আল হাফিজের যে শহরে আমি নেই : সভ্যতার কথা

নয়ন আহমেদ ।।
জীবনানন্দ দাশ একবার তাঁর প্রবন্ধে কবিতার আলোচনায় ইতিহাসের তাৎপর্য তুলে ধরে তাকে- মানব-অস্তিত্বের স্মারক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কেন এই ইতিহাস-সংলগ্নতা? এর জবাব দেয়া যায় এভাবে যে    মানব-সভ্যতার ধারণাটি দাঁড়িয়ে আছে এই ইতিহাসের ওপরই। একে আমরা বলি জীবনচেতনা। যার ভেতর খন্ডাংশ নেই আছে সামগ্রিকতা। মানবগোষ্ঠী তা বহন করছে এবং এরই আলোকে সে বিনির্মাণ করছে। তাহলে এই দাঁড়ালো যে, গভীরতা অর্থে মানব-সমাজ জীবন-যাপনের যে ধারাক্রম কিংবা সূত্রাবলীর জন্মদান ও পরিচর্যা করে থাকে, এই আবেদন বহন করে এবং ক্রমাগত বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যায় তার মধ্যে প্রধান আরক থাকে বাঁচবার অভিপ্রায়সমূহ রঙ ও রূপের চিত্রকলা। এই রূপই সভ্যতা। ধর্ম-দর্শন, বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য সভ্যতার এক একটি রূপ। বলা চলে ভাষার বর্ণের মতো এরাও একটি করে বর্ণ। এর সবগুলো রূপের সমাহার যেখানে ঘটে-সেখানে জীবনের পরিধি বিশালতা পায়। পা ফেলবার জায়গা পায়। কিন্তু জীবনের অভিপ্রায় সমূহের মধ্যে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটলে কিংবা তার শিক্ষার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হলে প্রবেশ করে স্থুল-আকাক্সক্ষা ও কুরুচি-কদাচার। এইভাবে নগর-বন্দর গড়ি, গলি-মোড় তৈরি করি। জটিল জাল ফেলি আমাদের নির্মাণের মধ্যে। এ যে শুধু ইতিহাস কিংবা মানব-এষণার বিকৃতি তাই নয়-এর মধ্যে লুকিয়ে আছে পুঁজিবাদীদের নগ্নহাতগুলো। তারা এক একটি দর্শন-চিন্তার জন্ম দেয়। ফলে, মানবতা মার খায় এদেরই হাতে তথাকথিত ইতিহাস-জীবনদর্শন নির্মাতাদের হাতে। আমাদের এ কথাটুকু মনে থাকলেই সভ্যতার উত্থান-পতনের চিত্র স্পষ্ট হবে।

সভ্যতার পতন কেন হয়? একটি দর্শনের মৃত্যু ঘটে কেন? কতদিন চিন্তা ও দর্শনের মোড়কে মানুষকে বন্দি করা যায়? এসব সহজ প্রশ্ন হলেও উত্তরটা কিন্তু একেবারে সহজ নয়। তবে চিন্তা ও বোধকে উস্কে দিতে শাদা চোখে বলা যায় অনেক এষণাই কিন্তু জীবনের বিপরীত। তাতে রঙ লাগলেও তার মধ্যে শোষণের সাপ থাকে ঘুমিয়ে। জেগে উঠে ছোবল দেয়। মানুষ তা মানে না। সে ভাঙতে পারে। মুখোশ খুলতে তার মতো আর পারে কে? এই কথাটুকুই কবি আল হাফিজ-এর কবিতা থেকে বলতে পারি।

কেননা, আমাদের শিরোনাম- কিন্তু তাঁর একটি কবিতাকে কেন্দ্র করেই ‘যে শহরে আমি নেই’। নব্বইদশকের উৎকৃষ্ট কবিতাগুলোর এটি একটি- অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। পুঁজিবাদের নগ্নবিস্তার আর ভোগবাদী দর্শনের আগুনমুখ ভয়ঙ্কর রূপের থাবার বিরুদ্ধে শিল্পিত দ্রোহ এর প্রধান উপজীব্য। একে প্রত্যাখান করেছেন কবি এভাবে ‘যে শহরে আমি নেই, তুমি তাকে বোলো না শহর। দোহাই, দাউদ নবির সুরে ভেজা গলার দোহাই; যে শহরে আমি নেই তুমি তাকে বোলো না শহর।’
সভ্যতার যে মৌলিক উপাদানে জীবন বিম্বিত হয় তার রূপ বর্তমানে দেখা যায় কি? যায় না। এখানে মনুষ্যত্ব পদদলিত হয়, জীবনের অপব্যয় হয়। একে সভ্যতা বলা যায় না। শহর নামেও অভিহিত করা যায় না। সভ্যতার সম্পর্কে কি মানুষের অনন্ত উদ্দীপন আর মাটির মমতা-রসের সাথে একীভূত নয়? এটাই প্রশ্ন। আর এর জবাবের জন্য আবার কবিতারই দ্বারস্থ হতে পারি। সেখানে দেখব মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবনাবেগ, প্রেম, প্রকৃতি- ভূগোল-রাষ্ট্রীয় সীমানা। সবকিছুই গ্রাস করতে চাচ্ছে একচোখঅলা কানা দৈত্য-পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের বিশাল প্রতিভূ। উদ্ধৃতি দেই-
রাতের লালার মতো যে শহরে ইহুদিরা খোলামেলা ম্যাকসির মায়া/পরে ঘোরাফেরা করে, তুমি তাকে বোলো না শহর/যে শহরে নাসারা মেয়ের মতো বুকখোলা বাতাশেরা ইশরায় ডাকাডাকি করে আর রাজারা নূপুর হয়ে মনিকার পায়ে পায়ে ঘোরে, সে শহরে আমি নেই, তুমি তাকে বোলো না শহর। ’
মানব-প্রকৃতি ও তার ভাষা, স্বকীয় জীবনধারা, প্রতিবেশ এসব কী করে রক্ষা পাবে এখানে? এর গলিতে গলিতে জীবাণূ ছড়ানো প্রযুক্তির ভেতর বাণিজ্যের অধিষ্ঠান। সে বসে আছে দেবী হয়ে। সে ইতিহাসকে বিলুপ্ত করে দেবে, সমস্ত মানবিক শিক্ষা ইন্তেকাল করবে!
‘যে শহরে মায়েরা উধাও সব আছে শুধু
প্রতীক্ষার আহাজারি; স্বপ্নহারা চোখের পানির মতো
দরোজার চৌকাটে নুনের আঁচড়, যে শহরে মুসা নবি-
খোয়াজ-খিজির তাঁরা পানির অভাবে আহা! পিপাসায়
ছটফট করে, যে শহরে অনাবিল গমের অভাবে
শিশু বোমা খেয়ে মরে, যে শহরে ঈসা নবি
টেকনোলজির জ্যামে অন্ধ হয়ে দিশেহারা ঘোরে,
যে শহরে শেষ নবি নানামুখি ফেরকায়
নিভু নিভু জ্বলে, সে শহরে আমি নেই, তুমি
তাকে বোলো না শহর’
মূলত জীবনদর্শন ও সংস্কৃতি-চেতনার আন্ত:জালে সভ্যতার যে লক্ষণসমূহ ধরা পড়বে সেরকম চিন্তকদের কোথায় দেখা পাবো আমরা? আল হাফিজ-এর কবিতায় কয়েকজন নবির কথা এসেছে। স্বীকার করতেই হবে প্রচলিত সমাজতত্ত্ব ও ইতিহাস এবিষয়ে চুপ থাকলেও আমরা নিশ্চিত হয়েই বলতে চাই- এ হচ্ছে ইতিহাসের একটি আলোকিত গতিধারা। বিশ্ব সভ্যতার প্রাণ ও আত্মা গঠনে এ এক দিশারীর ভূমিকা পালন করছে। এখন দরকার প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান মানবিক গুণাবলি বিকাশের সহায়ক করে তোলা। প্রকৃত সভ্যতা এসবের সমন্বয়েই নির্মিত হবে…।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *