কবি আল মাহমুদকে নিয়ে ষড়যন্ত্র

মামুন সারওয়ার ।।

এই লেখা যখন লিখতে বসেছি তখন সকাল।

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
শুয়োর মুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ।

লাইন তিনটি আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদের। আল মাহমুদকে আমি অনেক ভালোবাসি। আমার প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদদীনের পরই কবি আল মাহমুদের অবস্থান।
আমার মতো অনেক কবিরাও আল মাহমুদকে ভালোবাসেন। কবির কবিতা পড়েন। আঞ্চলিক দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক এবং জাতীয় দৈনিক পত্রিকাসমূহে কবির জন্য অনেকেই লিখে থাকেন। একজন বড় কবির জন্য তাঁকে নিয়ে লেখাটাই স্বাভাবিক। তারপরও প্রিয় কবিকে নিয়ে আমার দেখা কিছু ঘটনা লিখছি।

এক.
২০০৮ সালে যশোরে আমার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য সংগঠন নজরুল সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে ‘নজরুল উৎসব’ করার সিদ্ধান্ত হলো। ওই উৎসব উপলক্ষে ঢাকার কজন কবিকে আনার প্রস্তাব করা হলো। তার মধ্যে কবি আল মাহমুদ ছিলেন অন্যতম। সে অনুযায়ী আমার ঢাকা যাওয়া। তখন কবি আল মাহমুদ ঢাকার গুলশানের পোস্ট-অফিস গলিতে থাকতেন। আমি তাঁর বাসায় গিয়ে কথা বলে বিমানের টিকিট দিয়ে আসি। কবি আসবেন বলেও আমাকে কথা দেন। অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত কবির সাথে যোগাযোগ করা হয়। কবি আসবেন। কবিকে বিমানে উঠিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় তরুণ কবি আবিদ আজমকে। কিন্তু যানজটের কারণে বিমান ছাড়ার নির্ধারিত পাঁচ মিনিট পরে পৌঁছানোর জন্য কবি বিমান পেলেন না। ওইদিন রাতে কবি আল মাহমুদ কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরদিন সকালে কবি জামসেদ ওয়াজেদ অনেক চেষ্টা করেও কবিকে আর যশোরে পাঠাতে পারেননি। যাক-কি করা, সিদ্ধান্ত হলো আমাদের নজরুল উৎসব হবে। ঢাকা থেকে সেই অনুষ্ঠানে আসলেন কবি রেজাউিদ্দন স্টালিন, কবি জাকির আবু জাফর, গবেষক সুহৃদ সরকার ও কবি আবিদ আজম।
পরবর্তীতে শুনলাম একটি রাজনৈতিক সংগঠনের যশোর শাখার দু’তিনজন নেতা ঢাকার কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠনের সভাপতি দিয়ে কবিকে বলিয়েছেন নজরুল সাহিত্য পরিষদের অনুষ্ঠানে না আসার জন্য। এসব কথা বলাতে কবি আল মাহমুদ খুব ক্ষুব্ধ হন। তার এক সপ্তাহ পরে দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় একটি কলামে লেখেন- ‘কেউ কেউ আমাকে সাহিত্যের অনুষ্ঠানে যেতে বাধা দেন। আমি কি কোনো দলের? যারা অনুষ্ঠানে যেতে নিষেধ করেন, তাদের বোঝা উচিত আমি কবি, আমি সাহিত্য চর্চা করি।’ এই বিষয়টি দেখে পত্রিকা এবং কয়েকজনের কাছে শুনে আমার কাছে খুবই খারাপ লেগেছিল। তাদের চেনা সত্ত্বেও কখনো কিছু বলিনি। এরা কবি আল মাহমুদের মতো লেখককে ব্যবহার করতো নিজের স্বার্থের জন্য। সংগঠনের জন্য।
আজ মৃত্যুর পর কবির জন্মদিন পালন করতে গিয়ে তাই বোঝা যাচ্ছে। মৃত্যুর পর দেখা গেল যে পত্রিকায় কবি কলাম লিখে পত্রিকাটি জনপ্রিয় করেছিলেন, সেই পত্রিকাতেই আল মাহমুদের চরিত্র নিয়ে কলাম ছাপানো হচ্ছে।

দুই.
২০১২ সালে বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্পের ৫ম ব্যাচের জন্য তরুণ কবিদের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। সেই ইন্টারভিউয়ে অংশগ্রহণ করে আমি উত্তীর্ণ হই। সেই ব্যাচে তরুণ কবি জিয়া হকের মুখে শুনেছি প্রশ্নত্তোর পর্বে তার প্রিয় কবি আল মাহমুদের নাম বলার কারণেই তাকে সঙ্গে সঙ্গে আসতে বলা হয়। অথচ কবি আল মাহমুদ তখনো বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক এবং সম্মানিত ফেলো ছিলেন।

তিন.
এদেশে কিছু কবি-সাহিত্যিক আল মাহমুদকে মনেপ্রাণে পছন্দ করলেও মুখে মুখে প্রচুর বিরোধিতা করেন। আল মাহমুদের মৃত্যুর পর কয়েকজন কবি ও শিক্ষকের ক্ষেত্রে এমনটাই দেখেছি। তারা ফেসবুকে কবিকে নিয়ে চরিত্রহরনের কাজটিও করেছিলেন। তাঁদের সম্মান করি বলে আর লিখলাম না। এরা তিনজনই ছিল সংখ্যালঘু।

চার.
মৃত্যুর পর কবি আল মাহমুদকে শহীদ মিনারে নেওয়ার সিদ্বান্ত হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। সেই অনুযায়ী একটি দরখাস্ত লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আখতারুজ্জামান সাহেবের কাছে যাওয়া হয়। কিন্তু ভিসি দরখাস্তে স্বাক্ষর দিয়ে প্রোক্টরের কাছে পাঠিয়ে দেন। প্রোক্টরের কাছে যাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি অনুমতি দিতে পারবো না। এমন করে ভিসি ও প্রোক্টর আমাদের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন। উক্ত দরখাস্তের নমুনা কপি এখানে দেওয়া হলো।

অথচ কবি আল মাহমুদ ছিলেন ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা। তার কবিতার তিনটি বই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাতটি সরকারি কলেজের মাস্টার্সে পড়ানো হয়। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ানো হয়।
কবি আল মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম ‘ছোটোদের সময়’ নামে শিশু-কিশোর উপযোগী একটি পত্রিকায় লেখেন- আল মাহমুদের শবদেহ শহীদ মিনারে আসেনি। আল মাহমুদের দাফন হয়নি মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে। এই দীনতা আমাদের বহন করতে হবে। আল মাহমুদ বেঁচে থাকবেন বাংলা কবিতার মগ্ন পাঠকদের কাছে।’

পাঁচ.
কবি আল মাহমুদকে নিয়ে এত বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী কবির লাশ বাংলা একাডেমিতে এনে কবিকে অনেক সম্মান দেখিয়েছেন। ধন্যবাদ প্রিয় সিরাজী ভাইকে।

ছয়.
শিশু-কিশোর পাঠ্যবইয়ে কবি আল মাহমুদের বেশকিছু কবিতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার মধ্যে অন্যতম ‘নোলক’, ‘একুশের কবিতা’ ও ‘তিতাস’। এই কবিতাগুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃপক্ষ বাদ দেয়। যারা এই কাজটি করেছেন, তারা বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করুন কতটা হীনমন্যতার পরিচয় দিয়েছেন? কোনো একদিন এইসব কবিতা আবারো পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে। আল মাহমুদের কবিতা পাঠ্য বই থেকে মুছে দিলেও পাঠকের হৃদয় থেকে কখনোই মুছে ফেলা যাবে না। আল মাহমুদ বাংলাভাষার একজন প্রিয় কবির নাম। আল মাহমুদ একটি চিরকালীন প্রতিষ্ঠানের নাম।

 

মামুন সারওয়ার, বিশিষ্ট লেখক ও ছড়াকার।

One comment

  1. সিদ্বান্ত লিখেছেন।এটি টাইপো নয়।আবারও সিদ্বান্ত লিখেছেন।শুধরে নিন ভাই।হবে সিদ্ধান্ত।প্রক্টর না প্রোক্টর? এটাও প্রশ্ন।এপারে প্রোক্টর লিখি।
    আল মাহমুদ আমার অন্যতম প্রিয় কবি।ওপারে আল মাহমুদ,এপারে সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুজনেই শাসকের উপেক্ষা পেয়েছেন শেষ জীবনে। জনগণের হৃদয়ে তাঁরা ভালোবাসার আসনে।
    আল মাহমুদের জীবনে এরশাদ পর্ব অবশ্যই তাঁর সমগ্র জীবন দর্শনের সঙ্গে খাপ খায় না।চাঁদে এটুকু কলঙ্ক থাকেই।
    পরপর দু বছরঢাকায়, ২০১০ ও ২০১১ য় কবির বাড়ি যাওয়ার আগ্রহ জানিয়েছিলাম। বাংলাদেশের বন্ধুরা এড়িয়ে যান।
    আফসোস চিরন্তন!

Leave a Reply to পার্থ বসু Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *