আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক

বেগম ফয়জুন নাহার শেলী ।।

আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস ০৫ অক্টোবর।  শিক্ষক শব্দটির ব্যুৎপত্তি হল শিক্ষ্ +ণিচ=শিক্ষি (উপদেশ দেয়া) + অক= শিক্ষক। অর্থাৎ যিনি উপদেশ দেন তিনিই শিক্ষক। প্রচলিত অর্থে, যিনি শিক্ষা দান করেন তিনি শিক্ষক। এঅর্থে কবি সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতাটির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলা যায়- ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র ,নানা ভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবা রাত্র।

এদিক দিয়ে শিক্ষক হল, আকাশ, বায়ু, পাহাড় অর্থাৎ প্রকৃতি। তবে শিক্ষক দিবসের এই শিক্ষক হলেন, যিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা দান করেন।

শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো (UNESCO) ১৯৯৫ সালে ৫ অক্টোবরকে শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয় । বিশ্বের ১০০টি দেশে এ দিবসটি পালন করা হয়। Educational International (E I) ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন এ দিনটি পালনে মূল ভূমিকা রাখে। এ উপলক্ষে E I প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অনন্য অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০২১ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ছিলো ‘শিক্ষক: সংকটে নেতৃত্বে ভবিষ্যতের পুনর্নিমাণ।’ কোভিড পরিস্থিতির কারণে গত বছরও এই একই প্রতিপাদ্য ছিল।

তবে বিশ্বের সব দেশই যে ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস পালন করে এমনটি নয়। ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি (১৯৫২-১৯৬২) এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি (১৯৬২-১৯৬৭) ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান (০৫/০৯/১৮৮৮____১৭/০৪/১৯৭৫) একাধারে শিক্ষাবিদ অন্যদিকে রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তার গুণমুগ্ধ ছাত্র ও বন্ধুরা ৫ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন পালন করতে চাইলে তিনি এই দিনটিকে শিক্ষক দিবস বলে পালন করার প্রস্তাব রাখেন। সেই থেকে ভারতে ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে। অনুরূপভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে সে দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সৈয়দ মর্তুজা মোতাহহারীর শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি ও সম্মান স্বরূপ তাঁর জন্মদিন ২ মে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সে হিসেবে আমাদের বাংলাদেশের অহংকার ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১০/০৭/১৮৮৫—১৩/০৭/১৯৬৯)র জন্মদিন ১০ জুলাইকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব রেখে মূল আলোচনায় আসা যাক।

আমার জীবনের প্রিয় শিক্ষক অনেকেই। কার কথা বাদ দিয়ে কার কথা বলব ? সেই ছোটবেলায় যখন বরিশাল হালিমা খাতুন বালিকা বিদ্যালয় ইনফ্যান্, ওয়ান, টুতে পড়েছি তখন দুলু আপা ক্লাসে ঢুকেই প্রথম আমাকে কোলে নিতেন তারপর পড়ানো শুরু করতেন। এই সেদিনও ছায়া আপা আমাকে ফোন করে বললেন ,‘এই তোর ছোটবেলার কোন ছবি আছে ? ‘আমি বললাম’ না । ‘উনি বললেন ,”গুড্ডু গুড়িয়া সিরিয়াল টা দেখিস? তুই ঐ গুড়িয়ার মতো দেখতে ছিলি। ‘এরপর যখন বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হলাম তখনও সবার স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি। এমনকি বড়দি অর্থাৎ শান্তি গুহ দিদির মত রাশভারী মহিলার চোখেও আমার জন্য অনেক স্নেহ দেখেছি । আব্বার বদলি সূত্রে ঝালকাঠি হরশ্চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম । সেখানও বড় আপা থেকে শুরু করে সবাই স্নেহ করতেন। বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে বরিশাল উম্যান্স কলেজে ( উম্যান্স কলেজ নাম ছিল তাই সরকারি মহিলা কলেজ লিখলাম না) ভর্তি হলাম । সেখানেও অনেক স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি । আজও মাঝেমধ্যে খাতুন মাহমুদা  (বুড়ি) আপার সাথে দেখা হলে সাদরে পাশে নিয়ে বসান। তারপর বরিশাল ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ।এখানে শিক্ষকরা শুধু শিক্ষক রইলেন না। শ্রদ্ধার পাশাপাশি তাদের সাথে এক ধরনের সখ্যতা গড়ে উঠলো ।আনন্দের সাথে শিক্ষা গ্রহণ করেছি সব শিক্ষকের কাছ থেকেই । আমার শিক্ষকরা যেমন প্রয়োজনে শাসন করেছেন তেমনি  সোহাগও  করেছেন । তাই বলবো কাকে রেখে কাকে প্রিয় শিক্ষক বলি? সবাই তো প্রিয়। তবে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বলে কাউকে নির্দিষ্ট করতে হলে আমি আমার শিক্ষক পিতার কথাই বলবো।

