ছোটগল্প : জীবনের মৃত্যু

আল-আমীন

কপোতাক্ষ নদের পাড়ে ছোট্ট একটা গ্রাম। চারপাশ আঁকাবাঁকা সাপের মত শুয়ে থাকা নদের বেষ্টনী । সামান্য উদার দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় এটাও একটা দারুচিনির দ্বীপ। এখানে বসতি মাত্র ত্রিশ ঘর মানুষের। গ্রামের মাঝখান দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা। ইলেকট্রিসিটির ছোঁয়াও নেই সব বাড়িতে। কয়েক গ্রাম মিলে একটামাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও হাতে গোনা। গঞ্জে একটা হাইস্কুল আছে। ওই হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে জীবন। জীবনের বন্ধু-বান্ধব বলতে- হাসান, সোহাগ, নাছিম, জামিল এরাই। এদের ভেতর সবচেয়ে দুরন্ত স্বভাবের ছেলে হলো জীবন। জীবন এই গ্রামের সৈয়দ বাড়ির ছেলে। বংশগত দৃষ্টিকোণ থেকে এই বংশের মানুষ একটু উঁচু শ্রেণির। তবুও সবার সাথে জীবনের ছিলো অবাধ মেলামেশা। বংশীয় দিক কেন্দ্র করে সে তার বন্ধু বান্ধবের ভেতর কখনো ভেদাভেদ সৃষ্টি করার বিন্দু মাত্র অবকাশও ব্যক্ত করেনি। সবার সাথে একটা ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো জীবন। সবকিছু মিলিয়ে ভালোই চলছিল তাদের নিত্য জীবনযাপন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কপোতাক্ষ নদে লাফালাফি। ঠিক নয়টা বাজতেই স্নানকার্য শেষ করে স্কুলে গিয়ে ফাস্ট বেঞ্চ ধরার তাড়াহুড়ো। একটায় টিফিন খেয়ে চারটায় বাড়ি ফেরা। বিকেলে আবার একসাথে হয়ে এমাঠ ওমাঠ দৌড়াদৌড়ি। সন্ধ্যার একটু আগে বাড়ি ফিরে ক্যারোসিনের কুপি জ্বালিয়ে ছাত্রত্ব রক্ষার জন্য বইয়ের পাতা উল্টা উল্টি। তারপর রাত দশটা বাজার আগেই ঘুম।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে ওঠেও রুটিন মাফিক একই কাজগুলো করতো হাসান, সোহাগ, জামিল, জীবন এরা সবাই।
সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। ঋতুচক্র থেকে গ্রীষ্মকাল বিদায় নিয়ে মাত্র শুরু হয়েছে বর্ষাকাল। বর্ষার স্বভাব হলো এই মেঘ এই বৃষ্টি। তবে সেদিন ভোর থেকেই বেশ বৃষ্টি। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি জমে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে এমন বৃষ্টি হচ্ছে তাই মাটির রাস্তা বেশ পিচ্ছিল হয়ে গেছে। মাটি ফুলে ফেঁপেও উঠেছে কয়েক জায়গায়। আবার জায়গায় জায়গায় জমেছে স্যাঁদলা। তাই হাটার সময় নিজেকে সামলে রাখতে পায়ের বুড়ো আঙুল টিপে টিপে হাঁটতে হচ্ছে।
আমি জীবন সহ আমরা সবাই বসে আছি আলম ভাইয়ের চার পায়ে দাড়িয়ে থাকা টং চায়ের দোকানে। এই মুহূর্তে দোকান বন্ধ। বন্ধ থাকাটাই স্বাভাবিক। এই সময় দোকান খোলা আছে মানে অনেকটা অষ্টম আশ্চর্যের মত। এই দোকানের ঝাপ তোলা হয় সন্ধ্যায়। তারপর দেড় থেকে দুই ঘন্টা চলে জ্বালানী পাতির চা খাওয়া পর্ব। চলে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে খাওয়া মানুষের সস্তা দরের নিকোটিনের ধোঁয়া উড়ানোর দৃশ্য। এসব শেষ হলেই সময়মত দোকান বন্ধ করে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হন আলম ভাই। গুন গুন আওয়াজে তার প্রিয় গানটা গাইতে গাইতে। যেমন-
“তুই বড় রঙ্গিলা,
বাওয়াই রে,
বাওয়াই কতই যাদু জানো”
আজ আমরা কেউ স্কুলে যাইনি। বর্ষার কল্যাণে নদে নতুন পানি থৈ থৈ করছে। পানি বাড়তে বাড়তে প্রায় ব্রীজ ছুঁইছুঁই। মূলত আমরা সবাই এই বর্ষাবরণ করি ব্রীজ থেকে নদের পানিতে লাফিয়ে পড়ার মাধ্যমে। এখন সবাই মিলে সেই ফন্দিফিকির আটছি।
তখন হঠাৎ গ্রামের ভেজা কাঁচা রাস্তার পথ ধরে হাঁটতে দেখা যায় শিরিনকে। বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে শিরিন। ফর্সা গোত্রবর্ণের একটা মেয়ে সে। চিকন দুইটা ঠোঁট। ঠোঁটে আষাঢ়ী আকাশের মেঘের মত লেপ্টে আছে একরাশ মিষ্টি হাসি।
শিরিনের বাড়িটা গ্রামের দক্ষিণ দিকে। সে দক্ষিণ পাড়ার রেনু চাচার মেয়ে। আমরা সবাই যে শিরিনকে চিনি এরকমটাও নয়। আমাদের ভেতর নাছিম শুধু তাকে চেনে। তাকে না চেনার কারন হলো শিরিন তার মামার বাসায় থেকে পড়াশোনা করে। শিরিনের বাবার আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে তাকে পড়াশোনা করতে হচ্ছে সেখানে থেকে। নাছিমের কাছ থেকে যতটুকু জেনেছি তাহলো শিরিন পড়াশোনায় বেশ ভালো। এবার অষ্টম শ্রেণির জে.এস.সি পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ পেয়েছে।

এই প্রথম শিরিনকে দেখে জীবনের উত্তাল স্বভাবচরিত্রের বুকে শান্ত নদীর মত ঢেউ খেলছে। ভালোবাসা নামক প্রবল ঝড়ের ধাক্কায় আজ যেনো ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে তার ভেতরকার সব লালিত ছেলেমানুষী। এই প্রথম জীবনকে একটা দীর্ঘ সময় ধরে চুপ থাকতে দেখলাম। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর জীবন মুখ দিয়ে একটাই আওয়াজ বের করলো- কে ও?
তারপর থেকে স্কুল যাওয়া বাদ দিয়ে প্রতিদিন তাকে একপলক দেখার তীব্র অপেক্ষা নিয়ে রাস্তার পাশে আলম ভাইয়ের টং দোকানের চড়াটে বসে থাকতো জীবন। জীবনের চোখেমুখে দৃশ্যমান প্রেমবোধ লক্ষ্য করে বেশ হাসাহাসিও হতো তার বন্ধু মহলে। চলতো জীবন শিরিনকে কেন্দ্র করে তুলকালাম হাসিঠাট্টা।
তাদের দেখা হতো না প্রতিনিয়ত। তবে দুই একদিন পরপর দেখা হয় তাদের। তবে এই অল্পস্বল্প দেখাতেই শিরিনের মস্তিষ্কের ভেতর বেশখানিকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে জীবন। যতদূর জানি আজকাল শিরিনের সাথে চোখাচোখিও হচ্ছে জীবনের। এভাবে কিছুদিন যেতেই জীবন সাহস করে তার ভালোবাসার কথা জানায় শিরিনকে। সে মুখে কিছু বলেনি। তবে মুচকি হাসিতে জীবনের ছুড়ে দেওয়া প্রেম প্রস্তাবকে সম্ভাষণ জানিয়েছে।
এই সুযোগ মোটেই হারাতে চায় না জীবন। সরাসরি নিজের বাড়ির অভিভাবকে জানিয়েছে সে। তবে তার পরিবারের একদম সম্মতি নেই এই প্রস্তাবে। কারন শিরিন নিচু জাতের মেয়ে। জ্ঞাতি হিংসার কারনে নিচু জাতের মেয়েকে ঘরের বউ মানতে অনিচ্ছুক জীবনের পরিবার।
অন্যদিকে জীবন শিরিনকে কথা দিয়েছে সারাজীবন একসাথে বাঁচার। পারিবারিক অসম্মতি টের পেয়ে বেশখানিটা হকচকিয়ে গেছে জীবন। তবে শিরিনকে ছাড়া তার বেঁচে থাকা একদম অসম্ভব বলে ঠিক করে নিয়েছে জীবন।
এদিকে গ্রামের দশদিকে জীবন আর শিরিনের সম্পর্কের কথা ছড়িয়ে গেছে। তারা দুইজন এখন সবার মুখের অন্যতম আলোচিত বিষয়। মেয়ের সম্মান রক্ষার তাগিদে শিরিনের বাবা রাতের আঁধারে সংকোচিত চেহারা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে জীবনের বাবা মায়ের কাছে। তারা তাকে তুমুল অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাদের বাড়ি থেকে। জীবন শিরিনের ভালোবাসার শেষ দীপ্তটাও নিভতে শুরু করেছে এতক্ষণে।
মেয়ের দুর্নাম ঘোচাতে শিরিনের বাবা মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। এ মাসের নয় তারিখ শুক্রবার শিরিনের বিয়ে। আজ মঙ্গলবার। আর দুইদিন পর শিরিনের বিয়ে।
জীবন তার বাবা-মাকে অনেক অনুনয় বিনয় করেও রাজি করাতে পারেনি। বিষয়টি কিছুতেই মানতে পারছে না জীবন। ইতিমধ্যে সে বেশ কয়েকবার গেছে শিরিনের বাবা-মা’র কাছে। তারা পরিষ্কার না করে দিয়েছেন।
আজ শুক্রবার শিরিনের বিয়ে। জীবন শিরিনকে অন্য কারো পাশে দেখতে পারবে না বলে হতাশ মন নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে।
শিরিনের বিয়ের বরপক্ষের গাড়িও এসে পৌঁছে গেছে। চারপাশে সস্তা বাজির বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। জীবনের চোখ যেন আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসছে প্রচন্ড ঘুমে। তবুও অবচেতন মনে কয়েকবার ডাকে- শিরিন, শিরিন….
এদিকে শিরিন তার নতুন জীবনসঙ্গীর হাত ধরে নতুন ঠিকানায় যাওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করেছে,
অন্য দিকে জীবন হতাশায় মুষড়ে পড়ে মৃত্যুর দিকেই যেন এগিয়ে যাচ্ছে।

৪ comments

  1. Emon protiva ke harale amra sotti e onek boro somvabona ke harabo…
    Dhonnobaad Muktobuli.. take platform dewar jonno..obosso eta tar protiva er e gun..bye thah way boye choluk ei poth chola nobin der jonne jara boro hobar pothe..
    Valobasha roilo muktobulir jonno, Al Amin er jonno…❤️

Leave a Reply to Khadijatul moon Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *