ফিচার ডেস্ক ||
‘কলু’ শব্দটির সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের তেমন পরিচয় নেই। আজ আর সেভাবে চোখেও পড়ে না কলু সম্প্রদায়কে। আগে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে মাটির হাঁড়িতে বিক্রি হতো কাঠের ঘানিতে বানানো খাঁটি সরিষার তেল। হাঁড়ির ঢাকনির নিচে থাকতো তালের বিচির খোলা দিয়ে বানানো বাঁশের হাতলের ওরং। তেল তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে এই ওরংটা ব্যবহৃত হতো। এই খাটি সরিষার তেলের সঙ্গে কলু সম্প্রদায়ের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কলু হলো তেলের সঙ্গে জড়িত একটি সম্প্রদায়। সরিষা বা তেলবীজ পেষার জন্য পশু দিয়ে চালিত যে দেশীয় যন্ত্রটি তারা ব্যবহার করেন সেটিই ‘ঘানি’। ঘানি টানার জন্য কলুরা গরু কিংবা ঘোড়া ব্যবহার করেন। এই গরুগুলোকে স্থানিয় ভাষায় বলা হয় ‘বলদ’। কাজের সময় গরুগুলোর চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হত, যেন পরিশ্রম বেশি করানো যায়। এই কাজ থেকেই উদ্ভব হয় ‘কলুর বলদ’ প্রবাদটির।
আর ঘানি তৈরি হয় কাঠ দিয়ে, যেখানে এক বিন্দু লোহার অস্তিত্ব নেই। এটা তৈরি করতে রীতিমতো একটা গাছ লেগে যায়। একেকটি অংশ তৈরিতে লাগে একেক ধরনের কাঠ।
প্রত্যেকটি অংশের নামও ভিন্ন ভিন্ন। আট থেকে দশ ফুট লম্বা একটা কান্ডের অর্ধেকের বেশি থাকে মটিতে পোঁতা। ঘানির এটাই হলো প্রধান অংশ। এই অংশের নাম ‘গাছ’। পাকা কড়ই কাঠ এর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। গাছের ওপরে বেড় দেওয়া কাঠের একটা অংশ থাকে, যা ‘ওড়া’ নামে পরিচিত। সরিষা পেষার জন্য কাঠের লম্বা একটা দন্ড লাগে, এটা দেখতে অনেকটা ঢেঁকির ওঁচা বা থারি মুগুরের মতো। এর নাম ‘জাইট’। বেল গাছের কাঠ এ ক্ষেত্রে বেশি উপযোগী।
জাইটকে চাপ দেয়ার জন্য এক-দেড় হাত লম্বা এক প্রান্ত বাঁকা একটা কাঠ লাগে-এর নাম ‘ডেকা’। ডেকার বাঁকানো মাথা টুপির মতো বসে যায় জাইটের মাথায়। অন্য প্রান্ত বাঁধা থাকে একটা ভারী মোটা তক্তার এক প্রান্তের সঙ্গে। এই তক্তার নাম ‘কাতাড়ি’। গাছের নিচের অংশে একটি ছিদ্র করা হয় এবং এই ছিদ্রের লাগানো থাকে কাঠির মতো একটা চিকন কাঠ। এর নাম ‘পাতাড়ি’। এটা দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় তেল গিয়ে পড়ে নিচে রাখা পত্রে। কাতাড়ির ওপর রাখা হয় ভারি কোন জিনিস যেন সরিষা পিষে তেল বের করা যায়। কাতাড়ির সঙ্গে গরু বা ঘোড়া জুড়ে চালাতে শুরু করলেই কাতাড়ির বোঝার চাপ গিয়ে পড়ে জাইটের ওপর আর তখন জাইটের পেষনে সরিষা থেকে তেল নির্গত হয়ে পাতাড়ি বেয়ে জমা হয় পাত্রে।
প্রযুক্তির উন্নতির ফলে দেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে কাঠের ঘানিতে ভাঙ্গা তেল তৈরির প্রক্রিয়াটি। এখন তেল তৈরি হচ্ছে লোহার ঘানিতে। ভেজাল আর কৃত্রিম সরিষার তেল বাজর দখল করে নেয়ায় খাঁটি সরিষার তেলের স্বাদ পাচ্ছেনা মানুষ। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে সর্বত্র। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণে তৈরি করছেন সরিষার তেল।
বর্তমান সময়ের ব্যবসায়ীরা ইলেক্ট্রিক মোটর দিয়ে লোহার ঘানিতে উৎপাদিত তেল কম দামে বিক্রি করতে পারলেও কলু সম্প্রদায় রাত-দিন পরিশ্রম করে গরু বা ঘোড়া দিয়ে কাঠের ঘানির সাহায্যে ফোটায় ফোটায় নিংড়ানো খাঁটি সরিষার তেল উৎপদন করে সে দামে বিক্রি করতে পারেন না। যার ফলে প্রযুক্তির এই যান্ত্রিক যুগে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ঐতিহ্যবাহী এই কলু সম্প্রদায় এখন বিলুপ্তির পথে। তাই এখন সচরাচর গরুর ঘানি খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। তবে আবেগের বশে পৈত্রিক ব্যবসা হিসেবে কেউ কেউ এখনো ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন।
বর্তমান সময়েও অনেকে লাভ-ক্ষতির হিসেব না কষে সন্ধান করেন শতভাগ প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতার। কাঠের ঘানির খাঁটি সরিষার তেলের চাহিদা অনেক বেশি হলেও কলুদের তা উৎপাদন করে পুষিয়ে উঠা কঠিন। তাই প্রযুক্তির বিপরীতে অর্গানিক ক্রেতা-বিক্রেতার পেশা যেন বিলুপ্তপ্রায়।