ঐতিহ্য অন্বেষার আধুনিক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা

রিপন শান ।।
বৃহত্তর লোকসমাজের যাপিতজীবন, রিচ্যুয়াল ও ঐতিহ্য অনুসন্ধানের অতলান্তিক অভিযাত্রী আমাদের জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সমকালীন বাংলা কবিতার সমৃদ্ধ কণ্ঠস্বর মুহম্মদ নুরুল হুদা। তাঁর কাব্যপ্রয়াসে ব্যক্তিমানুষ, জাতিমানুষ ও বিশ্বমানুষের প্রতি সমীকৃত প্রতীতি। জাতিসত্তার কবিরূপে নন্দিত হয়েও তিনি মানব-অস্তিত্বের নান্দনিক ধারাভাষ্যকার।
বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক পৌরাণিক বাস্তবতাকে কবিতার উপাদান করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। মাটি ও মানুষের সঙ্গে রয়েছে তাঁর নিবিড় একাত্মতা। দেশ ও জাতির সমস্যা-সঙ্কট, সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতার অগ্নিঝরা চিত্র হচ্ছে মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা। কবিতার শরীরে সমাজ-বাস্তবতাকে আত্মীকরণ করতে  মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর অনুভূতির আলিঙ্গনে নিজস্ব চিন্তাশক্তিকে সূত্রায়িত করেন শিল্পিত বুনন ও বপনে। এখানেই জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রদীপ্ত।
মুহম্মদ নূরুল হুদা ভূমি থেকে উত্থিত কবি। নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বব্যাপী।  আবার আপন যোগ্যতাবলেই ফিরে গেছেন আপন ভূমিতে। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কাব্য-অভিযাত্রায় কখনো নিজের অবস্থানকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেননি। সোনাদিয়া, মহেশখালী, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, মৈনাক পাহাড়, আঞ্চলিক লোককাহিনি-কিংবদন্তী কোনোকিছুই বাদ যায়নি তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ থেকে। তিনি তাঁর ‘পূণ্যবাংলা’ কাব্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংগ্রামের বয়ান করতে করতে নিজের অজান্তেই দরিয়ানগরের নানান লোকপুরাণে ঢুকে গেছেন। দরিয়ানগরের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ  ও বাঙালির জন্য অনবদ্য একজন ‘জাতিসত্তার কবি’।
অগ্রজ-সমসাময়িক বন্ধু এবং অনুজ কবিদের কবিতা সম্পর্কে অসংখ্য গদ্য লিখেছেন তিনি।  লিখেছেন নানান সামাজিক- সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক নিবন্ধ, আত্মজৈবনিক গদ্য- স্মৃতিকথা এবং শিল্প-সাহিত্যের নানান অনুষঙ্গ নিয়ে বিস্তর রচনা।
কবি ফরিদ আহমেদ দুলাল লেখেন – তাঁর ( মুহম্মদ নূরুল হুদার) এসব গদ্য রচনার প্রবণতা, দায় এবং উপলক্ষ্য নিয়ে ভাবতে বসলে অবাক হতে হয়। তাঁর গদ্যে যেমন আছে স্বীকৃতি, তেমনি আছে স্বীকারোক্তি। সব রচনায়-ই যে তাঁর সুদূর পরিকল্পনার আভাস পাওয়া যাবে তা নয়, বরং অধিকাংশের ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যাবে সাময়িক আবেগ। এবং একটি আবেগকে যখন অন্য একটি আবেগ ভাসিয়ে নিয়ে যায় তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আগের আবেগটি খোয়া গেছে; যদি পূর্ব পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনার ছক কাটা থাকতো তবে নিশ্চয়ই পরিকল্পনা অনুযায়ী সব গুছিয়ে রাখতেন এবং গুছিয়ে করতেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের মতো এমন গোছানো লেখক ক’জনই বা আছেন বাংলা সাহিত্যে? সে অর্থে মুহম্মদ নূরুল হুদা সেই ধারার লেখক যাঁকে আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন হয় আরও অনেক ক’জন গবেষকের। নিষ্ঠ গবেষকের অভাবে এ ধারার লেখকরা অনেক সময় কালের আবর্তে হারিয়ে যান এ কথাও মিথ্যে নয়। কিন্তু মুহম্মদ নূরুল হুদার বিস্তৃতি ও ব্যাপ্তি, তাঁর প্রজ্ঞা ও মনীষা, সমাজঘনিষ্ঠতা এবং মানুষের সাথে সম্পৃক্তি এতটাই গভীর, যে তাঁকে হারিয়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব।
কবি শামসুর রাহমান, মুহম্মদ নূরুল হুদার অগ্রজ এবং তাঁর সমকালে বাংলা সাহিত্যে প্রধান কবি হিসেবে আলোচিত কাব্যব্যক্তিত্ব। একাধারে তিনি কবি এবং সম্পাদক।
কবি শামসুর রাহমান ১৯৯৯-এ কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত স্মরণিকা ‘সময়মানুষ মুহম্মদ নূরুল হুদা’য় শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেন, “গুরুত্বপূর্ণ কবি এবং ভালো কবি এক কথা নয়। আমি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে আমাদের দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি বলে মনে করি। ভালো কবি বেশ কয়েকজন হতে পারেন, তবে গুরুত্বপূর্ণ কবি আমার বিবেচনায় কম। এবং সেই বিরল কবিদেরই একজন মুহম্মদ নূরুল হুদা।” একই সংকলনে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ শুভকামনা জানিয়ে ‘আমার এ কবি’ শিরোনামের প্রবন্ধে লিখেন, “কবি ভুল বলে না। কবির ভুল হয় না। শব্দ যে খোঁজে, শব্দকে যে বিবাহ করে, শব্দের সঙ্গে যার দোস্তি, তারাই তার শ্রমে জাগরণ এনে দেয়। এমন কবিকে ভক্তি করে আমি ধন্য হই। মুহম্মদ নূরুল হুদা শব্দশিকারী। কোথা থেকে না কোথা থেকে, শব্দকে খুঁজে আনে। বাছবিচার করে না। ইলিয়টে তার আনন্দ, শেক্সপীয়রে তার নেশা, বাল্মীকিতে সে অনুরাগী, হোমারে সে অভিভূত আর কোরানে সে আকণ্ঠ। আর আছে তার সাগর, আছে পাহাড়, আছে ঈদগাহ বিদ্যালয়।”
ভাষাসৈনিক-গবেষক আহমদ রফিক আমাদের সাহিত্যাঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ সমালোচক হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত, তিনি তাঁর ‘বহুমাত্রিকতায় আকর্ষিত কবি’ শিরোনামের গদ্যে লিখে, “মুহম্মদ নূরুল হুদা মূলত কবি, কবিতা তার শৈল্পিক সত্তায় লালিত। তবু তা জীবনের সঙ্গে এক ধরণের ভাবব্যঞ্জনায় গাঁটছড়া বাঁধা। তাঁর গদ্য রচনার একটি বাক্যে বিষয়টা স্পষ্ট, যখন কবি-গদ্যকার বলেন “কবিতা মানবিকতার জীবন-সম্মত রূপকতা।” মেধাবী কবি হিসাবে ভাষার ঋজুতা ও যুক্তিবাদী স্বচ্ছতা নূরুল হুদার প্রিয়। তাঁর কবিতার মতো গদ্যেও একধরণের তমোঘœ রূপ চোখে পড়ে। অবশ্য প্রথম দিকে তার রচনাশৈলীতে আভরণ-সৌন্দর্যের ঝোঁক খুব কম ছিল না। তবু সব দিক মিলিয়ে মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রকৃতপক্ষে সব্যসাচী লেখক, সাহিত্যের একাধিক অঙ্গনে যাঁর বিচরণ। কবির এই দ্বৈতচরিত্র আমার হিসাবে ইতিবাচক।”
গবেষক-ভাষা বিশেষজ্ঞ বশীর আলহেলাল,  কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কাব্যভাষা সম্পর্কে লিখেছেন, “আসলে পাঠকের দৃষ্টি কাড়ার ক্ষমতা তিনি রাখেন। তিনি বেশ জীবন্ত এবং খুব উজ্জ্বল কবি। তাঁর কাব্যেরে শরীর নব যুবতীর মতো পৃথুল। তা এখনো তত শাঁসালো নয় এবং রসের তো অভাব আছেই। তবে এই যুবতীর সাজ বেশ বর্ণাঢ্য। বেছে বেছে তিনি অনেক রুচিসম্মত অলঙ্কার, হ্যাঁ, স্বর্ণালঙ্কার পরেছেন। তিনি যে ফুলসাজ অঙ্গে ধারণ করেছেন তাও প্লাস্টিকের নয়, প্রকৃত ফুলেল। শরৎকালের বাংলাদেশে যেমন অঢেল বর্ণাঢ্যতা, তাঁর কবিতায় তদ্রুপ। কিন্তু বলিষ্ঠ ও বেগবান মুহম্মদ নূরুল হুদার ভাষা।”
জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে প্রবল গতির উচ্ছলতা, যে কারণে আবৃত্তিশিল্পীরা সব সময়ই তার কবিতাকে আবৃত্তির বিবেচনায় রেখেছেন; তাঁর কবিতা-
“রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।
(আমরা তামাটে জাতি )
তাঁর-
‘জগৎ অতিথি তুমি এসো এই ঘরে
পেতেছি বরণকুলা দরিয়ানগরে’
অথবা
‘যতদূর বাংলাভাষা ততদূর এই বাংলাদেশ
দরিয়ানগরে জন্ম, পৃথিবীর সর্বপ্রান্ত আমার স্বদেশ’
ইত্যাদি কবিতাও আবৃত্তি হয়েছে বারবার।
বাচিকশিল্পাচার্য  নরেন বিশ্বাস তাঁর ‘শুক্লা শকুন্তলার শিল্পমূল্য’ প্রবন্ধে লেখেন, “কেবল তত্ত্বগত দিকের সাঙ্গীকরণে সিদ্ধ নন কবি নূরুল হুদা, তিনি ঐতিহ্যের আত্মীকরণে এবং কবি-অনুভূতির নবায়নেও সমান দক্ষ। ‘শুক্লা শকুন্তলা’ কাব্যের মৌল প্রকৃতিতে যেমন কবি-ব্যক্তিত্বের স্বকীয় মুদ্রা স্বাক্ষরিত, তেমনি আকৃতিতে অর্থাৎ নির্মাণ-কলায়ও অভিনব বিশেষত্ব সংযোজিত।” মুহম্মদ নূরুল হুদার সমসাময়িক কবি কবি অসীম সাহা তাঁর ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি প্রসঙ্গে’ শিরোনামের প্রবন্ধে লিখেছেন, “নূরুল হুদার কবিতার প্রাণ-স্পন্দন কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর আবিষ্কার করতে গিয়ে তাঁর কবিতার আপাত ঝংকার বারবার বাধার সৃষ্টি করে। কবিতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ধরার আগেই তা পালিয়ে যায়। আর এই লুকুচুরির অন্তর্দেশ থেকে যা বেরিয়ে আসে, তার সঙ্গে আমাদের গভীর সম্পর্ক নেই। আমরা কিছুই জানি না। শুধু আপাত চমকের ঝলকিত আবেগে মৌহুর্তিক বিস্ময়ে ধমকে দাঁড়াই। হুদার কবিতাকে তখন মনে হয় অদ্ভুত, মনে হয় আশ্চর্য প্রেরণা, হৃদয়ারণ্যের একমাত্র শব্দিত সঙ্গীত।”
কথাশিল্পী ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর ‘নির্বাচিত কবিতা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “মুহম্মদ নূরুল হুদার নির্বাচিত কবিতায় যে সমস্ত কবিতা স্থান পেয়েছে, তাদের তিনটি পর্যায়ভুক্ত করা যায় যার মাধ্যমে কবি সৃষ্টিকলাকে সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করা এবং তাঁর সুনির্দৃষ্ট উত্তরণের পথ শনাক্ত করা সম্ভব। প্রথম পর্যায়ের কবিতা সমূহের মধ্যে ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ এবং ‘আমার সশস্ত্র শব্দবাহিনী’, দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’, ‘অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ী’ ও ‘আমরা তামাটে জাতি’ এবং তৃতীয় পর্যায়ে ‘শুক্লা শকুন্তলা’ এবং ‘যিসাস মুজিব’ কবিতাগ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত করা চলে। এই পর্যায়ভুক্তি পেছনে আঝে কবি ও শিল্পী হিসেবে হুদার উত্তরণ, তাঁর কিছু সুনির্দৃষ্ট ধ্যান-ধারণা, কাব্যিক প্রচেষ্টা এবং থীম ও বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্য ও সমান্তরাল উন্মোচন।”
শিক্ষাবিদ শান্তনু কায়সার তাঁর ‘তামাটে জাতির আত্মানুসন্ধান’ শিরোনামের প্রবন্ধে লিখেন, “জাতিসত্তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে কবি ইতিহাসের দ্বন্দ্ববাদে আস্থা স্থাপন করেছেন। অন্ধতা কিংবা স্থুল জাতীয়তা তাকে মোহান্ধ করেনি, বরং শেকড়ের ডাক তাকে সেই অগ্রসরতার সন্ধান দিয়েছে। যার মধ্যে ইতিহাস তার অনিবার্য গন্তব্যকে খুঁজে পাবে। সেজন্য কবি তার ‘নির্বাচিত কবিতায়’ ইতিহাসের সর্বশেষ ধাপে বিকশিত হবে যে সম্পূর্ণ মানুষ তাকে উৎসর্গ করেছেন। কবি হিসাবে এই বৈজ্ঞানিক চারিত্র অর্জনের নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়াই মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার আঙ্গিক। এটি তাঁর কাব্য শরীরে এমনভাবে প্রবহমান যে তাকে আলাদা করে শনাক্ত করা অসম্ভব। তবে দু’একটি লক্ষণ বিচার করে দেখা যেতে পারে। প্রথমেই আসে তাঁর শব্দ ব্যবহারের কথা। হিন্দু পুরাণকে আশ্রয় করে ‘শুক্লা শকুন্তলা’ লেখা হলে কাব্য প্রবন্ধটিতে তিনি অনায়াসে প্রয়োজনানুগ আরবী ফারসী শব্দ ব্যবহার করেছেন।”
কবি গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর ‘গহন-উন্মত্ত কিন্তু যুক্তিশীল’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেন, “শিকড়বদ্ধ বলেই মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর কোন কোনো সমনাময়িক প্রাবন্ধিকের মতো কালাপাহাড়ি উক্তির চমকে জনচিত্ত আকর্ষণ করবার চেষ্টা করেন নি। নিজস্ব যুক্তির পারম্পর্যেই তিনি স্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা অন্য কোনো লেখকের বিচার। আবার তাঁর যুক্তিমালার পিছনে তাঁর আবেগের তরঙ্গরাশির ওঠানামা অনুভব করেছি। তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধই কবি ও কবিতা বিষয়ে। প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি প্রাবন্ধিকের শর্ত মেনেই। কিন্তু কবি না হলে ওরকম প্রবন্ধ তিনি লিখতে পারতেন না।”
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সহপাঠি বিশিষ্ট কবি-অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেন তাঁর Flaming Flowers প্রসঙ্গে’ লিখেছেন, “এ দেশের কবিরা সেই প্রাগ্রসর জনগোষ্ঠী যারা রঘটমান কালদ্বারা শুধু স্পৃষ্ট হননি, ঘটনার অংশভাগ হয়েছেন, নিজেদের আবেগ ও মনন দিয়ে ছুঁতে চেয়েছেন সময়কে। সংগ্রামী জনতার কণ্ঠে যে প্রতিবাদের ভাষা তাকে তাঁরা করেছেন কাব্যমন্ডিত। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান কালের রাজপথে ব্যানার-ফেস্টুনে উৎকলিত হয়েছে কবিতার পংক্তি, স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র ছড়িয়ে দিয়েছে বিস্ফোরক কাব্যউচ্চারণ। একটি জাতির ক্রমবিবর্তমান রাজনৈতিক পরিণতির সাথে তার কাব্য-সাহিত্যের এমন অবিচ্ছেদ্য যোগ অন্য কোথাও লক্ষিত হয়েছে বলে জানা নেই। মুহম্মদ নূরুল হুদার গ্রন্থ ‘Flaming Flowers ‘ আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ও তৎসন্নিহিত কবিতার একটি চমৎকার ও বহু-অপেক্ষিত বিশ্লেষণ।”
সত্তরের উজ্জ্বল  কবি বিমল গুহ তাঁর ‘প্রেমের কবিতা’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেন, “কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা দ্ব্যর্থপ্রত্যয়ী একজন কবি, তিনি পৃথিবীর তাবৎ কিছুর মধ্যে ‘ভালোবাসা’ শব্দ প্রতিস্থাপন করার কথা ঘোষণা দিয়ে শুরু করেন তাঁর বত্রিশতম কাব্যগ্রন্থ ‘আমার চূড়ান্ত শব্দ ভালোবাসা’। এই গ্রন্থের ৩৯টি কাব্য উক্তির মধ্যেই ধরা পড়েছে প্রেম সম্পর্কে লালিত অভিব্যক্তির কথা। এই গ্রন্থে তাঁর প্রথম উক্তি: ‘আমার প্রথম শব্দ ভালোবাসা/ আমার দ্বিতীয় শব্দ ভালোবাসা/ আমার তৃতীয় শব্দ ভালোবাসা।’
তাঁর এই প্রত্যয় আরো বলিষ্ঠরূপে প্রতিভাত হয়। তিনি একই কাব্যোক্তির মধ্যেই আবার যখন বলেন: ‘আমি সব ভাষার/ সব অভিধানে/ সব শব্দের অর্থ বাতিল করবো/ লিখবো/ ভালোবাসা।’ ইত্যাদি।” সত্তরের স্বতন্ত্র ধারার কবি মতিন বৈরাগী কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেন, “কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা কবিতা নির্শাণের নানা পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমানে বাস্তবতার কবিতায় তাঁর মেধা ও মননশক্তিকে নিয়োজিত করেছেন কাব্যনির্মাণের এমন এক জিজ্ঞাসায়, যেখানে বহুর আকাক্সক্ষা আছে। তিনি বহুর আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নকে সচেতন কাব্য-নির্মাণের মধ্য দিয়ে শিল্পসত্তা মানবমুখী করে তোলার চেষ্টা করেছেন, যা ইতিহাসের দাবীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এদিক থেকে তিনি প্রান্তিকতার কবিতায় বিশ্বাসী নন, কবিতার বহুমাত্রিকতার অনুগামী।”
ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ ‘মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রবন্ধভুবন’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেন, “কবিতা-বিষয়ক আলোচনায় তিনি মূলত তাঁর অভিনিবেশ সীমাবদ্ধ রেখেছেন বাংলা কবিতার তিন কালজয়ী প্রতিভা মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের মধ্যে। এদের সঙ্গে অবশ্য আছেন জীবনানন্দসহ তিরিশের প্রধান কবিরা, আছেন বিভাগ-পূর্বকালীন বাংলা কবিতার প্রধান-অপ্রধানেরাও।” অপেক্ষাকৃত তরুণ কবি গোলাম শফিক ‘কবিতার চাষা-মানব’ প্রবন্ধে বলেন, “নূরুল হুদার কবিত্ব বন্দি থাকেনি কোনো বদ্ধ মতাদর্শের সংকীর্ণ গলিতে। শ্রেণী বিভাজন, ধর্ম বিভক্তি, মনুষ্যজাতির খ-িকরণ কবিকে পীড়া দেয়। চন্ডীদাসের মতো তিনিও মনের পকেটে লুকিয়ে রাখেন এক প্রতীতি–’সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। সে জন্যই অজিতকৃষ্ণ বসুর মতো উচ্চারণ করবেন হুদাও : ‘জামার পকেট হালকা যে মোর/ মনের পকেট ভার’।”
কবি-প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ ‘ঐতিহ্যে প্রত্যাবর্তনের কবি’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, “মুহম্মদ নূরুল হুদা যে কারণে আলাদা সেটি হল, এই জনপদের আদিম রূপটি কবিতার সাহায্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি, সেই জনপদের ভয়াল শ্বাপদ রূপের পাশাপাশি সম্ভাবনাও তিনি অবিষ্কার করেছেন। চিত্রে যে দিকটি আবিষ্কার করেছিলেন এস এম সুলতান, হুদা কবিতায় সেই কাজটি করেছেন। সুলতানের চিত্রকলায় আমরা পাই, কৃষিনির্ভর সমাজের পেশিবহুল মানুষ এবং সেই মানুষের সংগ্রামশীলতা। অবশেষে একটি Pantisocracy’র ধারণা আবিষ্কার করা যেতে পারে। সেইসঙ্গে আধুনিক মানুষের বিবিক্তি, ক্লান্তি, সংশয়, বিতৃষ্ণা ও নৈরাশ্যিক নেতিবাচকতা পরিহার করে নূরুল হুদা একটি ইতিবাচ্য নির্মাণে সক্রিয় হয়েছেন।”
কবি-গবেষক সরকার আমিন তাঁর ‘সুন্দরজনক ব্যবচ্ছেদ’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেন, “মুহম্মদ নূরুল হুদা সন্দেহাতীতভাবে একজন প্রকৃত কবি। কারণ তাঁর অনেক কবিতা আমাদেরকে দান করে উপলব্ধি, ধনাঢ্য অনুভব। তাঁর কবিতা পাঠের পর আমরা কখনো আচ্ছন্ন হই, কখনো বা হই ভাবিত। তাঁর রচিত অন্তত অর্ধেক পরিমান কবিতাই প্রকৃত আবেগ থেকে অনুসৃত। একজন কবির সব কবিতাই কারোর ভালো লাগে না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রিয় কিন্তু তাঁর সব কিছুই উৎকৃষ্ট মূল্য পেয়েছে এমন বলব না। বলা বাহুল্য নূরুল হুদার সকল কিছু উৎকৃষ্ট মূল্য পায়নি। তবে যতটুকু ভালো লেগেছে তাতে বলতে পারি তিনি কবি হিসেবে অনন্য উচ্চতায় আসীন ।
জয়তু জাতিসত্তার কবি-জীবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *