সবাই মিলে জীবন নিয়ে করি হায় হায়

ড. সাইয়েদ মুজতবা আহমাদ খান ।।

‘নিজেদের জ্ঞান গরিমা, দর্শন অথবা দেখা শোনা, কিংবা একদম খোলামেলা- উদার সর্বস্ব লেখা পড়ার মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষা এবং প্রত্যক্ষ জ্ঞান লব্ধ অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ব জগতের চার দিকের পরিবেশ পরিস্থিতির মাধ্যমে যতটুকু বিদ্যা অর্জন করা হয়েছে- তাতে ধর্ম কর্ম ঈশ্বর- আরাধনার প্রয়োজন বেশি একটা উপলব্ধি না করার কারণ সৃষ্টি হওয়ায় কোন অদৃশ্য শক্তি কিংবা অলক্ষিত কোন বিষয় বা সত্তার প্রতি বিশ্বাস বা আস্থা জন্মানো বোকামী বা ছেলে মানুষী বলেই মনে হয়েছে। সুতরাং ধর্ম বা অলৌকিক কোন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বা আকর্ষণ অনুভব করতে মন প্রস্তুত হয় না। তাই বাধ্য হয়েই ধর্মহীনতা বা নাস্তিকতার সবক হজম করতে হচ্ছে। ওপরে উল্লেখিত কথাগুলোর যারা কথক- তারা এক অর্থে ধর্মহীন মানুষ। নাস্তিকতাই তাদের মূল চিন্তাধারা। নিখিল বিশ্বের কোথাও তারা সৃষ্টিকর্তাকে চাক্ষুষ দেখেন না বলে কাউকে প্রভু মানতেই রাজী নয়। তারা সর্বত্রই দেখেন কেবল অন্ধকার এবং কুটিলতা ও জটিলতার সমূহ অক্টোপাশ। নির্মম নিষ্ঠুর মানুষের অবিচার অত্যাচারে ম্রিয়মান ধরা পৃষ্ঠ।

অন্যদিকে বাংলা ভাষার কতিপয় লেখক- বুদ্ধিজীবীর সদম্ভ ঘোষণাঃ আমরা আকৈশোর নাস্তিক। সেই কৈশোর কাল বা অল্প বয়স হতেই ধর্ম কর্মের তেমন একটা ধার ধারিনি। ধর্ম নামক গোলক ধাঁধাঁর প্রতি কোন আকর্ষণ তো নে-ই বরং রয়েছে ধর্ম এবং ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর প্রতি চরম ক্ষোভ ও বিপুল বিদ্বেষ। উপরোক্ত সব কথাবার্তা বা মতামত সম্পর্কে উনমুক্ত বিচার বিশ্লেষণ এবং স্থির গভীর পর্যালোচনা করলে- একটি বিষয় বেরিয়ে আসতে বাধ্য যে, ঐসব নাস্তিক বা ধর্মহীন অধার্মিক মানুষ গুলোর সকল কথা বা বক্তব্যই একে বারে সত্যতো নয়ই বরং সত্যের অপলাপই মাত্র। নিরেট অজ্ঞতা এবং বিবেকহীনতাই ওসব – লাগামহীন বক্তব্য প্রদানে তাদেরকে বাধ্য করেছে। প্রকৃত জ্ঞান ও বিবেকের তুলাদন্ডে যদি ওসব কথাবার্তাগুলো যদি মাপা যায় বা ওজন করা যেত তবে তাদের দাবি ও বক্তব্য ধোপেই টেকেনা বা আদৌ টিকতে পারেনা। অথচ স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগে- ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে এরা কেবল আবোল তাবোল বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন।

এরা ঐসব বক্তব্য ও মতামত প্রকাশ করে কী যে লাভালাভ অর্জন করছেন অথবা কী ধরণের রাজা উজির যে বধ করছেন, কী প্রকারের আত্ম শ্লাঘা যে অর্জন করছেন তা জানা না গেলেও- সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক ধরণের ক্ষতি যে করছেন এতে সন্দেহ নেই মোটেই। ব্যক্তি বা ব্যষ্টির চাইতে সমষ্টির ক্ষতি অপূরণীয়। মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গল, কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ যে তারা করে যাচ্ছেন- তা হলফ না করেও বলা যায়। তবে মঙ্গল ও কল্যাণের হিসেব নিকেশ নিলে শুধু অশ্বডিম্ব ব্যতীত অন্য কিছুর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আমাদের দেশের কতিপয় স্বঘোষিত নাস্তিক বা অধার্মিক কে তো দেখা যায়- বাগাঁড়ম্বরেই পটু, কথার মার প্যাচেই অভ্যস্ত। লাফালাফিই সার। মাঝে মধ্যে দুচার কলম লেখা লেখি চালিয়ে পগারপার হচ্ছেন এবং উল্টা পাল্টা বক্তব্য দিয়ে নাম ফাটিয়ে আবার গা ঢাকা দিতেও কসুর করেন না। কাজের কাজ শুধু নবডংকা এবং গোলমাল বাধানো ছাড়া অন্য কিছু নয়। যুক্তিহীনভাবে আবোল তাবোল বকলেইতো কেল্লাফতেহ হয়ে যায় না। তবে সমাজ রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র একটা অংশকে প্রভাবিত করতে পারেন বলে মনে হয়। এরা নিজেরা যেমন বিভ্রান্ত হয়ে যা ইচ্ছে তাই বকে যাচ্ছেন তেমনি আবার সাধারণ মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে তাদের জীবন ও জীবিকা কে দুর্বিষহ করে তোলেন। সন্দেহ ও অবিশ্বাসের অমূলক ঝড় সৃষ্টি করে নাকানি চুবানি খাওয়ার অপপ্রয়াস চালান। দেখে শুনে মনে হচ্ছে তারা বিশ্বের সেই প্রধানতম খোদাদ্রোহী এবং সর্বকালের সর্বাধিক অহঙ্কারী ও দাম্ভিক ইবলিসের একদম সাক্ষাৎ শিষ্য বা প্রশিষ্যের ভূমিকাই প্রতিপালন অতীব নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাচ্ছেন।

ইবলিশও স্পর্ধা ভরে উচ্চারণ করেছিল, যে আদমের কারণে তাকে তার পরিশ্রম লব্ধ আসন ত্যাগে বাধ্য করা হলো সে আদম ও তার সন্তান মানব জাতির অনিষ্ট সাধন, পথ ভ্রষ্টকরণ এবং মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের আসনচ্যূত করবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে সে কেয়ামত পর্যন্ত। মানুষের পার্থিব এজীবনকে ফূর্তিফার্তি এবং রঙ্গিন রঙ্গঁ মঞ্চে পরিণত করে, চোখে মুখে মোহনীয় গোলক ধাঁধাঁর সৃষ্টি করে আল্লাহর বাতলানো ও তার নবী রাসূলদের দেখানো পথ হতে বিচ্যূত করেই ছাড়বে। গোটা মানব জাতিকে যে কারণে এই মর্তে প্রেরণ সেই কর্তব্য ও দায়িত্ব হতে শত যোজন দুরে সরিয়ে দেয়ার কাজটা সুকৌশলে করে যাবে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া অবধি। সেই চিরন্তন চ্যালেঞ্জ ও প্রতিজ্ঞা প্রতি পালনের অক্টোপাশে আবধ্য হয়েই মনে হচ্ছে আমাদের দেশে নাস্তিক ও ধর্ম বিরোধী সম্প্রদায় উঠেপরে লেগেছেন- কীভাবে মানুষ কে অমানুষ করা যায় কীভাবে মুখরোচক ও চমক সৃষ্টিকারী কথাবার্তার জাল বিছিয়ে- বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা যায়। তাতেই সব লেঠা চুকে যাবে বলে তাদের বদ্ধ মূল ধারণা। দলে দলে গন্ডায় গন্ডায় তাদের অনুসারী শিষ্য প্রশিষ্য তৈরি হয়ে যাবে। তাদেরকে ঠেকায় কে? তবে প্রকৃত পক্ষে ঐসব কেবল ধারণাই মাত্র। অন্তরে পোষিত কল্পনাই শুধু। বাস্তবে ততো নয়।

কিছু মানুষতো বিভ্রান্ত হয় এবং হবে কিছুকালের জন্যে। কিন্তু সবমানুষ সববিবেকবান মানুষেরা সবসব সময়ে ওদের খপ্পরে পড়ে না। পড়েনি পূর্বেও। কিছু মানুষতো ওরকমের থাকাই স্বাভাবিক এবং ছিলও পূর্বে এখনও রয়েছে ভবিষ্যাতেও থাকবে। প্রকৃতিতে যেমন আলোর অস্তিত্ব বিদ্যমান- অন্ধকারও তার স্থানে অবস্থান করবে চিরকাল। সত্য ও মিথ্যা মেকীর দ্বন্দ্বতো চিরন্তন ও শাশ্বত।
ওসব ধর্মবিরোধী লোকজন বর্তমানে বেশ কিছু ব্লগারও সৃষ্টি করে ফেলেছেন। যারা অনবরত ধর্ম বিরোধী, সুরুচীর বিপক্ষে মন্তব্য ও বক্তব্য দিয়ে রীতিমতো গোলমাল বাধাচ্ছেন। অনাকাংখীত পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন। আমাদের দেশ সমস্যা বহুল এবং বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে প্রায় শীর্ষে। সেই দেশের নাস্তিক ও ধর্মবিরোধী কতিপয় নাস্তিক যদি এহেন কর্মের পেছনে লেগেই থাকেন মুক্তকচ্ছ হয়ে, নিরীহ এবং অকাল পক্ক যুব শ্রেণিকে যদি ভ্রান্ত পথের পথিক বানাতেই থাকেন তবে দেশ ও জাতির উপায়টা হবে কী? তাহলেতো দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ গভীর অন্ধকারে পতিত হতে বাধ্য হবে। একদল যেমন উগ্রবাদী জঙ্গী বানানোর কসরত করছে, উজবুক ও উৎকট মানুষ তৈরিতে ইন্ধন দিচ্ছে, মাদকাসক্ত বানানোর নিরন্তর অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে- অন্যদিকে নাস্তিক ও ধর্ম বিরোধী গ্রুপ যদি ‘হটেন্টট্’ ও ‘লাড়েলাপ্পা’ ধরণের জনগোষ্ঠী তৈরির ‘কারখানা’ চালু রাখেন- তবে আমাদের দশাটা হবেকী? ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। এবং প্রতিনিয়তই গলদ ঘর্ম হই। আর এহেন দুয়ো দিকের টানাটানি ও হ্যাচকাহ্যাচকীর মধ্যখানে পতিত হয়ে প্রাণ যে ওষ্ঠাগত প্রায়। এবং এই দশা যে আমাদের ভীষণতম কষায় পরিণত হবে এতে সন্দেহ করি কিভাবে এবং কেমন করে?
সুতরাং সময় ও সুযোগ থাকতেই সজাগ ও সতর্ক হওয়া অতীব আবশ্যক। নচেৎ কঠিনভাবে পস্তানো ব্যতীত গত্যন্তর থাকবে বলে মনে হয় না কোনোভাবেই। এরা এসব নাস্তিক ও ধর্মহীন মানুষেরা জীবনের সকল স্তরেই দেখেন কেবল গাঢ় এবং থিক থিকে অন্ধকার এবং পদে পদে বিপুল সর্ষে ফুল ও বিপত্তি। তাই ধর্মকর্মে তুলেন আপত্তি। ধর্মের কথা শুনলে ওদের পিত্ত জ¦লে যায়। মানুষের মনে হতাশা ও দুর্দশার অপরিমেয় চিত্রই তুলে ধরেণ শুধু। নিজেদের জীবনে নির্বিকার চিত্তে দেখেন শুধু বিপর্যয় ও বিভীষিকা। তাই হতাশাগ্রস্ত জীবনকে সান্ত¡না দেয়ার জন্যে অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করেন নাস্তিকতার গরল পথে আসার জন্য। সরল প্রকৃতির মানুষেরা ওদের খপ্পরে পড়ে বিভ্রান্ত হন- কেউ কেউ আবার ওদের কে গুরু ভেবে সকলি বির্সজন দেন। মিষ্টি কথায় ভেলকী বাজীর প্রলোভনে এরা ইহ-পরকালই বিনষ্ট করতে দ্বিধা করেন না। একেই বলে নিজ পায়ে কুড়াল মারা আরকী। ভাবখানা এই- আমরাতো গেছি তোরাও আয়, সবাই মিলে জীবন নিয়ে করি হায় হায়।
এসব হতাশাগ্রস্থ মানুষেরা যদি নিজেদের শুধু দেহ সৌষ্টব সম্পর্কেই গভীর চিন্তাভাবনা করতেন- তবে স্পষ্টই দেখতে পেতেন- তাদের দেহ শরীরের কলা কৌশল এবং একটি বিশেষ কারখানা চালু – এ কারখানা কে চালু করেছেন? কীভাবে সুচারুরূপে নির্মিত হয়ে মায়ের পেট থেকে বের হয়ে আসে- সে স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার চলছে কার ইঙ্গিত ইসারায়? কোথায় বাক যন্ত্র, কোথথেকে আসে সুমধুর সুললিত কথা ও সুর? অথবা মাথার উপরের অসীম আকাঁশ রাজ্য- সেখানে কতো কোটি তারকা নক্ষত্র- আপন পথে ঘুরছে নিজ নিজ কক্ষপথে- প্রদক্ষিণ করছে কর্তব্য সাধনে। কে করাচ্ছেন এসব? এ কার নির্দেশ ও পরিচালনায় মহাবিশে^র সৌরজগতের এসব চন্দ্র- সূর্য তারকারাজী আবর্তিত হচ্ছে? সেই মহান সত্তার যদি সঠিক পরিচয় ও পরিচিতি জানা থাকতো ওদের- তবে ঐসব জ্ঞানহীন প্রজ্ঞাহীন মানুষগুলো আবোল তাবোল বকা ও বলার সুযোগ ও সাহস পেতোনা। সমূদয় সৃষ্টি ও স্রষ্টা সম্পর্কে চরম অজ্ঞতাই এসবের প্রকৃত কারণ। ছিটে ফোটা, দুচার কলম অক্ষর জ্ঞান শিখেই ওরা ভাবে কি হলুম রে!
অথচ বিশ্বের অগনিত মহাবিজ্ঞ বিজ্ঞানী, মহান দার্শনিকরা মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টার অস্তিত্বে প্রগাঢ় ভাবে বিশ্বাসি হয়ে জীবন ধন্য করেছেন এবং তার সমীপে আত্ম সমর্পিত হয়ে মানব জন্ম সার্থক করেছেন কত শতে তার কোন ইয়াত্তা নেই। কিন্তু আমাদের দেশের বিজ্ঞ সব অধার্মিক ও নাস্তিক সম্প্রদায় যেভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে গদা ঘুরাচ্ছেন তা দেখে তাদের বালখিল্যতারই পরিচয় প্রকটভাবে প্রকাশিত হচ্ছে- এবং অভিশপ্ত হয়ে এ ধরাধাম হতে বিদায় নিচ্ছেন ঠিকই তবে পেছনে ফেলে যাচ্ছেন দেশ ও জাতির সঙ্গে করা অবিমৃশ্যকারিতার বিচিত্র সব খেল তামাশার ছাপচিত্র। যা ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে হবে পথ ভ্রষ্টহবার, অধঃপাতে যাওয়ার মোক্ষম ফাঁদ। যার কুহক হতে বাঁচা অনেকের পক্ষেই অসাধ্য ঠেকবে বলে প্রতীয়মান হয়। আর যারা এহেন কুহকের শিকার হয়ে মানব জন্মকে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করে তুলবে- তাদের অভিশাপের বিষাক্ত তীর নিক্ষিপ্ত হবে পূর্বসূরী সব নাস্তিক ও ধর্মহীন মানুষগুলোর দিকে। যাদের দেখানো পথও মতে উত্তরসূরীরা দীক্ষিত হয়ে চির অন্ধকারে হারিয়ে গেলো, হারিয়ে যায় যুগে যুগে কালে কালে।

ড. সাইয়েদ মুজতবা আহমাদ খান

সাবেক সহকারী অধ্যাপক, দৌলতখান সরকারি আবু আবদুল্লা কলেজ, ভোলা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *