রম্য গল্প : চৌর্যশিল্প

রুকাইয়া সুলতানা মুন
.
জি, ঠিকই শুনেছেন।
পূর্বে চৌর্যবৃত্তি কে একটি পেশা হিসেবে গন্য করা হত। যদিও তা নিন্দনীয় ছিল তথাপি এটি আমাদের গ্রামবাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ ছিল।
পরিতাপের বিষয় হল কালের পরিক্রমায় পেশাটি হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বললে অবশ্য ভুল বলা হবে। বরং বলা যায় মৌলিক পেশা হিসেবে চুরি -চামারি প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়ে অন্যান্য সকল পেশার মধ্যে ঢুকে বেশ পাকাপোক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। এখন চোরেরা গায়ে সরিষার তেল মেখে লুঙ্গি কাছা দিয়ে রাতের আধারে চুরি করেনা। তারা অশিক্ষিতও না। ফাইল ভরা সার্টিফিকেট আছে, আধুনিক চোরারা গেজেটেড চোরা! তারা সুট-টাই পরে এসি ঘরে বসে দিনেদুপুরে কলমের খোঁচায় বুক ফুলিয়ে লাখো কোটি টাকা চুরি করে।
আসলে চুরি করাটাও একটা আর্ট। নিপুন নিখুঁত চুরি করতে ট্যালেন্ট লাগে। এটাকে আমার নিজস্ব থিউরি ভেবে ভুল করবেন না। বাণী চিরন্তনীটি জ্ঞানীগুণী মুরব্বিরা বলে গেছেন, ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা’।
তত্ত্বকথা থাক আসল ঘটনা বলি। দিন দুই আগে আমার কর্তা অফিসে গিয়েই টেলিফোন করল। তেনার নাম্বার দেখেই আমি মনে মনে দোয়া ইউনুস পাঠ করলাম। না জানি অফিস যাবার পথে এক্সিডেন্ট করে হাত পা কিনা কি ভেঙে বসে আছে। আমি হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তার উচ্ছাসিত কন্ঠ, আজ অফিসে আসার সময় একটা চোর ধরা পড়েছে আমাদের পাশের বিল্ডিং এর নিচে।
আমিও অানন্দে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওমা তাই? কি কি নিয়েছে ? সোনাদানা নাকি নগদ ক্যাশ? আলমারি ভেঙেছে নিশ্চয়ই? ওর পিছনে গ্যাঙ আছে হয়তো, নইলে সাহস কি করে হয়?
কর্তা হতাশ গলায় বলল, আরে না। চুরি করেছে লেট্টিনের অপ্রজনীয় টুকরো পাইপ আর বেঁচে যাওয়া কিছু সেনিটারি ফিটিংস। ব্যাটা ওগুলো ভাঙ্গারির দোকানে বেচে দিবে ভেবেছিল।
ব্যাস এটুকুই। তাহলে মনেহয় ছিটকে চোর। আগ্রহ হারিয়ে ফেলা গলায় জানতে চাইলাম, তারপর কি হল?
আরে না না। বেচারা পেশাদার চোর না, স্যানিটারি মিস্ত্রী। হয়তো খুচরো জিনিস চুরি করেছিল দুটো বাড়তি পয়সার লোভে। এখন বিল্ডিং এর নিচে বেঁধে রাখা হয়েছে, সন্ধ্যায় চোরের বিচার হবে বলে তিনি ফোন কেটে দিলেন।
বহুদিন পর একটা চুরির খবর শুনলাম। কিন্তু ঘটনার মধ্যে কোন ইন্টারেস্টিং ব্যাপার নেই, থ্রিলার নেই, এডভেঞ্চার নেই। ধুর্ ছাতা।
তাই এডভেঞ্চার খুঁজতে নস্টালজিক হলাম। আমাদের ছোটবেলায় গ্রামে রাতে মানুষের বাড়িঘরে চুরি হতো। সাধারণত বর্ষাকালে আর আর শীতকালে চোরের উপদ্রব বেড়ে যেত। এই দুই সময় শীতল আবহাওয়ায় মানুষ আরামে গভীর ঘুম দিত। আর তখনি চোর সিং খুচে ঘরে ঢুকে চুরি করে নিয়ে যেত মালপত্র।
হঠাৎ কোন কোন রাতে চোর চোর বলে ডাকাডাকি চিল্লাচিল্লিতে আমাদের ঘুম ভেংগে যেত। বাড়ির সবাই দ্রুত উঠে টর্চ লাইট, হ্যারিকেন যার যা ছিল সেটা নিয়ে উঠনে নেমে আসত । প্রত্যেকের হাতে থাকত একটা করে গাবের লাঠি (শক্ত মজবুত কাঠ, লাঠি, খুঁটি হিসেবে গাব গাছের ব্যবহার গ্রামে প্রসিদ্ধ) । তখনকার দিনে প্রত্যেকের ঘরেই একটা দুটো লাঠি সাইজ করা থাকত চোর পিটানোর জন্য। কোন বাড়িতে চোর এলে তারা চোর চোর বলে চিৎকার করে আশেপাশের এলাকার মানুষ সজাগ করে দিত। সে রাতে আর কারো ঘুম হতোনা। জোয়ান ছেলেপুলেরা বাড়ির চারদিকে পাহাড়া দিত আর বুড়োরা উঠনে বসে চোর নিয়ে তাদের স্মৃতিচারণ করত। সেসব গল্প শুনে ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিত। আওয়াজ পর্যন্ত করতে ভুলে যেতাম। ভয়ে টয়লেটেও যেতাম না, চেপে রাখতাম।
পরদিন সকালে একান ওকান পাঁচ কান হয়ে শুনতে পেতাম অমুক বাড়িতে গতকাল রাতে চুরি হয়েছিল।
চোর এসে রেডিও, টিভি, সোনাদানা, ট্রাঙ্কসহ নতুন শাড়ি লুঙ্গি, টাকা পয়সা এসব চুরি করে নিয়ে গেছে। আরেক টাইপের নিম্নমানের চোর ছিল যারা থালা-বাসন, ঘটিবাটি, পাটা-পুতা, জুতা-স্যান্ডেল এসবও চুরি করত।
কেউ কেউ পরদিন সকালে পালিয়ে যাওয়া চোরের পায়ের ছাপ আবিষ্কার করে সবার আলোচনার মধ্যমনি বনে যেত। খোয়া যাওয়া জিনিসপত্র ফেরত পাওয়া যায়নি ,চোর ধরা সম্ভব হয়নি; তাতে কি হয়েছে, চোরের পায়ের ছাপ তো পাওয়া গেছে! তারপর কয়েকদিন ধরে গ্রামের চায়ের দোকানে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা করে বয়স্ক পুরুষদের অলস সময় কাটতো।
তবে আমার নানাবাড়ির ব্যাপার স্যাপার ভিন্ন। সে বাড়িতে সহজে চোর আসত না। যদি ভুল করেও কেউ ঢুকে পড়ত তবে তার আর রক্ষা নাই। বড় বাড়ি। অনেক লোকজন। সবসময় ব্যাচে ব্যাচে জোয়ান মর্দ পোলাপান থাকেই। তারা চোরকে দৌড়ানি দিয়ে যে করে হোক ধরবেই। তারপর ধরে এনে কাচারি ঘরে বেঁধে রাখা হত তিন দিন, চারদিন। বিচার হত, এমন মার দেয়া হতো যে বাপের নাম ভুলে যেত। কোনদিন আর এমুখো হতনা। তাই আশেপাশে যত চোর ছিল, কোনদিন সে বাড়ি থেকে একটা সুইও চুরি করার দুঃসাহস করত না।
নানুর মুখে চোরের কত গল্প শুনেছি। একবার নাকি একটা চোর ধরে ছেলেপুলেরা তিনদিন পর্যন্ত উৎসব করে চোর পেটাচ্ছিল ।
এদিকে চোরের বৌ চুপিচুপি এসে নানুর পা চেপে ধরলো। কিছুতেই পা ছাড়েনা। নাকফুল খুলে নানুর হাতে দিয়ে কান্নাকাটি করতে লাগলো। তার কাছে দেবার মত আরতো কিছু নেই, তাই নাকফুলের বিনিময়ে যেন তার স্বামীকে ছেড়ে দেয়া হয়। নইলে যে মানুষটা মার খেতে খেতে মরে যাবে।
মাস্টার সাহেবকে (আমার নানা) অনুররোধ করার সাহস নেই, তাই তার স্ত্রীর পায়ে ধরে অনুনয় বিনয় করছে।
মাস্টার সাব এ বাড়ির মুরুব্বী। বিচার সালিশ তিনিই করেন। আজ তিনি স্কুল থেকে ফিরে এলে সন্ধ্যায় চুরির বিচার করা হবে। কিন্তু ততক্ষণ লোকটা বাঁচবে কিনা কে জানে। তিন দিন ধরে উপোস, তার উপর বেলায় বেলায় মার তো আছেই।
নানু তখন বাড়ির ছেলেদের মধ্যে জেষ্ঠ্য শাহে আলমকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, চোর খালি বাইন্ধা পিডাইলেই হইবে? দুইডা দানা পানিও তো প্যাডে দেয়া লাগে। চোরারে আমার রান্ধনঘরে আইন্না দে, মরার আগে দুইডা ভাত খাইয়া মরুক।
চাচীজানের কথা তো আর ফেলে দেয়া যায় না। চোরের হাত পায়ের বাধন খুলে নানুর রান্নাঘরে এনে দেয়া হল। মারের চোটে কি অবস্থা করেছে, মুখের দিকে তাকানো যায় না। নানুর খুব মায়া হল। সে চোরকে খাইয়ে দাইয়ে তার বৌয়ের সাথে ছেড়ে দিল।
কার কি বলার আছে? একটা বদনি চুরির অপরাধে তিনদিন ধরে বেঁধে পিটানোর পর আর বিচারের বাকি থাকে কি? বিচার না করে ছেড়ে দেয়ায় চ্যাংরা ছেলেপুলেরা কিছুটা মনক্ষুন্ন হলেও চাচীজানের মুখের উপর কথা বলার সাহস কারো নেই।
আরও মজার একটি চুরির ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমি তখন খুব ছোট, দাদাভাইয়ের কাছে ঘুমাতাম। দাদাভাইয়ের হলুদ কম্বল মুড়ি দিয়ে তার মুখে চোরের গল্প শুনতে শুনতে কোন এক বর্ষার রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি সেই বয়সে কল্পনায় চোরকে মানুষ ভাবতে পারতাম না। শিয়াল গোছের কোন প্রানী ভাবতাম। ঘুমানোর আগে দাদাকে বললাম চোর এলে আমাকে যেন জাগিয়ে দেয়া হয়। আমি চোরের লেজ টেনে ধরবো, যাতে ব্যাটা পালাতে না পারে।
সে রাতে সত্যিই চোর এসেছিল। কিন্তু কেউ আমাকে চোরের লেজ টেনে ধরার জন্য জাগিয়ে তোলে নি। পরদিন ঘুম থেকে জেগে জানতে পারলাম, চোর চুরি করতে এসে উল্টো তার নিজের জিনিস ফেলে গেছে। আমার ছোট কাকা টের পেয়ে গিয়েছিল বলে চোর তড়িঘড়ি করে পালিয়ে নিজের প্রাণ বাচিয়েছে। চোরের ফেলে যাওয়া পোটলার মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল একটি নতুন লুঙ্গি, একটি তিন ব্যাটারির টর্চ লাইট, একটি দিয়াশলাই বক্স আর এক প্যাকেট আকিজ বিড়ি। দু’চারটে বিড়ি খেয়েছিল হয়তো, বাকি পুরাটা প্যাকেট ভরা আছে। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছিল একটি পুরাতন চামড়ার মানিব্যাগে তিন‘শ তের টাকা।
যে যায়গায় সিং খুঁচে চোর ঘরে ঢুকেছিল সেখানে মাটি দিয়ে মেরামত করতে করতে দাদিকে দেখলাম চোরকে শ্বাপ-শাপান্ত করছে। দাদা অস্থির হয়ে আশেপাশের গ্রামের লোকদের খবর পাঠালেন কারও বাড়িতে গতরাতে চুরি হয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য। তাহলে তারা যেন এসে চুরি যাওয়া মালামাল সনাক্ত করে নিয়ে যায়। গ্রামজুড়ে হাসি তামাশার রোল। এমন কথা কেউ কখনো শুনেছে? চুরি করতে এসে চোর তার নিজের পোঁটলাই ফেলে গেছে, কি অদ্ভুত কান্ড।
দুদিন পর এক মুরব্বি লোক এসে তার চুরি যাওয়া লুঙ্গি আর টর্চ লাইট সনাক্ত করতে পেরে নিয়ে চলে গেছে। তবে মানিব্যাগ তার ছিল না। দাদা বলেছিল আপনার না হইলেও নিয়া যান, যদি কেউ তালাশ করে তারে দিয়া দিয়েন। কিন্তু লোকটা অন্যের মানিব্যাগের দায়ভার নিতে অস্বীকৃতি জানায়। কি আর করা। আমার দাদা মাসখানেক অপেক্ষা করে মানিব্যাগের মালিক না পেয়ে টাকাগুলো মসজিদে দিয়ে দেন। আজ সেইসব দিনগুলো কেবল স্মৃতি। কোথায় সে দিন, কোথায় সেই মানুষ!
সারাদিন উত্তেজনা চেপে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যায় কর্তা বাসায় ফিরলে বললাম, চলো নিচে থেকে হেঁটে আসি আর চোরের কি বিচার হল জেনে আসি। বেঁধে রাখা একটা আস্ত চোর দেখব ভেবে মনেমনে পুলকিত হচ্ছিলাম। জীবনে বহু চুরির গল্প শুনেছি , কিন্তু কখনো সশরীরে চোর দেখিনি।
তো দুজনে মিলে গেলাম চোর দর্শনে। আমাদের বা পাশের দশতলা বিল্ডিংয়ের নাম নিশ্চিন্ত নিবাস। সেখানেই ধরা খেয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আটক রয়েছে চোর বাবাজী।
পাশের বিল্ডিং আমাদের আসা-যাওয়া ছিল আগে থেকেই। ঐ বিল্ডিংয়ের তিন তলার ফ্লাটে আমার কর্তার এক কলিগ থাকত। দারোয়ানকে দেখলাম গেটের বাইরে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে। আমাদের দেখে সালাম দিল। জিজ্ঞেস করলাম চোর কোথায়?
সে জানালো চোরকে তার বাসায় ভাত খাওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে কিছুক্ষন আগে। খেয়ে ফিরে এলে বিল্ডিং সোসাইটি বিচারে বসবে।
উহ্ , একটুর জন্য মিস হয়ে গেল। চোরের দর্শন না পেয়ে খানিক হাঁটাহাঁটি করে গোমড়া মুখে বাসায় ফিরে এলাম। আগে চোর ধরলেই উড়াধুরা মাইর দেয়া হত। আধুনিক যুগে চোরের কি শাস্তি দেয়া হয় জানার জন্য মনের মধ্যে আকুপাকু করতে লাগল। সারারাত ভালো ঘুমই হলনা।
পরদিন সকালে আমাদের দারওয়ান বাদশা মিয়াকে ইন্টারকমে ফোন দিয়ে চোরের কি বিচার হল জানতে চাইলাম। বাদশা মিয়া জানাল সে বিচারের বিষয়ে কিছুই জানেনা।
আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। বদের হাড্ডি দারোয়ান; পাশের বিল্ডিং এ চুরি হলো, চোরের কি বিচার হল সে কিছুই জানেনা। যদি আশেপাশের কোন খবরই না রাখবি তবে তোকে মাসে মাসে বেতন দেই কি জন্য? সবুর কর, সোসাইটিতে নালিশ করে যদি তোর চাকরি না খাই।
দমে যাবার পাত্রীতো আমি নই। বিকেলে নিশ্চিন্ত নিবাসে তিন তলার ভাবির বাসায় গেলাম। কি খবর আপনাদের? শুনলাম আপনাদের বিল্ডিং এ নাকি চুরি হয়েছে? নিশ্চিন্ত নিবাসেই যদি নিশ্চিন্তে না থাকা যায়, কি সাংঘাতিক কথা! তাই খবরাখবর নিতে এলাম বলে আলাপ জুড়ে দিলাম।
আর বলবেন না ভাবি। আমাদের পাঁচতলার ফ্লাটের স্যানিটারি কাজ করছিল লোকটা, আস্ত একটা চোর। কাজ শেষ করে কিছু পাইপের ফিটিংস বাড়তি ছিল। সেগুলো চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল বেচে দিতে। আপনার ভাই তো আবার দয়ার সাগর, সন্ধ্যায় দু’চারটি থাপ্পর দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিনিময়ে ছেড়ে দিল। পুলিশ টুলিশের ঝামেলায় আর গেল না।
আমি মনে মনে ভাবলাম কয়েকটি প্লাস্টিকের ফিটিংসের আর কয়টাকা দাম হত বিক্রি করলে। বড় জোর পাঁচ সাত‘শ টাকার বেশি না। সেই জিনিসের জন্য পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা!
ভাবির এ বিষয়ে আগ্রহ নেই দেখে আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। তিনি বারবার তার গলার সোনার চেইনে হাত বুলাতে লাগলেন। আমি সৌজন্যতা করে বললাম ভাবি আপনার চেইনের ডিজাইনটা তো খুব সুন্দর। তিনি হেসে বললেন, কাল অফিস থেকে ফেরার পথে আপনার ভাই নিয়ে এসেছে এই চেইনটা আর একজোড়া কানের দুল। বসেন, আপনাকে এনে দেখাই বলে তিনি দুল আনতে ভেতরে চলে গেলেন।
আমি একা সোফায় বসে মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম আজকের তারিখ কত? পঁচিশ থেকে সাঁতাশের মধ্যেই হবে। একই অফিসে একই পজিশনে চাকুরি করে আমাদের যেখানে মাসের শেষ কটা দিন খুব হিসেব করে চলতে হয়, সেখানে তারা মাসের শেষেও কি করে গয়না কেনে আমার ছোট মাথায় ধরে না। অবশ্য তাদের অবস্থা আগে থেকেই আমাদের চেয়ে এগিয়ে। আমরা এখনো ভাড়া বাসায় থাকি আর তাদের নিজেদের কেনা দু’দুটো ফ্লাট আছে।
উপচে পড়া হাসি মুখে করে কানে নতুন দুল, গলায় নতুন চেইন পরে ভাবি আমার সামনে এসে বসলেন। তাকে দেখে হঠাৎ আমার বহু বছর আগে দেখা একরাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমি কলেজের ছাত্রী। একদিন ক্লাস শেষে করে নানুবাড়ি তে গেলাম। গিয়ে দেখি নানু ময়লা কাপড়চোপড় পরা এক মহিলার সাথে কথা বলছে। মহিলাটি আমাকে দেখে নতুন বৌয়ের মত দেড় হাত লম্বা ঘোমটা টেনে দিল। আমাকে দেখে নানু তাকে রুক্ষ ভাষায় চলে যেতে বলল ঠিক ই কিন্তু মহিলার আঁচল ভরে চাল, মুড়ি, পান, সুপারি এসব দিয়ে দিল। ভিক্ষুক হলে নানু কখনো তাকে রুক্ষ গলায় তাড়িয়ে দিত না। রহস্যের গন্ধ পেয়ে রাতে নানুকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কে? নানু আমাকে ভাত বেড়ে দিতে দিতে বলল, তুই চিনবি না।
আমি বললাম চিনিয়ে দাও। নানু কিছুটা বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে বলল, ঔজ্জা চোরার নাম শুনছিস ? তার বৌ।
হেসে বললাম, আচ্ছা। চোরের বৌ চুন্নী। তো চুন্নীর সাথে তোমার কি? তোমার বান্ধবী নাকি?
নানু ক্ষেপে গিয়ে বলল, বজ্জাতি বন্ধ। তারাতারি খেয়ে দেয়ে ঘুমাইতে আয়, রাইত বাজে নয়টা। রাত নয়টা নানুর কাছে গভীর রাত। কি আর করা; নয়টার দিকে গভীর রাতে শুতে গেলাম নানুর সাথে।
বর্ষা বৃষ্টির রাত। কাঁথা মুড়ি দিয়ে যাবুথাবু হয়ে শুয়ে আছি। নানুর গা থেকে সুরভী জর্দার অদ্ভুত মিষ্টি একটা ঘ্রাণ বের হচ্ছে। আমার ঘুম আসছেনা। নানুকে জিজ্ঞেস করলাম, নানু এই মহিলাই কি সেই মহিলা?
-হুম।
বহু বছর আগে ইনিই চোর স্বামীকে বাঁচাতে নিজের নাকফুল খুলে নানুর হাতে দিয়েছিল। নানু সে নাকফুল না রেখেই তাকে সাহায্য করেছিল। মহিলাটি সেকথা আজও মনে রেখেছে। কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে মাঝে মধ্যে দুপুরের পর যখন বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন এক আঁটি কচুর লতি বা ঢেঁকিশাক তোহফা নিয়ে চুপিচুপি দেখা করতে আসে। চোরের বৌ নানুর কাছে আসাতে নানু খুব বিব্রতবোধ করেন কেউ জেনে গেলে।
আবার জিজ্ঞেস করলাম, নানু ঔজ্জা চোরা কি বেচে আছে?
-না। কেন?
-এমনিই। দেখতাম আরকি।
-তুই দেইখা কি করবি ? বিয়া ববি নি?
চোরের বৌকে বান্ধবী বলাতে বুড়ি চটে গিয়েছিল তার প্রতিশোধ নিয়ে নিল।
নানুকে জড়িয়ে ধরে হেসে বললাম, হলে তো খারাপ হতনা। কত মেয়ে চোরের বৌ হবার আশায় লাইন ধরে বসে থাকে। আজকাল চোরের বৌ হতেও কপাল লাগে। আমার কি সেই সৌভাগ্য আছে?
নানু ঝাড়ি দিয়ে বলল, ঘুমা। রাইত বিরাইতে কিসব আলিঝালি কতা !
আমি কাঁথা জড়িয়ে চুপ করে ঘুমিয়ে গেলাম। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, আমি চোরের বৌ। ঝড় বৃষ্টির রাতে কুপি জ্বালিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে স্বামীকে ভাত বেড়ে খাওয়াচ্ছি। তিনি খাওয়া শেষ করে গায়ে তেল মাখছেন চুরি করতে যাবেন বলে। আমি চোখে গাঢ় কাজল দিয়ে দাওয়ার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছি তাকে প্রেমময় বিদায় জানাতে। চোর স্বামীটি কাজে যাবার আগে আমার হাত ধরে জিজ্ঞাসা করল, সোনা বৌ তোর লইগ্গা কি আনমু?
আমি লাজুক হেসে বললাম, একছড়া সোনার চেইনের বড় হাউস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *