স্মৃতিতে কবি মতিউর রহমান মল্লিক

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

ছোটবেলা থেকেই কবি মতিউর রহমান মল্লিকের লেখা গান শুনে ইসলামী সংস্কৃতির প্রতি অনুপ্রাণিত হই। ক্যাসেট প্লেয়ারের শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে ভেসে আসা তাঁর গানগুলো আমাদের বেশ প্রেরণা যোগাতো। মনে পড়ে ক্লাস এইটে পড়ার সময় মল্লিক ভাইয়ের লেখা গানের সংকলন ‘ঝংকার’ ক্রয় করি। এরপর ক্যাসেট বাজিয়ে সেই সব গানের সুর আয়ত্ব করার অবিরাম চেষ্টা চলে আমাদের। সেই থেকে ক্রমেই মলিøক ভাইয়ের ভক্ত হয়ে যাওয়া—।
মল্লিক ভাইকে প্রথম দেখি ১৯৯৮ সালে ঢাকার আল ফালাহ মিলনায়তনে। সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ (সসাস) আয়োজিত একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আল কুরআনের দারস দিয়েছিলেন তিনি। শুরাহ আশ্ শোয়ারা থেকে দেয়া সেই দারসের বাণীগুলো এখনো আলোড়িত করে আমাদের। একই বছর ‘প্রত্যাশা প্রাঙ্গন’এ গিয়ে মল্লিক ভাইয়ের সাথে পরিচিত হই। বরিশালের হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীতে তখন চলছিল চরম নেতৃত্ব সংকট। ডা. এহসানুল কবীর হেরাররশ্মির সফল পরিচালক হিসেবে বিদায় নেয়ার পর একরকম নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে হেরাররশ্মির কার্যক্রম। বিষয়টি নিয়ে মল্লিক ভাইকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখলাম।
সেদিন হেরাররশ্মির অনেক ঐতিহ্যের কথা শোনালেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। সংগঠনটির নামকরণ, প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক মহিউদ্দিন বাকী, মোঃ আবদুল হাই সহ অনেক পুরনো শিল্পীদের সম্পর্কে নানা তথ্য পেয়েছি মল্লিক ভাইয়ের কাছে। মূলত বরিশালের এ সাংস্কৃতিক সংগঠনটি মল্লিক ভাইয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই গড়ে উঠেছিল। আমি তখন হেরাররশ্মির সামান্য একজন সংগঠক। মল্লিক ভাই সেদিন বললেন- ‘সংস্কৃতিকে মনে প্রাণে ভালোবেসে নি:স্বার্থভাবে কাউকে না কাউকে এগিয়ে এসে হাল ধরতে হবে, তোমরা এখন যারা হেরাররশ্মিতে আছো চেষ্টা করে দেখো- হেরাররশ্মিকে আবার চাঙ্গা করা যায় কিনা’ তিনি আরো বললেন- ‘দৃঢ় ঈমান আর আল্লাহর উপর ভরসা রেখে যদি কাজ করো দুনিয়ায় প্রতিদান না পেলেও আল্লাহর কাছে অবশ্যই এর প্রতিদান পাবে’। এমনিভাবে মল্লিক ভাইয়ের সেদিনের কথাগুলো বেশ ইফেক্ট হয়েছিল আমার মনে। সেই থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখার সংকল্প করলাম। এরপর অনেকবারই মল্লিক ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, কথা হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন আরো বেগবান করার জন্য তার যে পেরেশানি ছিল তার প্রতিটি বিষয়ই শেয়ার করতেন আমার সাথে। সেসব স্মৃতিচারণ করে লেখার পরিধি বাড়াতে চাইনা। শুধু কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
২০০২ সালে হেরাররশ্মির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব আসে আমার উপর। ঝিমিয়ে পড়া ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনটি চাঙ্গা করার জন্য শিল্পীদের মান উন্নয়নের পাশাপাশি বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করি। বিশেষ করে প্রায় এক যুগ পর হেরাররশ্মির দ্বিতীয় অডিও অ্যালবাম প্রকাশের উদ্যোগ নেয়ায় শিল্পীদের মাঝে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে আসে। তখন হেরাররশ্মির অর্থনৈতিক সমস্যা থাকলেও সেটা শিল্পীদের বুঝতে না দিয়ে মল্লিক ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে থাকি। প্রবাসে অবস্থানরত হেরাররশ্মির সাবেক শিল্পী ও সংগঠকদের সাথে যোগাযোগ করে অর্থনৈতিক সমস্যার অনেকটাই সমাধান করে ফেলি। নতুন গান সংগ্রহ, সুরারোপ সহ চলতে থাকে নিয়মিত রিহার্সেল। এক পর্যায়ে ক্যাসেট প্রকাশের জন্য প্রস্তুত পুরো টিম। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের জন্য ঢাকায় গিয়ে শিল্পীরা থাকবে কোথায়? মল্লিক ভাইকে বিষয়টি জানাতেই তিনি প্রত্যাশা প্রাঙ্গনে শিল্পীদের থাকার ব্যবস্থা করেন। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘নীল আসমান’ অডিও অ্যালবামের মোট ১৪ টি গানের মধ্যে ১৩ গাইবেন হেরাররশ্মির নিজস্ব শিল্পীরা আর বাকী একটি গান গাইবেন মল্লিক ভাই। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিয়েছেন তিনি। কিন্তু রেকর্ডিং শুরুর কয়েকদিন আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ভীষণ চিন্তিত হয়ে হই আমরা। আমাদের সবকটি গানের রেকর্ডিং শেষ। তবে কি মমল্লিক ভাইয়ের গানটি আমাদের অ্যালবামে যাবেনা! আমাদের মনের অবস্থা দেখে মল্লিক ভাই অসুস্থতার কথা ভুলে গিয়ে বললেন- চলো রেকর্ডিং হবে। বোরহান মাহমুদ কবি মল্লিক ভাইকে সাথে নিয়ে স্টুডিওতে চলে আসলেন। স্টুডিওতে সব শিল্পীকে দেখে মল্লিক ভাই যেন পুরোপুরি সুস্থ। আবেগ মাখা কন্ঠে গাইলেন- ‘জিহাদ করতে চাই আমি জিহাদ করতে চাই, জিহাদ ছাড়া অন্য কোন পথে মুক্তি নাই…..’। এভাবেই প্রকাশিত হলো হেরাররশ্মির দ্বিতীয় অডিও অ্যালবাম নীল আসমান। ক্যাসেটটি প্রকাশের পর হেরাররশ্মির শিল্পীদের মাঝে ফিরে আসে আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহ-উদ্দীপনা।

তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলনে সারাদেশের শিল্পীগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থান লাভ করে হেরাররশ্মি। প্রথম হয় বগুড়ার ‘সমন্বয়’ আর দ্বিতীয় স্থান লাভ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিকল্প’ সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদ। ঢাকার ‘সাইমুম’ লাভ করে চতুর্থ স্থান। সাইমুমের মতো শক্তিশালী শিল্পীগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে বরিশালের হেরাররশ্মির এ বিজয়ে দারুন খুশি হয়েছিলেন মল্লিক ভাই। পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে মল্লিক ভাই বলেছিলেন- ‘সাইমুম কে মনে রাখতে হবে এবং শিক্ষা নিতে হবে যে- ‘ঢাকার বাইরের কয়েকটি শিল্পীগোষ্ঠী এখন আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে’। যাই হোক হেরাররশ্মির এই যে ফিরে আসা এর নেপথ্যের প্রেরণা ছিলেন মল্লিক ভাই।
শুধু হেরাররশ্মিই নয় সারাদেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর প্রতিই ছিল মল্লিক ভাইয়ের হৃদয়ের অসীম টান। ‘সাইমুম’ তো তাঁর নিজের হাতেই গড়া সংগঠন। তাছাড়া তিনি চাইতেন সারাদেশের সব সাংস্কৃতিক সংগঠন নিজের পায়ে দাড়িয়ে যাক।
শিল্পীদের হৃদয়ের গভীর থেকে দিয়ে ভালোবাসতেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। কত শিল্পী-সংগঠককে যে তিনি নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন তার ইয়ত্বা নেই। সারাদেশের শিল্পী সংগঠকরা নিজেরাই এর বাস্তত সাক্ষী।
২০০৮ সালের ১০ এপ্রিল সর্বশেষ বরিশাল সফর করেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। সেসময় পটুয়াখালী সংস্কৃতিকেন্দ্র আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পাশাপাশি বরিশাল বিভাগের সকল সাংস্কৃতিক সংগঠকদের সাথে মতবিনিময় করেন তিনি। এরপর রাতে বরিশালে আমার বাসায় অবস্থান করেন মল্লিক ভাই। ফজরের নামাজের পর সুমিষ্ট ভাষায় কুরআন তেলাওয়াত শেষে বিছানায় শুয়ে তিনি অনর্গল আবৃত্তি করতে থাকেন ফররুখ আহমদের অনেকগুলো কবিতা। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই ‘সাত সাগরের মাঝি’ কিংবা ‘সিরাজুম মনীরা’র মতো কয়েক শ লাইনের দীর্ঘ কবিতাগুলো তিনি কিভাবে এমন টাটকা মুখস্ত করে ফেললেন !

দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ সিডরের পর ২০০৮ সালের ১৭ মে বাগেরহাট শিল্পকলা একাডেমিতে একটি সেমিনারের আয়োজন করে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স। তারা ওই সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য মল্লিক ভাইকে অনুরোধ জানান। কিন্তু মল্লিক ভাই নিজে সেই দায়িত্ব না নিয়ে আমাকে বললেন- ‘তুমিতো সিডরের উপর অনেক রিপোর্ট করেছো, তাছাড়া এ সংক্রান্ত অনেক তথ্য উপাত্ত্বও রয়েছে তোমার কাছে, কাজেই প্রবন্ধটি তুমিই লিখো। আমি বললাম- মল্লিক ভাই লেখক হিসেবে আমি এখনো অনেক জুনিয়র, বরং আমি তথ্য গুছিয়ে দেই আপনিই প্রবন্ধটি লিখে ফেলুন। শেষ পর্যন্ত মল্লিক ভাই এবং আমি যৌথভাবে প্রবন্ধটি লিখলাম এবং অনুষ্ঠানে পড়লাম। ওই প্রবন্ধটি বই আকারেও ছাপা হয়েছিল। প্রবন্ধের সম্মানী বাবদ যে অর্থ দেয়া হয়েছিল তার পুরোটাই আমাকে দিয়ে দেন মল্লিক ভাই। পরে বুঝতে পারলাম- এই প্রবন্ধ এবং সেমিনারের মাধ্যমে আমাকে তুলে ধরাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। একজন মানুষ কতটা উদার হলে নিজের চেয়ে জুনিয়র কাউকে বেশি হাইলাইটস করতে পারেন তার বাস্তব উদাহরণ হলেণ কবি মতিউর রহমান মল্লিক।
মল্লিক ভাই অসুস্থ হওয়ার পর তাকে দেখতে দু’বার ঢাকায় গিয়েছিলাম- তখনও হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমার কাছ থেকে বরিশালের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের খোঁজ খবর নেন তিনি। বলেন- দুলাল ভাই (বরিশাল সংস্কৃতিকেন্দ্রের সভাপতি) কেমন আছে, আল আমিনের (হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর সাবেক পরিচালক) কি অবস্থা, আরো কতো কি?
বরিশাল সংস্কৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর মল্লিক ভাই বারবার আমাকে বলতেন- শুধু বরিশালে কাজ হলেই চলবেনা, দক্ষিণাঞ্চলের সবকটি জেলা শহরে সংস্কৃতিকেন্দ্রের শাখা গঠন করতে হবে। এজন্য তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কয়েকটি জেলা সফর করে সংস্কৃতিকেন্দ্রের শাখাও গঠন করেছি। নানা প্রতিকূলতার মাঝে এসব শাখায় কোনরকম কাজও চলছে ।
তবে প্রতি মুহুর্তে মিস করি মল্লিক ভাইয়ের সেই ভালোবাসা মিশ্রিত দায়িত্বশীল আচরণ আর প্রেরণাময় কথামালা। ##

ছবির ক্যাপশন
বাগেরহাট শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে যৌথভাবে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক ও সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন।

আযাদ আলাউদ্দীন
পরিচালক, বরিশাল সংস্কৃতিকেন্দ্র, সাবেক পরিচালক- হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠী
বরিশাল ব্যুরো চিফ, দৈনিক নয়া দিগন্ত, সদস্য, বরিশাল প্রেসক্লাব।
০১৭১২-১৮৯৩৩৮, ০১৭৮৮৭৭০০৬৩
[email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *