রবহমানতা নিয়ে হাল আমলেও তাদের মুনাফিকি স্পষ্ট। ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে মরুকরণ, মৎস্যশূণ্য করার প্রক্রিয়া তাদেরই ‘ঐতিহাসিক’ কুকীর্তিগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের বাণিজ্যিক আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, রাজনৈতিক আগ্রাসনে বাংলাদেশের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
‘সাম্প্রদায়িক সম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামমোহন রায়, ঠাকুর কবি রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধূসুদন দত্ত, কাজী আবদুল ওদুদ, সুকান্ত, জীবনানন্দ, প্রমথ চৌধুরী, সুকুমার সেন, রমেশচন্দ্র, ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, দীজেন্দ্রলাল, সুনীতিকুমার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র সবাই-ই চিন্তা চেতনায় লেখা বলায় সংস্কৃতঘেষা। পরবতীকালে অন্নাদশঙ্কর রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মুনির চৌধুরী, নুরুল মোমেন, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, হুমায়ুন আযাদ, হুমায়ুন আহমদ প্রমুখ ধর্মনিরপেক্ষবাদী কবি সাহিত্যিক নাট্যকাররা উদ্ভটমার্কা সংস্কৃত-বাংলারই প্রাধান্য দেয়। এর বাইরে মওলানা আকরম খাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ মুজতবা আলী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শাহেদ আলী, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, ফররুখ আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আসকার ইবনে শাইখ, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ সাধারণ জনকওমের ভাষায় কিছু সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন সত্য, কিন্তু দরকারের তুলনায় তা খুবই নগন্য।
খ্রিস্টান ও হিন্দু আমলের (১৭৫৭-১৯৪৭) ১৯০ বছর চলে তৃণমূল ও প্রান্তিক জনকওমের ভাষার বিরুদ্ধে লড়াই। বাংলার ওপর খুব জোরে সোরেই চলে সংস্কৃতের প্রলেপ। ১৯৪৭ সালের আযাদির পর সংস্কৃত আমদানি বন্ধ হয় বটে, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা বসে থাকেনি। তাদের গোপন এজেন্ডা চলতে থাকে। মাওলানা আকরম খাঁ, গোলাম মোস্তফা, আবুল মনসুর আহমদসহ দেশ ও স্বাজাতি প্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা সেদিন বাংলাভাষার মূলধারা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। কিন্তু পথভ্রষ্ট বাম-রাম-সেকুলার কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের চক্রান্তে সেদিন মুসলিম জনকওমের প্রতিনিধিত্বকারী বুদ্ধিজীবীদের চেষ্টা সাধনা ব্যর্থ হয়। ফলে ভাষার রূপ ফোর্ট উইলিয়ামি অবস্থায় থেকে যায়।
কিন্তু হাল-আমলে ভাষার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘ সাড়ে ছয় দশক পর বাংলাভাষার বিরুদ্ধে আরেকটা লড়াই ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের উত্তরসূরীরাই বর্তমান দেশের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির হর্তাকর্তা। ব্রিটিশ আমলের দুশতাব্দীর ঘষা মাজার পরও মুলধারার কিছু ঐতিহ্য অবশিষ্ট ছিলো। সেগুলো বিতাড়নের কাজ চলছে পুরোদমে। পাঠ্যপুস্তকে ও অফিস আদালতে এ কাজ সম্পন্ন। এখন চলছে গণমাধ্যম তথা ইলেকট্রনিক্স, প্রিন্ট মিডিয়া, সাহিত্যকর্ম ও ভার্চুয়াল জগত থেকে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাভাষার মূল গতিধারা অচিরেই চিরতরে হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। সংস্কৃতের সংহারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বাংলাবুলি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, তাহজিব, তমদ্দুন। অন্যদিকে ইংরেজি পাশাপাশি হিন্দিভাষার আগ্রাসন শুরু হয়েছে টর্নেডোর গতিতে। মরার উপর খাড়ার ঘা।
হদিসঃ
১. কাবেদুল ইসলাম: প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতিগোষ্ঠী, উত্তরণ, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০. প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৪
২. ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ: বাঙ্গালা ব্যাকরণ, মাওলা ব্রাদার্স, আগস্ট ২০০৩, ৩৯ বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০
৩. অধ্যাপক ড. এস.এম. লুৎফর রহমান: বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস ১ম, ২য় ও ৩য় খ-, ধারণী সাহিত্য সংসদ, ঢাকা
৪. আবদুল মওদুদ: মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ সংস্কৃতির রূপান্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, এপ্রিল ২০১৫
৫. ড. ওয়াকিল আহমদ: বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ৬৭ প্যারীদাস রোড, ঢাকা ১১০০, তৃতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০০২
৬. আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, সেগুনবাগিচা ঢাকা ২, প্রকাশ: জুন ১৯৭৯