কে হিরো আর কে ভিলেন

 

ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতার কাজিয়া চিরন্তন। একই সূত্রে মুসলিম ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতও অনিবার্য। সেটা সমাজে হোক, রাষ্ট্রে হোক, জিহাদের ক্ষেত্রে হোক, যুদ্ধ ময়দানে হোক, বুদ্ধিবৃত্তিক হোক, কলাকৌশলগত হোক আর কুটনৈতিক হোক। দুইয়ের মিলন অসম্ভব। দুইয়ের অবস্থান দুই মেরুতে। একজন তাওহিদবাদী বা ডানপন্থী, আরেকজন ভোগবাদী বা বামপন্থী। একজন আল্লাহতে বিশ্বাসী আরেকজন নিরীশ^রবাদী। একজনের জীবন আখিরাতভিত্তিক, আরেকজন দুনিয়াপুজারি, একজন অহির অনুসারী, অন্যজন তাগুত ও প্রবৃত্তির অনুসারী, একজন মানবতাবাদী বিপরীতজন প্রতিহিংসাপরায়ণ, প্রথমজন আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত, পরেরজন শয়তানের থিওরি বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আল্লাহর রসুল স. যখন মাক্কার মুশরিক কাফিরদের দরবারে ইসলামি সংস্কৃতির দাওয়াত পেশ করেন, অল্প সংখ্যক ছাড়া সবাই পূর্বপুরুষদের দোহাই দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ওপর অবিচল থাকার চেষ্টা চালায়। একই কথা প্রযোজ্য ইমাম হোসাইন রা. ও ইয়াযিদ, তালুত-জালুত (জুলিয়েট), উমার রা.-হরমুযান, সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস-রুস্তুম, তারিক বিন যিয়াদ-রডারিক, মুহাম্মাদ বিন কাসিম-রাজা দাহির, ইফতেখারুদ্দৌলাহ-পোপ আরবান, নুরুদ্দিন জেঙ্কি- সেন্ট বার্নার্ড, মুতাসিম বিল্লাহ-আল কামি, সুলতান বাইবার্স-হালাকু খান, সালাউদ্দিন আইয়ুবি-রিচার্ড, মুহাম্মাদ ঘুরি-পৃথ্বিরাজ, বখতিয়ার খিলজি-লক্ষণ সেন, শাহ জালাল-গৌর গোবিন্দ, নুর কুতুবল আলম-গণেশ, আহমদ সরহিন্দি-সম্রাট আকবার, ইসা খা-মানসিংহ, আওরঙজেব-শিবাজি, সিরাজদৌলা-জগৎশেঠ মিরজাফর, আগা বাকের-রাজবল্লভ, নিসার আলী তিতুমির-কৃষ্ণচন্দ্র, শাহ আহমাদ উল্লাহ-জগন্নাথ শিং, রজব আলি-মেজর বাইঙ্গ, মির লায়েক আলি- জওহার লাল নেহেরু, কাসেম রিজভী-আল ইদরুস, বদিউজ্জামান সাইদ নুরসি-কামাল পাশা, হাসানুল বান্না-ফারুক পাশা, ইসা আ.-দাজ্জাল। এ ধারা চলমান। কিয়ামত অবধি চলবে। ইসা আ. ও দাজ্জাল এ ধারাবাহিকতার সমাপ্তি টানবেন। হযরত ইসা আ. লড়াই করবেন আল্লাহর সৈনিক হিসেবে মানবতার পক্ষে, ইসলামের পক্ষে। মুসলমানরা হবে তার সহকর্মী। আর দাজ্জাল লড়াই করবে শয়তানের পক্ষে। ধর্মনিরপেক্ষবাদী গোষ্ঠী তথা ইহুদি, হিন্দু, নাস্তিক, মুরতাদ, মুশরিক, কাফিররা হবে তার অনুগামী। মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে খতম হবে ধর্মনিরপেক্ষবাদী দাজ্জাল ও তার অনুসারীবৃন্দ। জয় হবে ইসলাম ও মানবতার। কালিমার পতাকা উড্ডীন হবে সারা দুনিয়ায়।

সাম্প্রাতিককালে বাংলাদেশে লক্ষ্মণসেনকে নায়ক আর বখতিয়ারকে খলনায়ক বানাবার কোশেশ চলছে। ইহা ধর্মনিরপেক্ষবাদী রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর তৎপরতা। বাম-রাম মূলত: একই শ্রেণিভুক্ত। এরা দিল্লির তল্পিবাহক। এরা খায় বাংলাদেশে চিন্তা করে ভারতের। মাইকের কডলেস দিল্লি কোলকাতা আর হরেন ঢাকাতে। এরা আয় করে এপারে জমা করে ওপারে। বিএনপি নেতা হান্নান শাহ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের ভাষায়, এরা ভারতীয়দের চেয়েও ভারতপ্রেমিক। এরা স্বাধীন বাংলাদেশকে হায়দারাবাদ ও সিকিম বানাবার তত্ত্বে বিভোর। এরাই বখতিয়ারকে লুটেরা, ভিলেন, আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে। আর কর্ণাট থেকে আগত উৎপীড়ক শাসক সেনদের হিরো বানাচ্ছে। এদের আছে আযব মেশিন। সে মেশিন থেকে সত্য মিথ্যা হয়ে, আর মিথ্যা সত্য হয়ে বেড়োয়। নায়ক ভিলেন হয়ে আর ভিলেন নায়ক হয়ে বেরোয়। তাদের গণমাধ্যম তো আছেই। এরা নিজেদের পরিচয় দেয় অসাম্প্রদায়িক। আর মুসলমান মাত্রই তাদের কাছে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জঙ্গি, জিহাদি, গোঁড়া, ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল! প্রকৃত বিষয় কিন্তু এর উল্টো।

কুরআন হাদিসকে তারা জিহাদি বই, জঙ্গি বই হিসেবে প্রচার করে। আর রামায়ন, মহাভারত, পুরান, উপনিষদ, রবীন্দ্র সাহিত্য, বঙ্কিম সাহিত্য, দান্তে-সেক্সপিয়ার সাহিত্যে জীবনের মন্ত্র খুঁজে। অথচ বঙ্কিম-রবীন্দ্র-দ্বিজেন্দ্রলাল-ইশ্চরচন্দ্রগুপ্ত-সালমান রুশদির সাহিত্য মুসলিম অ্যালার্জিতে ভরপুর, সেক্সপিয়ার নাটক মাত্রই ইহুদি বিদ্বেষ, দান্তের ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের বিরোধীতা ও বিদ্বেষ অজানা কিছু নয়। সেখানে তারা সাম্প্রদায়িকতা খুঁজে পায় না। তারা মহানবি স. আবুবকর রা. উমার রা. উসমান রা. আলি. উমার বিন আবদুল আযিয র. আওরঙজেব র. বখতিয়ার র. এর নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে। অথচ এম কে গান্ধী, নেহেরু, ইন্ধিরা, কার্ল মার্কস, স্টালিন, ভি আই লেনিন, মাওসেতুঙ, কুনফুসিয়াস, মেকিয়াভেলিতে আদর্শ অন্বেষণ করে। তারা চেগুয়েভারকে সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক মনে করে। অথচ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে প্রথম অবতীর্ণ হয় ইমামুদ্দিন জেঙ্কি, নুরুদ্দিন জেঙ্কি ও সালাহউদ্দিন ইউসুফ আইউবি। ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে মৃত্যুবরণ করেন সিরাজ, মিরমদন, মোহনলাল, দৌলত আলিসহ অনেক। তাদের জীবন কাহিনী, অবদান, কৃতিত্ব বর্তমান মিডিয়ায় পুরোপুরি উপেক্ষিত।

এদের পরিচয় এরা নামে আরবি (বা সংস্কৃত), শ্লোগানে বাঙালি, শিক্ষায় ইংরেজি, গানে হিন্দি, ভাবনায় গান্ধি। এদের কাছে বখতিয়ার পরদেশি, লুণ্ঠক। আমরা এখন দেখবো বাংলাদেশের সেকুলারদের এসব প্রোপাগান্ডা কতটুকু যৌক্তিক। প-িত রমাপ্রসাদ চন্দ্র বলেন, গোপালের বংশধরগণকে গৌরজন যেরূপ ভক্তি নেত্রে দেখতেন, বিদেশাগত পালরাজকূল উন্মুলনকারী বিজয় সেনের এবং বল্লাল সেনের উত্তরাধিকারী লক্ষ্মন সেন সেরূপ ভক্তি লাভ করতে পারছিলেন না। বরেন্দ্রের (কৈবর্ত) বিদ্রোহে গৌড়ের প্রজাশক্তি এবং রাজশক্তি এই উভয়ের মধ্যে যে ভেদ উপস্থিত হয়েছিল, কর্ণাটগত সেনবংশের অভ্যুদয়ে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং মাৎস্যন্যায় নিবারণের অথবা ‘অনীতিকারম্বের’ প্রতিকারের অধিকার বিস্মৃত হয়ে গৌড়জন কালস্রোতে গা ঢেলে দিয়েছিলেন। মহাম্মদ-ই-খতিয়াররের অভ্যুদয় গৌড়ের সর্বনাশের মূল বা সর্বানশের ফল বলে কথিত হতে পারে না; বিজয় সেনের অভ্যুদয়ই গৌড়ের সর্বনাশের প্রকৃত মূল বা ফল বলে কথিত হতে পারে। লক্ষন সেন গৌড়রাষ্ট্রের বহি:শত্রু দমনে সমর্থ হয়ে থাকলেও প্রজাপুঞ্জের সহযোগিতার অভাবে, অভ্যন্তরীণ ঐক্য সাধনে এবং বিভিন্ন অংশের রক্ষার সুব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছিলেন না। সেজন্যই মহাম্মদ-ই-বখতিয়ার অবাধে মগধ এবং বরেন্দ্র অধিকার করতে পেরেছিলেন।১

আজ বাংলার সুবিধাবাদী কোলেবরেটররা মুসলিম শাসকদের বলছে আগ্রাসি। বখতিয়ারের নাম উচ্চারণ করলেও এসব ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের জাত যায়! সাম্প্রদায়িক সম্রাট বঙ্কিম, বোমাবাজ ক্ষুদিরাম, ধূর্ত প্রীতিলতা, সন্ত্রাসী সূর্যসেনদের নামে পাঠ্যপুস্তক, মিডিয়ায়, মঞ্চে, রাজপথে জয়গান। কিন্তু বখতিয়ারের বা বঙ্গ বিজয়ের আলোচনার জন্য প্রশাসনিক অনুমতি মিলে না। অথচ ভারতীয় সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত দার্শনিক মানবেন্দ্র নাথ রায় বলেন, ইসলামের সমাজব্যবস্থা ভারতীয় জনগণের সমর্থন লাভ করলো তার কারণ তার পেছনে জীবনের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো, হিন্দু দর্শনের চাইতে তা ছিলো শ্রেয়; কেননা হিন্দু দর্শনই সমাজদেহে এনেছিলো বিরাট বিশৃঙ্খলা আর ইসলামই তা থেকে ভারতীয় জনসাধারণকে মুক্তির পথ দেখায় ২। এসব ভারতীয় দালাল শ্রেণিদের আরেকগুরু ড. নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, গৌড় নামে বাংলার সমস্ত জনপদকে ঐক্যবদ্ধ করার যে চেষ্টা শশাঙ্ক, পাল ও সেন রাজারা করেছিলেন, তাতে কাজ হলো না। যে বঙ্গ ছিলো আর্য (হিন্দু) সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত, যা ছিলো পাল ও সেনদের আমলে কম গৌরবের ও আদরের- সেই বঙ্গ নামেই শেষ পর্যন্ত তথাকথিত পাঠান আমলে বাংলার সমস্ত জনপদ ঐক্যবদ্ধ হলো। ৩

ড. নীহাররঞ্জন রায় হকটা অস্বীকার করতে পারেন নাই। তবে সত্যটার সাথে সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তিরও বহি:প্রকাশ ঘটেছে। ‘তথাকথিত’ শব্দ ব্যাঙ্গ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইহা পরিহার করে শুধু পাঠান আমলে অথবা ‘তথাকথিত পাঠান’ বাদ দিয়ে মুসলিম আমলে লিপিবদ্ধ করলেই সুবিচার হতো। আরও একটি বিষয় ধর্তব্য ‘বঙ্গ’ নামে ঐক্যবদ্ধ হয় নাই। বাঙালাহ নামে গঠিত হয় স্বাধীন রাষ্ট্র যার আয়ুষ্কাল ছিলো দুশ বছর (১৩৩৮-১৫৩৮) বছর। ‘বাঙালাহ’ ফারসি (!) শব্দ হবার কারণেই হয়ত এড়িয়ে গেছেন তিনি।

পাদটিকা
১. রমাপ্রসাদ চন্দ্র: গৌড়রাজমালা, প্রথম নবভারত সংস্করণ, ১৯৭৫, পৃ ৮১-৮২; উদ্বৃতি: আসকার ইবনে শাইখ: মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০০৪, পৃ ৫৩
২. এম. এন. রায়: ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, (অনুবাদ- আবদুল হাই), মল্লিক ব্রাদার্স, ৫৫ কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা ৭৩, ভারত, দ্বিতীয় সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৯৫, পৃ ৮৩
৩. ড. নীহাররঞ্জন রায়: বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব) এর সংক্ষেপিত সংস্করণ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নিউ এজ সংস্করণ, ১৯৬০, পৃ ২২; উদ্বৃতি: উদ্বৃতি: আসকার ইবনে শাইখ: মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০০৪, পৃ ১৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *