গল্প : সুখী বেগম

আমির হোসেন ।।

বিশাল মেঘনার ওপারে চানপুরের চর গ্রামের উঁচু তাল গাছটির মাথা ছুঁয়ে পটে যাচ্ছিল জৈষ্ঠ্যের সূর্যটি। অস্তগামী সূর্যের লাল ছায়াটি প্রলম্বিত হতে হতে সমুদ্রসম মেঘনার বিপুল জলরাশির উপর নিজেকে বিছিয়ে দিয়ে একেবারে পূর্ব তীরের কাছাকাছি জেগে উঠা লালপুরের চরের জলসীমা স্পর্শ করেছে। এ চরের পূর্ব দিকে মেঘনার একটি খাঁড়ি। এরপর লালপুর গ্রাম। মেঘনার এপার ওপার জলের উপর আড়াআড়িভাবে বিদায়ী সূর্যের লালিমা তৈরি করেছে এক ঐশ্বরিক সেতু। চরের ঢালুতে জোয়ারের নতুন জলে দাঁড়িয়ে সাহেবী কায়দায় হেঁটে হেঁটে ক্ষণকাল পূর্বেও মাছ শিকার করেছিল একদল ধবল শাদা বক। পশ্চিমাকাশের গায়ে ঝুলে থাকা লাল সূর্যটি অস্ত যাবার মুহূর্তে যেন কোনো এক অলিখিত ইশারায় সবগুলো বক একসাথে ডানা ছড়িয়ে দিল খোলা আকাশের নীচে। তারপর চরের সবুজ ঘাসের উপর অত্যন্ত নিচু দিয়ে ঘাসগুলোকে ছুঁই ছুঁই করে একটি চক্কর দিল। চক্কর দিয়ে উঠে গেল অনেকটা উপরে। এরপর ভি-আকৃতিতে উড়তে শুরু করে দিল লালিমা রেখা ধরে। নিচে নদীর জলের উপর ছড়িয়ে পড়ল উড়ন্ত বকঝাকের চলমান ছায়া।

আমাদের তিন সদস্যের দলটি এতক্ষণ ব্যস্ত ছিলাম চরের বিস্তৃর্ণ ভূমিতে গজিয়ে উঠা সবুজ ঘাসের গালিচার উপর দিয়ে হাঁটাহাঁটি, ছবি তোলা ও গরু-বাছুরের চারণ দৃশ্য অবলোকণে। জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝির পর লালপুরের এ চরটিতে আর তেমন কোনো ফসলের সমারোহ থাকে না। আলু, বাদাম, মরিচসহ অন্যান্য ফসলাদি ততদিনে যার যার ঘরে তুলে নিয়ে গিয়েছেন ওপারের কৃষকরা। দু‘একটি কিরিচ নাইল্লা ক্ষেত ছাড়া সমস্ত চরটিকেই তখন গো-চারণ ভূমিই বলা যায়। এত বড় চর, সেই তুলনায় গরু-বছুরের বিচরণও যৎসামান্যই। দু‘একজন রাখাল ছেলেকে দেখা গেল কাস্তে দিয়ে ঘাস কেটে কেটে টাফা ভর্তি করে নিয়ে চরের কাছে খাঁড়িতে বেঁধে রাখা ছোট্ট নৌকায় নিয়ে রেখে আসতে। তবে বিকেল গড়িয়ে আসতে না আসতে দেখা গেল রাখাল বালকরা গরুর লেজে ধরে যার যার গরুগুলোকে নিয়ে সাঁতরিয়ে খাঁড়ি পার হয়ে পূর্বপারে চলে যেতে। ঘাস নিয়ে ছোট্ট নৌকাগুলোও ততক্ষণে কখন যেন ওপারে চলে গেল। আমরা তিন বন্ধু হানিফ, ফরিদ আর আমি চরের বৈকালিক সৌন্দর্যের আবেগে উদ্বেলিত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আর ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে গিয়েছিলাম বিস্তৃর্ণ সবুজের অনেকটুকু পথ। ফিরে এসে দেখি আমাদের পাড় হওয়ার জন্য অবশিষ্ট কোনো নৌকাই নেয় চরের কিনারায়। রাখাল বালকদের সবাই যার যার গরু-বাছুর নিয়ে সাঁতরিয়ে খাঁড়ি পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। ছোট্ট নৌকাগুলোও চলে গেছে ওপারে। আমরা যার নৌকা করে ওপার থেকে চরে এসেছিলাম, সে বলেছিল ফেরার পথে যে কারোর ছোট্ট নৌকা করে এপার চলে আসতে পারব। কিন্তু আমাদের ফিরতে সামান্য দেরি হওয়ায় কোনো ছোট্ট নৌকাই আর দেখা গেল না চরে। আর খেয়া নৌকা পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই সেখানে।

কি করা যায় এমন ভাবনায় যখন আমরা ব্যস্ত তখন নজরে এলো অদূরে হত দরিদ্র ধরনের একজন মহিলা কিরিচ নাইল্লা ক্ষেতের নিকটে খুব তরতিবের সাথে কিছু একটা বেছে বেছে তুলছে। তাকে লক্ষ করে ঘাসের উপর দিয়ে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখা গেল মহিলাটির সাথে আছে বার তের বছরের একটি মেয়ে।  হয়তো মেয়েটি মহিলার নিজেরই কন্যা। মা-মেয়ে দু‘জনেরই পরনে ছিন্ন বস্ত্র বলা যায়। মহিলাটি জৈষ্ঠ্যের খালি মাঠে চরের জমিতে লতিয়ে উঠা সাগর কলমি, হিলিশা ডোগা ইত্যাদি শাক তুলে ছোট ছোট আটি বেঁধে রাখছে। মেয়েটি তার মাকে সাহায্য করছে। তাদের একটু দূরে লম্বা দড়ি বাঁধা খুঁটি পুতে রাখা একটি দুধেল ছাগলকে ভ্যা ভ্যা করতে দেখা গেল। ছাগলটির সাথে একটি মাত্র বাচ্চা। বাচ্চাটি ক্ষণে ক্ষণে তার মায়ের ওলানে মাথা দিয়ে পট মেরে মেরে দুই চার টান দুধ খেয়ে খেয়ে কোমর বাঁকা করে নাচতে নাচতে কিছুটা দূরে সরে যাচ্ছিল। আবার মুহূর্তের মধ্যেই তার মায়ের ওলানের কাছে চলে আসছিল।

মহিলাটির সর্ব অবয়বে দারিদ্র্যের ছাপ। পরনে রং উঠে যাওয়া পুরানো শাড়ি। ব্লাউজ বিহীন। আমাদের দেখে সে শাড়ির আঁচল টেনে টেনে তার অনাবৃত্ত বাহু, গলাসহ মাথার উড়ঙ্গা উঠা চুলগুলো ঢাকার চেষ্টা করতে লাগল। সামান্য আব্রু রক্ষা করে পুনরায় তার শাক তোলায় সে মনোনিবেশ করল। আমরা তার সাথে থাকা তের চৌদ্দ বছরের মেয়েটিকে কাছে ডাকলাম। বললাম, আমরা শহর থেকে চর দেখতে এসেছিলাম। নৌকার মাঝি আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলেছিল যে কোনো ঘাসতোলা নৌকায় করে আমরা ওপারে যেতে পারব। আমাদের ফিরতে দেরি হওয়ায় সকল নৌকা চলে গিয়েছে। এখন আমরা ওপারে যেতে উপায়হীন হয়ে পড়লাম। একমাত্র তোমাদের ঐ ছোট্ট নৌকাটি ছাড়া আর কোনো নৌকা বা খেয়া দেখতে পাচ্ছি না। ঐ যে শাক তুলতে ব্যস্ত উনি তোমার কি হন? যদি তোমরা মনে কিছু না কর, আর আমাদের তোমাদের সাথে ওপারে নিয়ে যাও, তাহলে আমরা তোমাদের যথেষ্ট সম্মানী দিতে রাজি আছি। এছাড়া যে আর কোনো উপায়ও দেখছি না আমরা। এ কথা শোনার পর মেয়েটি গলা উঁচিয়ে তার মাকে উদ্দেশ্য করে করে বলল, মা উনারা বিপদে পড়েছে, ওপারে যাওয়ার আর কোনো নৌকাও নাই। আমাদের নৌকায় ওপার যাইতে পারব কিনা জানতে চাইছে। মাহিলাটি আবারও তার আঁচল টেনে উন্মুক্ত বাহু ঢাকতে ঢাকতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে নিজের মেয়েকে বলল, আমাদের ছোট্ট নৌকায় কি উনারা যাইতে পারবেন? যাইতে পারলে আমরা নিয়া যাইতে পারুম। নৌকায় টইল খাইলে নড়াচড়া না করলেই চলব।

কথানুসারে আমরা তিনজন, মহিলা ও তার মেয়ে, তাদের দুধেল ছাগল ও এর বাচ্চাসহ ঘাসের টাফা, শাকের আটি নিয়ে নৌকা ভাসাল। নৌকায় মহিলাটি জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল। তার মেয়েটি বৈঠায় চারি মেরে নৌকাটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল। নৌকা লালপুরের ঘাটে এলে আমরা মেয়েটিকে কিছু টাকা দিতে চাইলাম। জড়োসড়ো হয়ে বসা মহিলাটি তার মেয়েকে ডেকে বলল, উনাদের কাছ থাইক্কা কোনো ট্যাহা পয়সা নিসনা রানী। এবার মহিলাটির কন্ঠ শুনে তাকে যেন আমার কেমন পরিচিত পরিচিত মনে হলো। এবং তার মেয়েটির নাম যে রানী তা-ও জানা গেল। পয়সা নিবেন না কেন? আমরা তো অন্য কোনো নৌকা দিয়ে পার হলেও পয়সা দিতাম। আপনাকে দিলে দোষ কি?
দোষের কোনো কথা না ভাইজান। আমরা গরীব মানুষ পয়সা নিলে কোনো দোষ অইব না। তই আপনাদের কাছ থাইক্কা আমি কেমনে পয়সা নেই? আপনারা আমার আপন মানুষ। আপনাদের কাছ থাইক্কা ট্যাহা পয়সা নেওয়া ঠিক অইব না।
-আমরা আপনার আপন মানুষ! আমাদের আপনি চিনেন?
-হ ভাইজান, আপনেরে আমি চিনি। কিন্তুক আপনার সাথের ঐ দুইজনকে চিনি না।
-তাদেরকে আপনার চিনা লাগবে না। আমাকে আপনে চিনেন কিভাবে?
-চিনতাম না কেরে? আপনার বাড়ি গোকর্ন গাও না?
-হে, কিন্তু আপনি!
-আমার পরিচয় না দেওয়াই ভালা। দিলে আপনার মনে ঘিণা ধরব।
-ঘৃণা ধরবে! ঘৃণা ধরবে কেন? তুমি গরীব বলে ? মেয়ে মানুষ হয়ে ছাগল চড়াতে, ঘাস কাটতে ও শাক তুলতে চরে যাও বলে? কাজ করে খাওয়াতে তো কোনো দোষ নেই। বরং এতে সম্মান আছে। আমাদের প্রিয় নবী কাজকে সম্মান করতেন। এতক্ষণ আমি যাকে আপনি বলে সম্বোধন করেছিলাম, তাকে কখন যেন মনের অজান্তেই তুমি বলে সম্বোধন করে যাচ্ছিলাম।
-আমার সম্মানের জন্য না ভাইজান। আমার পরিচয় পাইলে বরং আপনারই সম্মান নষ্ট অইব।
-আমার সম্মান নষ্ট হবে! কিভাবে? আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। বললাম, আমি কি এমন কোনো কাজ করেছি যে, তোমার পরিচয় পেলে আমার সম্মান নষ্ট হবে? হলে হোক তবু আমি তোমার পরিচয় জানতে চাই। তা নহলে আমার মনের কিউরিসিটি দূর হবে না।
-তাহলে জানতেই চান?
-হে জানতে চাই।
-আপনাদের পাড়াতে হুরুন আলী নামে একজন গরীব মানুষ ছিল। তিনি খুব নিরীহ ও সরল প্রকৃতির ছিলেন। তার দুই তিনটি মেয়ে ছিল। তার বড় মেয়ের নাম ছিল সুখী বেগম। কেন যে বাজান শিশুকালে তার মেয়ের নাম সুখী বেগম রাইখাছিল তা কোনোদিন বুঝবার পারি নাই। একমাত্র উপার্জনক্ষম অভাবী ও অসুখী একজন মানুষ তার মেয়ের নাম রাখছিল সুখী বেগম। আমারে দেখলে নাকি শিশুকালে সুখী সুখী মনে অইত বাজানের । বাজানের রাখা নাম ঐ সুখী বেগম দুঃখের সাথে লড়তে লড়তে নিজের জন্মগ্রাম ছাইড়া আইয়া এখানে নিদারুন অভাবের জীবন কাটাইতেছে ভাইজান।
সুখী বেগম আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি তার এতটুকু পরিচয় পাওয়ার পর আর তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না। কোনো রকমে নিজকে সামলে নিয়ে বললাম, তোমার মুখোমুখি দাঁড়াবার সৎ সাহস আমার নেই সুখী বেগম। কারণ শরৎচন্দ্রের বিলাসী গল্পটি তোমার হয়তো পড়ার সুযোগ হয়নি। অথবা তুমি পড়ালেখা শিখতে পারনি বলে সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমি পড়েছি। সেই গল্পে একটি সংলাপ আছে-অযোদ্দার লোকেরা যেদিন সীতাকে বিসর্জন দিতে গিয়েছিল, সেদিন তাদের সাথে আমিও ছিলাম। তদ্রুপ গোকর্নের মানুষ যেদিন তোমাদের দেশান্তরি করেছিল সেদিন আমিও তাদের সাথে ছিলাম। সেদিনকার বিসর্জিত সীতারূপী সুখী বেগম তোমার বর্তমান পরিস্থিতিও যে খুব সুবিধার নয়, তা আমি তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। শুধু জানতে চাই, হুরুন চাচা বেঁচে আছে কি না?
-বাজান বাঁইচ্চা আছেন। তই অর্ধুইঙ্গা বাতাসে লুলা অইয়া চাডিপাডিতে পইরা আছেন গেল তিন বছর ধইরা। আর মা মইরা গিয়া বাঁইচ্চা গেছেন।

সুখী বেগমের সাথে কথা বলে আরও যা জানা গেল, তাহলো-গোকর্ন গ্রাম ছেড়ে এসে তারা বসতি করেছিল এ গ্রামের মধুর হাটিতে। তার সাথের তের-চৌদ্দ বছরের মেয়েটিই তার ঐ পাপের ফসল। এ ফসল রেখেই সুখী বেগমকে তার বাবা হুরুন আলী বিয়ে দিয়েছিল রাহাত নামক এক লোকের সাথে। শেষ সম্বল যা ছিল তা দিয়ে রাহাতকে দিয়েছিল যৌতুক। কিন্তু সেখানেও বিধি ছিল বাম। দুই তিন মাস যাবার পরই জানা গেল ভিন গ্রামে রাহাতের আর একটি সংসার আছে। যে সংসারে তার বেশ কয়েকটি ছেলে মেয়েও আছে। ঐ সংসারে তার আগের স্ত্রীর চাপে পড়ে সে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে। রাহাতের ঔরষেও সুখী বেগমের রয়েছে একটি আট নয় বছরের কন্যা সন্তান। এরপর হুরুন আলী প্যারালাইসিসের রোগী হয়ে বিছানা নিয়েছেন। তার চিকিৎসার খরচ বহন করতে গিয়ে মধুর হাটির তিন শতক ভিটে বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছিল। এখন তারা ভাসমান মানুষ হিসেবে বাজারের পূর্ব দিকে আশুগঞ্জ-নবীনগর সড়কের পাশে কুড়েঘর তুলে তাতে বসবাস করছেন।

কন্যা দুইটিকে নিয়ে ঝি-চাকরের কাজ করে সংসারের ব্যয় বহন করে সুখী বেগম। দুই চারটি হাঁস-মুরগি, একটি দুধেল ছাগল নিয়েই তাদের চারজনের সংসার। কখনো কখনো চরের জমি থেকে শাক তুলে এনে বাজারে বিক্রি করেও দুই চারটি পয়সা আয় করে তার। মাঝে মাঝে শুটকির ডাঙ্গিতেই মাছের পিত কাটার কাজে যায় সে। বিনিময়ে পায় কয়েকটি টাকা। ওপারের যাবার ছোট্ট নৌকাটিও মূলত: ঐ ডাঙ্গির মালিকেরই। তার অতিরিক্ত খুট ফরমায়েস খেটে দেয় বলেই নৌকাটি অবসরে বাঁধা থাকলে সুখীকে নিয়ে যেতে মানা করে না ডাঙ্গির মালিক। এসব শুনে সুখী বেগমের সামনে দাঁড়াতে আর কোনোভাবেই পারছিলাম আমি। প্রথম থেকেই আমি অস্বস্তি বোধ করছিলাম। তাছাড়া আমার সাথে থাকা কবি বন্ধু হানিফ ও ফরিদেরও অস্বস্তি হচ্ছিল যা আমি টের পাচ্ছিলাম। সুখী আঙুল দিয়ে অদূরের কুড়ের ঘরটি দেখালে আরেকদিন এসে আমি তোমার বাজানকে দেখে যাব বলে সেদিনকার মতো সেই স্থান ত্যাগ করলাম আমরা। এরপর যেন কিছুক্ষণের জন্য একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

সিএনজিতে বসে শহরের দিকে ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলাম মানুষের জীবনে যে কতরকম ট্র্যাজিডি থাকতে পারে। সেই এক যুগেরও পূর্বের কথা। আমাদের গোকর্ন গ্রামেই ছিল হুরুন আলীর বসবাস। নিত্য অভাব ছিল তার সংসারে। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে গৃহস্তদের ক্ষেতে-খামারে, ঘর-বাড়িতে কাম-কাইজ করে কোনো রকমে চলে যাচ্ছিল তাদের জীবন। সুখী বেগমের বয়স তখন ষোল কি সতের। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাস এলে গৃহস্থ ঘরের লওয়া-থওয়ার সময় কাজের ভীষণ চাপ থাকে। ধান কাটা, ধান মাড়াই, সেদ্ধ করা, রোদে শুকানো ইত্যাদি কাজে গৃহস্থের বউ-ঝিদের এক রত্তি অবসর মিলেনা। কাজের চাপে জীবন তাদের তখন ত্রাহি ত্রাহি করে। তখন গৃহস্থদের এসব কাজে দুই-আড়াই মাসের জন্য লাগা কাজের বেটিদের দরকার হয়। গ্রামের ধনী ও প্রভাবশালী গৃহস্থ খায়ের মিয়া সর্দারের ঘরে মাসকি কাজ নিয়েছিল সুখী বেগম। সারাদিন ধান-বনের কাজ ব্যতিরেকেও অনেকটা রাত অবধি কিংবা রাত্রিশেষে ফিঙে ডাকা ভোরে বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে চাতালের বৃহদাকৃতির চুলায় ধান সিদ্ধ করার কাজ করতে হতো সুখীকে। তখন সময় সুযোগ মতো তার বাড়ন্ত শরীরের দিকে নজর পড়ে গৃহস্থ খায়ের মিয়ার বখাটে ছেলে আলমের। আলম ছলে-বলে কৌশলে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সুখীকে ভোগ করতে চায়। সুখী কৌশলে বলে আপনারা গৃহস্থ মানুষ আর আমরা গরীব অভাবী মানুষ। আপনাদের বাড়িতে কাজ করে খাই। আপনার বউ হবে আরেকজন ধনী গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে।

-রাখ তোর গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে। শোনস নাই কত রাজা বাদশা তাদের ভালোবাসার টানে রাজত্ব ছাইড়া, সিংহাসন ছাইড়া পথে নাইমা আইছে। আমি প্রয়োজনে তরে ভালোবাইস্সা আমার বাবার বাড়ি-ঘর, জমি-জামা সব ত্যাগ করুম। প্রয়োজনে গাছতলায় বসতি করুম। তবু তরে ছাড়া আমি আর কাউরে আমার বউ কইরা ঘরে তুইল্লা আনুম না। এত ভালোবাসার কথা ও সুখ স্বপ্ন দেখিয়েও আলম যখন সুখী বেগমের মন পাচ্ছিল না তখন সে তাকে ভয় দেখাতে লাগল। তার প্রস্তাবে রাজি না হলে সুখীর এমন কি তার বাজানেরও বড় ধরনের ক্ষতি হবে বলে তাকে জানায় আলম। ভয় দেখিয়ে মাঝে মাঝেই তার সাথে শারীরিক ঘনিষ্ট হতে চেষ্টা করে আলম। প্রথম প্রথম এসব অনৈতিক কাজে সাধ্যমতো বাধা দিতে থাকে সুখী বেগম। কিন্তু আলমের বার বার চেষ্টায় একদিন ভেঙে যায় সুখী বেগমের বাধার বাঁধ। সুযোগ বুঝে আলম ঐ চাতালের মধ্যে স্তুপ করে রাখা খড়ের গাদার আড়ালে ফেলে সুখীর সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হয়। একবার যখন আলম টপকিয়ে ফেলে সুখী বেগমের বাধার দেয়াল। এরপর আর ঠেকায় কে তাকে?

ভাদ্র মাসের কুকুরের মতো যৌন পাগল হয়ে উঠে আলম। সুযোগ পেলেই সুখীর বাড়ন্ত শরীরের উপর চড়াও হতে থাকে সে। সুখীও এক সময় যৌনতার গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসাতে থাকে নিজের শরীর। এর ফলে যা হবার তাই হলো। পাড়াময় জানজানি হয়ে গেল সুখী বেগম আলমের অবৈধ সন্তানের মা হতে যাচ্ছে। বিষয়টি গ্রামের সাহেব-সর্দারদেরও নজর এড়ালো না। অতএব গ্রামের মাতব্বরগণ এক রাতে বিষয়টি নিয়ে সালিশে বসলেন। খায়ের মিয়া গ্রামের ধনী, প্রভাবশালী ও বড় গোষ্ঠীওয়ালা মানুষ। তার খুব বেশি বিরুদ্ধাচারণ করার ক্ষমতা কোথায় ঘুষখোর মাতাব্বরদের। তাদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল যে, পুরুষ পোলাপান হইল রশি ছাড়া ষাড়ের মতো। সুযোগ পাইলে এরা গাই গরুর উপর চড়াও হইবেই। গাই গরুর গলায় রশি দিয়ে বাইন্দা রাখার দায়িত্ব অইল গাই গরুর মালিকের। এক্ষেত্রে খায়ের মিয়ার ছেলের দোষ বরং কমই বলা যায়। বেশির ভাগ দোষই ঐ হুরুন আলীর দামরি মেয়েটারই। গাই বাইন্দা না রাখলে ত তার উপর ষাড় উঠবই। আর ষাড় উঠলে গাই গরু বাছুর ত বিয়াইবই। এমন সব অশ্লিল কথাবার্তার ভেতর দিয়েই শেষ করল প্রহসনের বিচার। মাতাব্বরদের একতরফা বিচারে রায় হলো-আলম যেহেতু এহেন অপকর্ম করেছে সেহেতু তাকে দশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। যে টাকা আদায় সাপেক্ষে গ্রামের মসজিদ-মাদ্রাসার কাজে লাগানো হবে।

আর হুরুন আলীর মেয়ে সুখী বেগম যেহেতু পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে পাপের ফসল পেটে ধারণ করেছে সেহেতু তাকে এবং তার পরিবারকে এ গ্রামে বসবাস করতে দেওয়াও হবে আরেক পাপের কাজ। সুতরাং তাকে নিয়ে হুরুন আলী আগামীকাল সকালে গ্রাম ছেড়ে দেশান্তরি হবে। তার স্থাবর যা কিছু আসে সাথে নিয়ে যাবে। আর ভিটে বাড়িটুকু মাতাব্বরদের জিম্মায় থাকবে। কখনো বিক্রি করতে পারলে প্রধান মাতাব্বর বিক্রিকৃত অর্থ হুরুন আলীর ঠিকানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। বার তের বছর পূর্বের প্রহসনের সেই বিচার আমাকেও নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছিল। কোনোরূপ প্রতিবাদ প্রতিরোধ করার পারিবারিক পর্যায় বা সাহস কোনটাই আমার ছিল না। এর পর থেকে সব সময়ই একধরনের অপরাধী কা-পুরুষ বলেই মনে হতো নিজেকে। যা-ই হোক। যেই কথা সেই কাজ। পরের দিন সকাল সকাল হুরুন আলী তার গর্ভবতি কন্যা সুখী বেগমকে নিয়ে সপরিবারে দেশান্তরি হলো। পাড়া প্রতিবেশিরা কেবল মূক-বধির হয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই সকরুণ দৃশ্য অবলোকন করছিল। আর এদিকে দেশান্তরি হওয়া হুরুন আলীর স্ত্রী-কন্যাদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছিল গোকর্ণ গ্রামের বাতাসের শরীর।

 

লেখক পরিচিতি: কবি ও কথাসাহিত্যিক আমির হোসেন ১৯৭৩ সালের ৫ জানুয়ারি কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের গৌরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. সুরুজ মিয়া ও মাতার নাম গুলবরের নেছা। তিনি ১৯৯৬ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অনার্সসহ এমএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৩ সালে বিএড ও ২০১৫ সালে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি লেখালেখির সাথে সক্রিয়। কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, গবেষণা, গ্রন্থালোচনা, সম্পাদনাসহ বহু গ্রন্থের প্রণেতা লেখক আমির হোসেন নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন দেশ ও দেশের বাইরের অসংখ্য জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যের পাতা, শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যের ছোট কাগজ বা লিটল ম্যাগ, সাহিত্য সংকলন ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা-২৭টি। তিনি সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘স্বদেশ’সহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনার সম্পাদনার সাথে জড়িত আছেন।
তিনি দেশ ও দেশের বাইর থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক, পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।

ঠিকানা: আমির হোসেন, চেতনায় স্বদেশ গণগ্রন্থাগার, শিমরাইলকান্দি, (খাদ্য গুদামের পশ্চিম গেট), ব্রাহ্মণবাড়িয়া। মোবাইল: ০১৮১৮০৩১৫৩২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *