মাহমুদ ইউসুফ
জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, আগ্রাসনবাদ, সন্ত্রাসবাদের ইতিবৃত্তের এ পর্বে আমরা আসাম, আক্রা ও কোরিয়ার তিনটি ক্ষেত্রের তথ্য উপস্থাপন করব।
আসাম ম্যাসাকার ১৯৮৩
১৯৮৩ সালে ভারতের আসামে ৬ ঘণ্টায় খুন করা হয় ৫ হাজার বাঙালি মুসলমান। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কপিলি নদীর তীরের ছোটো শহর নেলির বাঙালি মুসলিম অধিবাসীদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালায় অসমিয় হিন্দুরা। সকাল ৮.৩০টায় কয়েক হাজার সশস্ত্র অসমিয়া রামদা, ছুরি, বর্শা, কুড়াল ও দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নেলির তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। মুহূর্তেই শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। বেশির ভাগ পুরুষ বাইরে থাকায় হত্যার শিকার হয় নারী ও শিশুরা। প্রাণ বাঁচাতে মুসলিমরা ছুটে যায় কপিলি নদীর দিকে। কিন্তু সেখানে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে ছিলো হানাদার হিন্দুরা। শুরু হয় নির্বিচারে মানুষ খুন। রক্তে লাল হয়ে ওঠে কপিলির স্বচ্ছ পানি। লাশে লাশে ভরে ওঠে নদীর দীর্ঘ পাড়। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয় হাজার হাজার ঘরবাড়ি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলে গণহত্যা। এই ঘটনায় শাহাদাত বরণ করেন প্রায় ৫ হাজার বাঙালি মুসলমান। যার ৩ হাজার ৫০০ জনই শিশু। যারা প্রাণে বেঁচে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে জায়গা পেয়েছিলেন তারা অবস্থা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসার পর অর্থাৎ ঘটনার ১৬ দিন পর স্বগৃহে ফিরে এসে দেখেন যে সেই ধানের গোলার আগুন তখনও জ্বলছে। নেলি ছাড়াও নগাঁও জেলার ১৩টি গ্রাম আক্রান্ত হয়। আলিসিংহ, খুলাপাথর, বসুন্ধরি, বুগ্দুবা বিল, বুগ্দুবা হাবি, বর্জলা, বুতুনি, ইন্দুরমারি, মাটি পর্বত, মুলাধারী, মাটি পর্বত নং ৮, সিলভেতা ও বর্বুরি। তবে নেলিতে হত্যাযজ্ঞের তীব্রতা ছিলো বেশি
সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো, নেলি গণহত্যার জন্য আজ তক কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি, শাস্তি দুরস্তান। পুলিশ চার্জশিট বানিয়েছিল, পরে সেগুলোও বাতিল করে দেয়া হয়। ১৯৮৩ সালে নিযুক্ত করা হয় ত্রিভুবন প্রসাদ তিওয়ারি কমিশন। ১৯৮৪ সালে রিপোর্ট সরকারের কাছে দাখিল করা হয়। তাতে কী লেখা আছে পরের আর কোনো রাজ্য সরকার তা জাতিকে জানায়নি। গোপনীয়তার এতিহ্য আজ তক চলছে। ২০০৪ সালে এক জাপানি গবেষক গৌহাটির অমিয় কুমার দাস ইন্সটিটিউটে নেলির ওপর নথিপত্র পড়তে গেলে রাজ্য সরকার তাকে গ্রেফতার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়। দিনের আলোয় সংঘটিত এতবড় নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কোনো বিচার ৩৭ বছরেও হয়নি। এই হলো ‘সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারত’!
এর আগে ১৯৭৯ সালে আসামে শুরু হয় বাংলাদেশি খেদাও আন্দোলন। অল আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদের বাংলাদেশি খেদাও আন্দোলনে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ তক প্রায় ৩০০ এর মত খুন, ১৫০০ এর বেশি মানুষ আহত। এছাড়া জ্বালাও-পোড়াওসহ অনেক দুর্ঘটনা ঘটায় হিন্দুরা।
[সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর, ইতিহাসের জানালা, নবপ্রকাশন, বাংলাবাজার ঢাকা, জুন ২০১৫ পৃ ১৮-২১ ]
কোরীয় যুদ্ধ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন প্রভৃতি শক্তির চাপিয়ে দেওয়া কোরীয় যুদ্ধ চলে ২৫ জুন ১৯৫০ তারিখ থেকে ২৭ জুলাই ১৯৫৩ তারিখ তক। উত্তর কোরিয়ার পক্ষে ছিলো রাশিয়া, চীন। আর দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে ছিলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, নিউজিলান্ড, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, বেলজিয়াম, গ্রিস, কলম্বিয়া, নরওয়ে প্রভৃতি রাষ্ট্র।
১৯১০ সাল থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ খতম হওয়ার আগ তক জাপান কোরীয় উপদ্বীপ শাসন করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পণের পর মার্কিন প্রশাসন উপদ্বীপটিকে ৩৮তম সমান্তরাল রেখায় ভাগ করে, এর মধ্যে মার্কিন সামরিক বাহিনী দক্ষিণ অর্ধেক নিজেদের দখলে আনে এবং সোভিয়েত সশস্ত্র বাহিনী উত্তর অর্ধেক অধিকারে আনে।
কোরীয় উপদ্বীপের উত্তরে প্রতিষ্ঠিত হয় সাম্যবাদী সরকার আর অন্যদিকে দক্ষিণে মার্কিনিদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ডানপন্থী সরকার। ৩৮তম সমান্তরাল রেখা ক্রমেই দুই কোরীয় রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক ভাগ পয়দা করে। যদিও যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব তক আলোচনার জন্য যোগাযোগ চলতে থাকে, ধীরে ধীরে দু পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বর্ডারে বিচ্ছিন্ন লড়াই সংঘটিত হয়। পরিস্থিতি রণাঙ্গনে রূপান্তরিত হয় যখন ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে। দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে আন্তর্জাতিক তিন লাখ একচল্লিশ হাজার সৈন্যের ৮৮ শতাংশই মার্কিনিরা প্রদান করে। অনুমান করা হয় ২৫ লাখের উপরে বেসামরিক মানুষ এই যুদ্ধের ফলে হতাহত হয়েছে। অনেকের বিশ্লেষণে এই যুদ্ধ স্নায়ুযুদ্ধের অংশ হিসেবে গণ্য। দক্ষিণ কোরিয়া পক্ষে সৈন্য নিহত হয় ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪২৬ জন। গুম ও নিখোঁজ ৩২ হাজার ৯২৫, আহত ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৪৩৪ । উত্তর কোরিয়া পক্ষে মৃত সৈন্য সংখ্যা ৩,৬৭,২৮৩-৭,৫০,২৮২। মোট আহত ৬,৮৬,৫০০-৭,৮৯,০০০।
[উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে সংগৃহীত- ২৭ জুন ২০২১]
আক্রায় ইঙ্গ-ফরাসিদের তাণ্ডব
উনিশ শতকের মধ্যভাগে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যৌথভাবে মধ্যপ্রাচ্যে এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। তৎকালীন দুনিয়ার অন্যতম বাণিজ্যিক নগরী ছিলো আক্রা। ১৮৪০ সালের নভেম্বর মাসে ৩ ঘণ্টারও কম সময়ে ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনী আক্রা শহরের উপরে ৬০,০০০+ কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। অতঃপর বৈরুত শহরের উপর বোমা হামলা শেষে স্থল বাহিনী নামিয়ে দেওয়া হয়। মাউন্ট লেবাননে নতুন করে বিদ্রোহের আগুন জ্বালানো হয়। এর আগে ফিলিস্তিন ও লেবাননে প্রথমে উপজাতি বিদ্রোহ, পরে ম্যারোনাইট খ্রিস্টানদের দিয়ে বিদ্রোহ ঘটানো হয় কিংবদন্তি ন্যায়পরায়ণ ও জনদরদী মিশরীয় শাসক মুহাম্মাদ আলির বিরুদ্ধে। এই হলো ব্রিটেন-ফ্রান্সের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক নীতি!
[মঈন বিন নাসির, প্যালেষ্টাইন থেকে বসনিয়া, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি, ঢাকা, অক্টোবর ২০০০, পৃ ১১]