হ্যা, আমার বাবা বজলুল হক মিয়া ( অব: প্রধান শিক্ষক, বরিশাল জিলা স্কুল, পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক, বরিশাল এ,কে স্কুল) একজন আপাদমস্তক শিক্ষক ছিলেন। কী প্রাতিষ্ঠানিক, কী পারিবারিক সর্বক্ষেত্রে। ছোটবেলার যখন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হইনি তখন আমাদের দু বোনকে (আমি আর মেজো বোন) সাথে করে বরিশাল জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাসার সামনের পুকুরটিতে নিয়ে যেতেন সাঁতার শিখাতে। নিজের হাতের ওপর তুলে সাঁতার শেখাতেন। আমপারা থেকে কুরআন শরীফও তাঁর কাছে শেখা।তোতলামি করে পড়লে হবেনা, গড়গড় করে পড়তেহবে। তিনি বলতেন, ‘পুথি পড়া থুতির কাম, কোরআন পড়া মুন্সীর কাম।’

আজও মনে পড়ে শীতের দিনে ভোরবেলা বরিশাল ব্রাউন কম্পাউন্ডের বাসার দোতলার  বারান্দায় তিনি একটি বড় কাশ্মীরি শাল জড়িয়ে নামাজ পড়তেন। নামাজ শেষে তাঁর কাছে গেলে তিনি ওই চাদরের মধ্যে আমাকে নিয়ে বসে কখনও কোরআনের আয়াত, কখনো পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবর কবিতা আবৃত্তি করে শুনাতেন। হেসে হেসে আবৃত্তি করতেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিষ্কৃতি কবিতার প্রথম ক’টি চরণ-

‘মা কেঁদে কয়’ মন্ঞ্জুলি মোর ঐ তো কচি মেয়ে,

ওরি সঙ্গে বিয়ে দেবে।-বয়সে ওর চেয়ে

পাঁচ গুণো সে বড়ো,-

তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়সড়।

এমন বিয়ে ঘটতে দেব না কো।”

বাপ বলে, “কান্না তোমার রাখো;

পঞ্চাননকে পাওয়া গেছে অনেক দিনের খোঁজে,

জানো না কি মস্ত কুলীন ও-যে।

সমাজে তো উঠতে হবে সেটা কি কেউ ভাবো।

ওকে ছাড়লে পাত্র কোথায় পাব।”

আবার কখনো বা মুক্তি কবিতা থেকে আবৃত্তি করে শুনাতেন।-

‘ডাক্তারে যা বলে বলুক নাকো,

রাখো রাখো খুলে রাখো,

শিওরের ঐ জানালা দুটো,-গায়ে লাগুক হাওয়া

ওষুধ? আমার ফুরিয়ে গেছে ওষুধ খাওয়া।”

কবিতাটির প্রতিটি ছত্রই আমাকে নাড়া দেয়। জানি রবীন্দ্রনাথ মাত্রেই এমন। তারপরও এ কবিতাটি থেকে আরো কয়েকটি ছত্র উদ্ধত করছি।

“আনন্দ আজ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে  প্রাণে

আমি নারী, আমি মহীয়সী,

আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্না-বীণায় নীদ্রা-বিহীন শশী।

আমি নইলে মিথ্যা হোত সন্ধ্যা-তারা ওঠা,

মিথ্যা হোত কাননে ফুল ফোটা।”

আর এমনি করেই আমার মধ্যে এ বিশ্বাস দৃঢ় হল,

‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/চূণী উঠলো লাল হয়ে’

তিনি ‘অন্তর্যামী’ কবিতাটি পুরোটাই মুখস্থ শোনাতেন। গোলাম মোস্তফার ‘শিক্ষক’ কবিতাটির লিখিত অর্থাৎ ছাপা রূপটি আজ অবধি দেখিনি। দেখা হয়নি ‘পান্তুয়া আর সন্দেশ’ এবং ‘আমি একটা হাবা মেয়ে:: ছড়া দুটো। আজও জানা হয়নি এ চমৎকার ছড়া দুটির শিরোনাম বা লেখকের নাম । কিন্তু তার কাছ থেকে শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘অভিশাপ’ কবিতাটি তিনি খুব পছন্দ করতেন। আর কবিতাগুলো আবৃত্তি করার সময় এমনভাবে করতেন যেন এগুলো তাঁরই কথা। কোরআন শরীফ অনুবাদসহ পড়তেন আর মাঝেমধ্যে আমাদের কিছু কিছু জায়গা থেকে অনুবাদ করে বলতেন, ‘দেখ, চোদ্দ পনেরো শত বছর আগে মহাজ্ঞানী আল্লাহপাক রাসূল (সা:) এর মাধ্যমে মানুষকে এ কথাগুলো জানিয়েছেন আর মানুষ এখন তা আবিষ্কার করছে।’

পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে আব্বা কখনো বকাঝকা বা মারধর করতেন না। বরং ভবিষ্যতে ভালো করার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। একদিন ( ঠিক কোন শ্রেণি মনে নেই) আমার মেজ বোন অংকে কম নম্বর পাওয়ায় ওর মন খারাপ। আব্বা ওকে বোঝালেন, আরে আমিত নাইন থেকে টেনে শূন্য পেয়ে উঠেছি। তবে সেই আমিই টেনএ বসে আমার সহপাঠীদের অংক শিখিয়েছি। বলাবাহুল্য আমার সেই মেজ বোন বৃত্তি নিয়ে ম্যট্রিক পাশ করেছিল। জনান্তিকে বলে রাখি আমরা কিন্তু কেউই ক্লাসে প্লেস পেতাম না। তবে একদম পিছনের সারির শিক্ষার্থীও ছিলাম না। তিনি জীবনে পুঁথিগত শিক্ষার থেকে মৌলিক শিক্ষার উপর জোর দিতেন বেশী। তিনি বলতেন, পুস্তকস্য বিদ্যা পরহস্ত ধন, কার্যকালে নস বিদ্য নস ধন (ঠিক মতো বলতে পারলাম কিনা জানিনা)। যার অর্থ,বইয়ের বিদ্যা (মুখস্ত বিদ্যা) আর পরের ভরসায় রাখা অর্থ প্রয়োজনে কোনো কাজেই আসেনা।

তিনি আরও বলতেন ‘আগার ফেরদৌস বার রোএ জামিনাস্ত/হামিন আস্ত, হামিন আস্ত, হামিন আস্ত। অর্থাৎ পৃথিবীর কোথাও যদি স্বর্গ থেকে থাকে/তা এখানে, এখানে, এখানে। তখন কিন্তু আমি ফারসির ফও জানতাম না। এমনকি জানবো যে তাও কোনদিন কল্পনা করিনি।

হ্যা, আমাদের পরিবারের ভীত ছিল পারস্পরিক সম্মানের উপর প্রতিষ্ঠিত। আব্বা জীবনে আম্মাকে রাগী সুরে কোনো কথা বলেছেন বলে আমার মনে পড়েনা। আম্মাও আব্বাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতেন। আম্মা বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে খুব জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কাছে কখনো বই নিয়ে পড়তে বসেছি কিনা মনে পড়েনা। আব্বা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে পড়াতেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ছিলেন কিন্তু ইংরেজি সহ মানবিক বিভাগের অন্যান্য বিষয়ের উপর তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের পাঠ্য ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বিভিষণের প্রতি মেঘনাদ’। আব্বা এত সুন্দর করে গল্প বলে বলে পড়িয়েছেন যে ঐ শ্রেণিতে থাকতেই আমি ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য শেষ করেছিলাম। মুখস্ত করেছিলাম কবির সমাধিতে লেখা স্বরচিত এপিটাফ। আটলান্টিক স্রোত কিভাবে সহজ করে পড়াতেন তা ভাবলে অবাক লাগে।ঝালকাঠিতে যখন তিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন তখন রাতের বেলা স্কুল ক্যাম্পাসে হেঁটে হেঁটে তিনি আমাদের আকাশের তারা চেনাতেন। কোনটা সপ্তর্ষি, সপ্ত ঋষির নাম, ক্যাথিওপিয়া, সন্ধ্যাতারা সব তিনি আকাশের   তারাগুলোকে দেখিয়ে শেখাতেন।

একত্রে বসে রেডিওতে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার ধারাবর্ণনা শুনতাম। কী যে উত্তেজনাকর সে ধারাবর্ণনা!এখনো নস্টালজিক হয়ে যাই। আব্বা খুব ভালো ভলিবল ও ফুটবল খেলতে পারতেন। আর ছাত্রদের সাথে সমানে পাল্লা দিয়ে খেলতেন। আমরা দর্শকের সারিতে বসে এ খেলা উপভোগ করতাম। হ্যা, তাসও খেলতেন তবে আমাদের সাথে। ব্রে খেলতাম। বড়আপা খেলতে পারতেন না বলে আব্বা তার পিছনে বসে সাহায্য করতেন। তবে খেলা যেন নেশায় পরিণত না হয় এ ব্যপারে ভীষণ সতর্ক ছিলেন। তিনি বলতেন, ক্যারাম খেলাও হারাম যদি তা তোমার কর্তব্যকে ভুলিয়ে নেশায় পরিণত করে।

আব্বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবণ্তী মজুমদারের সেই বিখ্যাত গান ‘আয় খুকু আয়’ এর জীবন্ত প্রতিমূর্তি। একদিন আমার মেজবোন কবি নজরুল ইসলামের ‘নূরজাহান’ গানটি গাইছেন এবং‘ইরানি গুলিস্হান’ শব্দটি উচ্চারণ করলেন। আব্বা সাথে সাথে শুধরে দিলেন গুলিস্হান নয় গুলিস্তান। শরীর বানানে শরির লিখতাম। একদিন আব্বা বললেন, তোর শরীর ঠিক হলে বানানটা ঠিক হবে। আজও শরীর লিখতে গেলে সেকথা মনে পড়ে শরীরে আর ভুল হয়না। ঘরে বসে অকারণে সাজুগুজু করে আব্বার সামনে দাঁড়াতাম। আব্বা ভীষণ খুশী হতেন।

স্কুলে টাইগার উপাধিতে খ্যাত এই মানুষটি ঘরোয়া পরিমণ্ডলে একদম অন্য জগতের। আমাদের পারিবারিক আড্ডা আব্বার বিছানায় বসেই হতো। আমার  জীবনে রান্নার ক্ষেত্রে আব্বার অবদান অনেক। জীবনে প্রথম পিঠা বানানোর শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। আমাদের বরিশালে যাকে বলে মুইঠ্ঠা পিঠা। রান্নায় হেরফের হলে কখনো বিরক্ত হতেন না বরং হাসিমুখে খেয়ে উঠতেন। শব ই বরাতের দিন রুটি বানানোর সময় তিনি রান্নাঘরে আমাদের পাশে থাকতেন। কখনো বা রুটি ভেজে দিতেন। সেলাই করার সময় তিনি অনুপ্রেরণা দিতেন। এ কাজটি তিনি খুব পছন্দ করতেন। তবে খাওয়া পড়াটা নির্দিষ্ট সময় মাফিক করতে হতো। এ ক্ষেত্রে কোন ক্ষমা নেই। সন্ধ্যার আগে ঘরে না ফিরলে খবর হয়ে যেতো। এজন্য ভাইয়েরা যে কত বকাঝকা ও মার খেয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই।

এমনকি খেলার মাঠে কারো সাথে মারামারি হলে বা ব্যথা পেলে আব্বা আম্মার কাছে নালিশ করার জো টি নেই। কারণ তাদের বিচার, এমন বন্ধু বান্ধবের সাথে মিশো কেন? তোমরা না গেলে তো এটা হতো না। তাই ব্যথা পেয়েও ভাইয়ারা কখনো আব্বার কাছে নালিশ করতে সাহস পায়নি। তাহলে সেকেন্ড রাউন্ডে ফ্রি স্টাইলে একতরফা মার খেতে হত। কারো নামে গীবত করা একদম পছন্দ করতেন না। খাবার টেবিল তাঁর কাছে আরেকটি ইবাদতের স্থান ছিল। সেখানে বসে বেশি কথা বললে বা কারো নামে বদনাম করলে তিনি ভাতের টেবিল থেকে উঠে যেতেন। সমস্ত হাতের মধ্যে ভাত মেখে খাওয়া বা পানির গ্লাসটা টইটুম্বুর করে ভরা তিনি পছন্দ করতেন না। বড় মাছের মাথা বা দুধের সর যথারীতি আব্বার থালায় দেয়া হলেও তিনি কখনও তা একা খান নি। সবাইকে একটু একটু করে দিয়েছেন। পারিবারিক বন্ধনের যে আনন্দ তা আমাদের বাসায় এসে অনেকেই উপভোগ করতেন।

ছাত্রদের তিনি বেত্রাঘাত করেছেন আবার ভালোও বেসেছেন। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছাত্রদের তিনি বিনা পারিশ্রমিকে বাসায় এনে পড়িয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত অনেক ছাত্রর কাছ থেকে শুনেছি, ‘তাঁর সেদিনের সেই বেতের জন্যই আজ আমরা এখানে এসে দাঁড়াতে পেরেছি।’

এ প্রসঙ্গে আব্বার জীবনের আরেকটি ঘটনা সবাইকে জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না। সন-তারিখটা ঠিক মনে নেই। সম্ভবত ১৯৬৭ কি’৬৮ সালের কথা। আব্বা তখন ঝালকাঠি সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আওলাদ নামে এক ছাত্র পরীক্ষায় নকল করার অপরাধে স্কুল থেকে বহিস্কার হয়েছে। সেদিন ছিল শবে বরাতের রাত। আব্বা গিয়েছেন থানায় স্থানীয় ওসি সাহেব মিলাদের আয়োজন করেছেন সেই দাওয়াতে।আর আমরা গিয়েছি আব্বার সহকর্মী মুজাম্মেল কাকার বাসায়। (কাকা পরবর্তীতে বরিশাল জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।) বড়আপা আর বড় ভাইয়া বাসায়। তখন ঝালকাঠিতে ছিলেন আনোয়ার ওসি। হ্যা,খুব নামকরা ওসি। এদিকে আওলাদ এসেছে বাসায় আব্বার সাথে দেখা করতে। বড় ভাইয়া আওলাদকে দেখে কোলাকুলি করতে গিয়ে ওর কোমরে খোলা ছুরি টের পেল। ঘটনা বুঝতে ভাইয়ার সময় লাগলো না। ভাইয়া ওকে বসিয়ে রেখে বড়আপাকে সতর্ক করে সোজা থানায় গিয়ে বিষয়টি আব্বাকে জানালো। আনোয়ার ওসি তৎক্ষণাৎ আব্বাকে সাথে নিয়ে বাসায় এলেন এবং আওলাদকে হাতে নাতে ধরে ফেললেন। ব্যাস,আর যায় কোথায়? সরকার-বাদী কেস হয়ে গেল। ঘটনা জেনে আওলাদের বড়ভাই চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে পাকিস্তান থেকে ভাইকে বাঁচাতে ছুটে এলেন। কিন্তু ওসি সাহেব নিজের হাতে উন্মুক্ত ছুরিসহ আওলাদকে ধরে ফেলায় ব্যাপারটি কঠিন আকার ধারণ করে। উপায়ন্ত না দেখে ভদ্রলোক আব্বার কাছে এসে কেঁদে পরলেন। আব্বা ছেলেটার ভবিষ্যৎ ভেবে ক্ষমা করে দিলেন। বস্তুত: এঁরাই আদর্শ শিক্ষক।

আব্বার নামাজ কাজা হতে কখনো দেখিনি। শেষ জীবনে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায়ও আজান দিলেই নামাজে বসে পড়তেন। দাঁড়িয়ে পড়তে পারতেন না। একদিন আব্বাকে বললাম, ‘আরেকটু পরে পড়না। ‘আব্বা বললেন, ‘নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নাই।’

কত বলব এই মানুষটির কথা! বলে শেষ হয় না। তাঁর প্রতিটি পরতে পরতেই শিক্ষা। রেডিও তেহরানে কাজ করছি। আব্বাকে লিখলাম, ‘আব্বা এখানে কষ্ট হয়। ঘরে কাজের মানুষ নেই। যেদিন গাড়ি মিস করি সেদিন চার তলার সমান পাহাড় বেয়ে অফিসে ঢুকতে হয়। উত্তরে আব্বা আর দশজন মা বাবার মতো বললেন না যে, ‘মা তোমার কাজ করার দরকার নেই।  উল্টো লিখলেন, ‘পৃথিবীতে যে জাতি যত পরিশ্রমী, সে জাতি তত উন্নত।’

এই শিক্ষক পিতার কন্যার ( আমার) কাছে লেখা একটি চিঠি দিয়ে ইতি টানছি। এ সময় আব্বা পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তবে আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় চিঠির উত্তর তিনি ঠিকই দিয়েছেন। আম্মা শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হবার খবর শুনে আব্বাকে লেখা আমার চিঠির উত্তর। বলাবাহুল্য আম্মাকে এ পর্যায় নিয়ে আসার সিংহভাগ কৃতিত্ব আব্বার। কারণ আব্বা কখনো স্বামী ছিলেন না, ছিলেন ‘ হামছার’ বা ‘জীবনসঙ্গী’। আর একটা কথা আম্মা চিঠি লেখার ব্যাপারে ভীষণ আলসে ছিলেন। তাই তার এ কৃতিত্বের আনন্দ প্রকাশ করে চিঠিটা আব্বাকে লিখেছিলাম। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে লেখা এ চিঠিটি পড়তে পাঠকের সমস্যা হতে পারে বিধায় চিঠিটির অনুলিপি দিলাম।

মা শেলী, আদর নিও।

তোমার চিঠি পেয়েছি কাল। চিঠি পেয়ে যে কত আনন্দিত হয়েছি তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। আমার মনে হয় তুমি যতটুকু আনন্দিত হয়েছ দুনিয়ার আর কেউই এতোটুকু আনন্দিত হয়নি। আমাদের জীবনেও কেন পূর্বের অনেক কথা তুমি মনে করেছ। আমার ছোটকাল, তোমার নানাভাই,যাকে তোমরা নানা হিসাবে পাওনি , তোমার বড়মা, যাকে তোমরা দাদু ডাকতে আরো কত কী যে তুমি স্মরণ করেছ যা আমাদের এখনো মনে হয় না অথচ ঘটনা সত্য। চেষ্টার অসাধ্য কিছুই নেই। কে ভেবেছে যে আমরা বড় হব। লোকের এত আদর যত্ন কুড়াবো।

ওই হিন্দু মেয়েটির কথা কিছুটা মনে পড়ে। আমার একটি ছাত্রের মা। ওরা আমাকে যে কত ভালোবাসতো তা বলে শেষ করা যায় না। মানুষকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পুরস্কার আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। কে ভেবেছে আল্লাহ আমাকে মানুষ করবে। স্কুলে যখন পড়ি ১৯২৯-১৯৩২ পর্যন্ত তখন ছয় পয়সা Poor fundর পয়সা স্কুলে দেওয়ার সামর্থ ছিলনা।

আর আজ! আল্লাহ আমাকে কত সুখ স্বাচ্ছন্দ ঐশ্বর্য দিয়েছেন। তোমাদের মত ছেলে মেয়ে কজন লোকের আছে ?

হ্যাঁ ঠিকই। আমার জীবন সার্থক হয়েছে। বাকি ছিল – তোমার আম্মা রীতিমতো নামাজ পড়ে না। আল্লাহ সেটাও পূরণ করে দিয়েছেন। আমি কোন কথাই ঠিক মতো গুছিয়ে লিখতে পারিনা। সুযোগ পেলেআবার লিখব।

মুন্নাকে নিয়েই দিনকাটাই। গত শুক্রবার ঢাকা গেছে। আজ ওর একটা পরীক্ষা ঢাকাতে। আবৃত্তি পরীক্ষা। ভালো করলে জানাবো। কাল বা পরশু এখানে হয়তো আসবে।

আমার ভাইয়াকে আদর দিও । ওর আব্বা কেমন আছে? ওকে আমার দোয়া জানাবে।

চিঠি দিও।  ইতি তোমার ছেলে ১৬/০৮/১৯৯১

বস্তুত মা-বাবার কথা বলে কোন সন্তানই শেষ করতে পারে না। তার উপর তিনি বা তাঁরা যদি হন শিক্ষক, তাহলে তো কথাই নেই। আমার দৃষ্টিতে শিক্ষক পিতা-মাতার সন্তানরা নিজেদের মা-বাবার ব্যাপারে একটু অহংকারী হন। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। ইরানে থাকাকালীন একটি সিনেমা চলছিল, ‘বেহতারিন ফেদিরে দুনিয়া আস্ত।’ অর্থাৎ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পিতা। বইটি দেখার প্রচন্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে দেখা হয়নি। তবে আফসোস নেই। আমার জীবনে আমার বাবা যেমন বেহতারিন ফেদারে দুনিয়া আস্ত। তেমনি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকও তিনি। তিনি আমাদের বইয়ের পাঠ যেমন শিখিয়েছেন জীবনের পাঠও তেমনি দান করেছেন। হে আল্লাহ, তুমি তাঁকে তোমার  রহমতের ছায়ায় স্থান দিও। আমিন।

বেগম ফয়জুন নাহার শেলী প্রাক্তন বাংলা প্রভাষক, বরিশাল ইসলামিয়া কলেজ। সাবেক সংবাদ পাঠক ও উপস্থাপক, রেডিও তেহরান- ইরান। 

One comment

  1. রাব্বির হামহূমা কামা রাব্বা ঈয়ানী সাগিরা। সেজো, অপূর্ব লেখা। তারপরও অসমাপ্ত থেকে যায় তাঁদের নিয়ে কিছু লিখতে গেলে। কোন ডিকশনারীরই এমন ভাষার সম্ভার নেই, যা দিয়ে সব কিছু লেখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *