রিপন শান ।।
২০২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন নরওয়ের লেখক ইয়োন ফসে। ০৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টায় সাহিত্য শাখায় চলতি বছরের নোবেলজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করেছে সুইডেনের রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি।
.
ফসের লেখা নাটক ও গদ্যের প্রশংসা করে সুইডিশ একাডেমি বলেছে, যেসব কথা অনুচ্চারিত থেকে যায়, সেগুলো লেখনীতে তুলে এনেছেন তিনি। তাঁর লেখা বিশ্বজুড়ে নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
পুরস্কারের ১০ লাখ ডলার পাবেন নরওয়েজিয়ান এই লেখক। গত বছর ফরাসি লেখক অ্যানি এরনো এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। ইয়োন ফসের জন্ম ১৯৫৯ সালে। ৪০টির মতো নাটক লিখেছেন তিনি। এর বাইরে অনেকগুলো উপন্যাস ছাড়াও প্রবন্ধ, কবিতা, শিশুতোষ বই ও অনুবাদের বই রয়েছে ইয়োন ফসের। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান নাট্যকারদের একজন তিনি। সুইডিশ একাডেমির বর্ণনায়, বর্তমানে বিশ্বে যাঁদের নাটক সবচেয়ে বেশি মঞ্চস্থ হয়, তাঁদের মধ্যে একজন ইয়োন ফসে। গদ্যের জন্যও তাঁর খ্যাতি ক্রমে বাড়ছে।
.
নরওয়েতে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাকে শৈল্পিক সুষমায় লেখনীতে তুলে ধরেছেন ইয়োন ফসে। সাহিত্যকর্মে মানুষের উদ্বেগ ও দোদুল্যমানতার বিষয়গুলোকে উপস্থাপনের জন্য তিনি প্রশংসিত হয়ে থাকেন। নোবেল কমিটি বলেছে, কোনো একক লেখার জন্য নয়, বিপুল সাহিত্যকর্মের জন্য ইয়োন ফসেকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তাঁর সাহিত্যকর্মের কোনো ছোট তালিকা করা যায় না এবং তা করার চেষ্টাও অত্যন্ত কঠিন।
ইয়োন ফসের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে তাঁর উপন্যাস রয়েছে ‘বোটহাউস’ (১৯৮৯) এবং ‘মেলঙ্কোলি’ ১ ও ২ (১৯৯৫-১৯৯৬)। সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৮৩ সালে রুডট, স্ভার্ট উপন্যাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে। আত্মহত্যার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা এই উপন্যাসই তাঁর পরবর্তী সাহিত্যকর্মের সুর বেঁধে দেয়।
.
নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান আন্দ্রেস ওলসন তাঁকে বর্ণনা করেছেন অনেক দিক দিয়ে দারুণ এক লেখক হিসেবে। তিনি বলেছেন, ‘তাঁর বিশেষত্ব হচ্ছে, লেখায় মানবঘনিষ্ঠতা। তা আপনার গভীরতর অনুভূতিগুলোকে স্পর্শ করে যাবে—উদ্বেগ, নিরাপত্তাহীনতা, জীবনের অর্থ ও মৃত্যু এ রকম নানা বিষয় প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেককে যেগুলোর মুখোমুখি হতে হয়। য়’ তাঁর লেখা পড়ার সময় তা আপনাকে গভীরভাবে স্পর্শ করবে এবং তাঁর একটি সাহিত্যকর্ম পড়লে আপনাকে আরও পড়তে হবে।
.
ওলসন লিখেছেন, ‘এদিক দিয়ে আমি মনে করি, তিনি বহুদূরে পৌঁছেছেন এবং তিনি যা যা লিখেছেন, সেগুলোর প্রতিটিরই সর্বজনীন প্রভাব রয়েছে। সেটা নাটক, কবিতা বা গদ্য তা কোনো বিষয় নয়, মানবপ্রকৃতির মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি এর সমান আবেদন রয়েছে।’
যাঁরা ইয়োন ফসের লেখার সঙ্গে পরিচিত নন এবং জানেন না কোন বইয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর লেখা পড়া শুরু করা উচিত, তাঁদের উদ্দেশে ওলসন বলেছেন, তাঁর সব কটি নাটকই অত্যন্ত সুখপাঠ্য।
ইয়োন ফসের গদ্যের মধ্যে ২০০০ সালে প্রকাশিত উপন্যাসিকা ‘মর্নিং অ্যান্ড ইভিনিং’ একটি চমৎকার গ্রন্থ এবং ‘সেপটোলজি’ নামে তাঁর সাতটি পরস্পরযুক্ত উপন্যাসও দারুণ বলে উল্লেখ করেছেন নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান।
.
১৯০১ সাল থেকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হয়। চলতি বছর এ শাখার ১১৪তম পুরস্কার জয় করলেন ইয়োন ফসে। বুধবার পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে জুরিদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ইয়োন ফসে তার নাটক এবং গদ্যসাহিত্যের মাধ্যমে তাদের ভাষা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, যারা কথা বলতে অক্ষম।’ সাধারণত প্রতি বছর একজন সাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কারের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করে নোবেল কমিটি। ইতিহাসে মাত্র চারবার এই পুরস্কার একাধিকজনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
.
নাটক, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ— এক কথায় সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় বিচরণ করেছেন জন ফসি। তবে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন নাটক ও উপন্যাসে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন নাট্যশালায় যেসব পশ্চিমা নাট্যকারদের নাটক সবচেয়ে বেশি প্রদর্শিত হয়, ইয়োন ফসে তাদের মধ্যে একজন।
সাহিত্যিক থিম হিসেবে ‘অমীমাংসা’র প্রতি ঝোঁক রয়েছে ফসের। বিশেষ করে তার উপন্যাসের ক্ষেত্রে দেখা যায়— চরিত্রগুলো প্রায় সময়ই এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছায়, যার কোনো প্রথাগত সুনির্দিষ্ট সমাধান নেই। ১৯৮৫ সালে প্রকাশ হওয়া তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘স্টেংড গিটার’ থেকে এই থিমে সাহিত্য রচনা শুরু করেন তিনি।
.
ফসের আগে ১১৩ জন সাহিত্যে নোবেল জয় করেছেন। এই জয়ীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৭ জন। ফসের পূর্বসূরী, অর্থাৎ ২০২২ সালে যিনি নোবেল পেয়েছিলেন, তিনি অবশ্য একজন নারী ফ্রান্সের সাহিত্যিক অ্যানি এরনো।
সবচেয়ে কম বয়সে সাহিত্যে নোবেল জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ব্রিটেনের ঔপন্যাসিক ও ছোটো গল্পকার রুডইয়ার্ড কিপলিং। বিশ্ববিখ্যাত শিশুসাহিত্য ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ লেখার স্বীকৃতি হিসেবে মাত্র ৪১ বছর বয়সে নোবেল জয় করেন কিপলিং।
সবচেয়ে বেশি বয়সে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন ব্রিটিশ-জিম্বাবুইয়ান সাহিত্যিক ডরিস লেসিং। ২০০৭ সালে ৮৭ বছর বয়সে নোবেল জয় করেন তিনি। সাহিত্যে নোবেলজয়ীদের পদকের পাশাপাশি পুরস্কার হিসেবে নগদ ১০ লাখ ডলার প্রদান করা হয়। ইতিহাসে ৩ জন সাহিত্যিকের নাম পাওয়া যায়, যারা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সাহিত্যের এই সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার। তারা হলেন— আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জ্যঁ পল সাঁত্রে এবং টনি মরিসন।
.
নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করেন সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে প্রতিবছর চিকিৎসা, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। গবেষণা, উদ্ভাবন ও মানবতার কল্যাণে যাঁরা অবদান রাখেন, তাঁরা পান বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার।