লোকসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ 

রিপন শান ।।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে বঙ্গীয় মুসলিম পরিবারে সংগীতচর্চা ছিল কল্পনার অতীত। সেই সময় স্কুল-কলেজে ছাত্রাবস্থায়, বিভিন্ন সঙ্গীতের আসরে ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আব্বাসউদ্দীন গান শুনে শুনে সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। লোকসঙ্গীত, আধুনিক গান, দেশাত্মবোধক গান, ইসলামী গান ও উর্দু গান গেয়েছেন আব্বাসউদ্দীন। তবে বাংলা লোকসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত।
আব্বাসউদ্দীন আহমদ  ছিলেন একজন বাঙালি লোক সঙ্গীতশিল্লী, সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার। সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অফ পারফরম্যান্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন।
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘তোরষা নদী উথাল পাতাল’, কিংবা ‘প্রেম জানে না রসিক কালাচান’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গানের অমরশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ। আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দুগান সবই তিনি গেয়েছেন। তবে পল্লী গানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা আজও অদ্বিতীয়। এই গুণী ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকী ৩০ ডিসেম্বর। ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই মহান সংগীতশিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।
আব্বাসউদ্দীন আহমদ ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আব্বাস উদ্দীন আহমদের পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল। মাতা হিরামন নেসা।  শৈশবে বলরামপুর স্কুলে আব্বাসউদ্দীনের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। এখান থেকে বি.এ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। তার বড় ছেলে ড. মোস্তফা কামাল বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন। মেজো ছেলে মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও একমাত্র মেয়ে ফেরদৌসী রহমান কণ্ঠশিল্পী।
যে কোনো গান একবার শুনেই সুমধুর কণ্ঠে আয়ত্ব করতে পারতেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি প্রথম গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দিন আহমদ। এই গানটি এমন একটি গান যে গান না শুনলে আমাদের সংস্কৃতিতে রোজার ঈদকে ঈদই মনে হয় না।
গজলেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ‘ত্রিভূবনের প্রিয় মুহাম্মদ’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’, ইত্যাদি গান গেয়ে তিনি সমগ্র বাংলার মানুষকে মাতোয়ারা করেছিলেন।
লোকসংগীতের প্রায় সব ধারাতেই আব্বাসউদ্দীনের স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ ছিল। এক সময় ভাওয়াইয়া, চটকা, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, মারফতি, বিচ্ছেদি, মর্সিয়া, দেহতত্ত্ব ও পালাগানের প্রতিটি ক্ষেত্রে আব্বাসউদ্দীন ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ও কবি গোলাম মোস্তফার লেখা অনেক গান গেয়েছেন। সেই সূত্রে এই তিন বিখ্যাত কবির সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের বিশেষ সখ্য গড়ে ওঠে।
শিল্পীজীবনে আব্বাসউদ্দীন ঢাকা-কলকাতাসহ দুই বাংলার ছোট-বড় অনেক শহরে এমনকি গ্রামগঞ্জেও অসংখ্য অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া অগণিত গান গ্রামোফোন রেকর্ড করেছে কলকাতার বিখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ ও ‘মেগাফোন’। বিশ শতকের প্রথমার্ধে রক্ষণশীল বাঙালি মুসলিম পরিবারে সঙ্গীত তথা লোকসঙ্গীতকে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করে তোলার কৃতিত্ব বলতে গেলে আব্বাসউদ্দীনের একার।
ছেলে মুস্তাফা জামান আব্বাসী, মেয়ে ফেরদৌসী রহমান, নাতনীদ্বয় নাশিদ কামাল ও সামিরা আব্বাসী এবং নাশিদ কামালের মেয়ে আরমিন মূসা আব্বাসউদ্দীনের যোগ্য উত্তরসূরি।
সংগীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর ১৯৬০ সালে ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ পুরস্কার, ১৯৭৯ সালে ‘শিল্পকলা একাডেমী’ পুরস্কার ও ১৯৮১ সালে ‘স্বাধীনতা দিবস’ পুরস্কারে ভূষিত হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *