শাহরিয়ার মাসুম ।।
আঙুলের ডগায় তীব্র ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বেলে দেখি বৃদ্ধাঙ্গুলির ডগা থেকে ত্রিশ গ্রাম পরিমাণ মাংস নেই। খাটের কিনারায় খয়েরি রংয়ের গাউন পরা ভদ্রলোককে দেখে বুঝতে আর বাকি রইল না এটা কার কাজ। ঝট করে উঠে খপ করে ধরে ফেললাম। টেনে নিয়ে বসালাম চোখ ধাঁধানো আলোর নিচে আমার পড়ার টেবিলে। মুহূর্তের মধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদের সব আয়োজন সেরে ফেললাম। আয়োজন বলতে নারকেলের শলার তৈরি ঝাড়ু।
–নাম কী?
-তেলাপোকা।
-বাবার নাম?
-তেলাপোকা।
-দাদার নাম?
-তেলাপোকা ওরফে তেইল্যাচোরা।
-নানার নাম?
-তেলাপোকা।
-তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর সবার নাম-ই কি তেলাপোকা?
-হ্যা।
-আর কোনো নাম?
-আরশোলা।
-মাংস খেয়ে নিলি ক্যান?
-প্রতিশোধ।
-কিসের?
-ইন্টারমিডিয়েটে প্র্যাকটিক্যালের নামে ডিসেকটিং টেবিলে আমার দাদার ব্যবচ্ছেদ করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করেছেন। অনার্সে করেছেন বাবাকে।
-তুই কে?
-তেলাপোকা।
– আমার বাসায় কী হিসেবে আছিস?
-প্রজা ভাবলে ভুল করবেন। সম্পূর্ণ স্বাধীন নাগরিক। আপনার কোনো নিয়মনীতির ধার ধারি না আমরা।
-আমিও ধারি না। তোকে ঝাটা দিয়ে পিটিয়ে জুতোয় পিষে মারব এখন।
-পরবর্তী ফলাফলটা একটু ঐকিক নিয়মে হিসাব কইরেন। প্রতিশোধ। প্রতিশোধ।
-তোকে তো মেরেই ফেলব। প্রতিশোধ নিবি কী করে?
-রিমান্ডের খবর ইতোমধ্যেই পৌঁছে গেছে আমার গোত্রের সদস্যদের কাছে।
-তোদের গোত্রের নাম কী?
-ব্লাটিডি।
-ঐকিক নিয়মের বিষয়টা কী? একটু খুলে বল তো!
-সরি, আমাদের গাউন খোলা যায় না।
-উফ্ হেয়ালি রাখ তো। বলছি খোলাসা করে বল।
-ধরেন, আপনার বাসায় আমরা শ’দুয়েক পরিণত তেলাপোকা আছি। প্রত্যেকে ত্রিশ গ্রাম করে মাংস নিলে আপনার শরীরের অন্তত ৬০০ গ্রাম মাংস হাওয়া হয়ে যাবে। সহ্য করতে পারবেন?
-বিষয়টা খুবই ভয়ঙ্কর। কঙ্কাল পড়ে থাকবে শুধু। কিন্তু আমি মোটেও ভয় পাই নি। কারণ তোদের সেই ক্ষমতা অনুপস্থিত। সংগঠন বিষয়টা তোদের রক্তে নেই। পিঁপড়া হলে কথা ছিল। আলাদাভাবে তোরা প্রত্যেকেই শক্তিশালী। কিন্তু সব শক্তিকে একত্র করে মহাশক্তি বানানোর মুরোদ নেই। অতএব ঝাটার আঘাতে মর।
-না, না, না। মারবেন না ওস্তাদ। মেরে ফেললে প্রশ্ন করবেন কাকে?
-গুড পয়েন্ট। তোর পরিচয় বল।
-আর্থ্রোপোডা। চিংড়ি, কাঁকড়াদের আত্মীয় হই।
-বৎস, এটা বলে আমার কাছে আলাদা কোনো দাম পাবি না। চিংড়ি,কাঁকড়ার অনেক দাম। তোদের তো চার পয়সারও দাম নেই। সুযোগ পেলেই পিষে নয়ত বিষে মারতে চায় তোদের।
-চিংড়ি, কাঁকড়াও তো মানুষ দাঁতে পিষে চিবিয়ে খায়। ফলাফল তো একই, মৃত্যু।
-সে যাই হোক, ওদের লাশ তো আর রাস্তাঘাটে পড়ে থাকে না। তোরা তো ক্লাসলেস।
-অবজেকশন, আমাদের ক্লাস ইনসেক্টা।
-ওহ্, তাই নাকি? তোদের তাইলে ক্লাসও আছে! তা জাত পাত কিছু আছে?
-জাত হিসেব করে কুল পাবেন না। আমরা আমেরিকান।
-কী বলিস? তোরা আমেরিকান?
-পেরিপ্লানেটা অ্যামেরিকানা। কোনো সন্দেহ?
-না, না। সন্দেহ করতে যাব কেন? একটু অবাক হলাম।
-এখন কি ঝাটা দিয়ে মারবেন?
-নাহ্, ঝাটা দিয়ে মেরে কি আর নির্বংশ করা যাবে তোদের! কত বরফ যুগ গেল, বিরাম যুগ গেল। তোদের বিনাশ হলো না। সেই জুরাসিক যুগ থেকে তোরা টিকে আছিস। আমি একা তোকে মেরে কি করব রে।
এরপর খানিকটা বিরতি নিলাম। কিচেনে গিয়ে কফি বানিয়ে ওর সামনে বসেই চুক চুক করে খেলাম। সেই ফাঁকে আরো কিছু প্রশ্নের জাল বুনলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম বেটা তেলাপোকা শুঁড় নাড়িয়ে কিছু একটা করছে। নিশ্চয়ই ওর পরিবারের লোকদের খবর পাঠাচ্ছে। আমি ঝাটা দিয়ে টেবিলে শব্দ করলাম। তেলাপোকাটা নড়েচড়ে বসল। বলল,
-ওস্তাদ রেডি। প্রশ্ন করেন।
-তোদের মধ্যে হিমু হিমু একটা ভাব দেখতে পাচ্ছি। তোরা কি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়িস?
-হিমু হিমু ব্যাপারটা কী?
-এই যে, তোরা রাত-বিরাতে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করিস। অবশ্য তোদের হলুদ পাঞ্জাবি নেই, খয়েরি গাউন আছে। এখানেই শুধু ঘাপলা। বাকিটা মিলে যায়।
-প্রাকৃতিকভাবেই আমরা নিশাচর। হুমায়ূন পড়ে হইনি। তবে তার পোকা উপন্যাস পড়েছি। কচ কচ করে লাশ খেয়ে ফেলার গল্প। আমাদের নিয়ে লেখা। শুধু হিমু হিমু ব্যাপার খেয়াল করলেন, মিসির আলীর ব্যাপারটা খেয়াল করলেন না!
-সেটা কী রকম?
-আমরাও লজিক মেনে চলি। যেমন ধরেন, আপনি হঠাৎ লাইট জ্বেলে দেখলেন আমরা দলবেঁধে রান্নাঘরে ঘুরঘুর করছি। অমনি আপনার মাথায় চেপে বসল বিষ প্রয়োগের আইডিয়া। সেটা টের পেয়ে আমরা সটকে পড়ি। যদিও সবসময় সরতে মনে থাকে না। মাঝে মাঝে কেস খেয়ে যাই।
-বাহ্, বাহ্। তোদের তো দারুণ বুদ্ধি!
-এবার তাহলে ছেড়ে দিন।
-না, না। আরো কথা বলব তোর সাথে। আগ্রহ শুধু বেড়েই যাচ্ছে। আচ্ছা তোরা ঢাকনা দিয়ে ঢাকা পাতিলের উপর ঘুর ঘুর করে কী লাভ পাস? খেতে তো পারিস না।
-ঘ্রাণং অর্ধনং ভোজনং।
-ওয়াও, তোরা সংস্কৃতও জানিস? শধুই অবাক হচ্ছি।
-তোদের এই খয়েরি কালারের গাউন দেখতে দেখতে বোর হয়ে যাচ্ছি। এটা চেঞ্জ করা যায় না?
-বোরহানি খান। আর এটা আমাদের জাতীয় পোশাক। এই পোশাকে আপনার সমস্যা কী?
-আমার ছেলেটা তেলাপোকা মনে করে খেজুর খেতে চায় না। ভয় পায়।
-কী ভযংকর কথারে বাবা! তাতে আপনার চেয়ে আমাদের সমস্যাই বেশি।
-কেন তোদের সমস্যা হতে যাবে কেন?
-আহ্, আপনার ছেলে যদি খেজুর মনে করে আমাদের খেয়ে ফেলে! বংশ থাকবে?
তেলাপোকার এই কথায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বলে কী! খেজুর মনে করে তেলাপোকা খেয়ে ফেললে তো ভয়াবহ ব্যাপার। ওকে ভালো করে তেলাপোকা ও খেজুরের পার্থক্য বোঝাতে হবে। তেলাপোকার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। আমি আবার জিজ্ঞাসাবাদে ফিরে আসলাম।
-এই তোদের পরিবার পরিকল্পনার দায়িত্বে কে আছে?
-কেউ নেই।
-তেলাপোকা-শুমারি?
-কীটাধিকার সম্মেলন থেকে আর ফিরে আসেনি। জ্বালাময়ী বক্তব্য দেয়ার অপরাধে গুম হয়ে গেছে।
-তোদের গোত্র প্রধানকে ডাকতে পারবি?
-দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ মিছিলে পদপিষ্ট হয়েছে।
-দব্যমূল্য বাড়লে তোদের ক্ষতি কী?
-বাসায় সবজি কম আসে। খাবারে টান পড়ে যায়।
-ঝাটাপিষ্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নে। তোর কোনো শেষ ইচ্ছা টিচ্ছা আছে?
-পাখি হতে চাই।
-আরে ব্বাবা, একটু ডানা মেলতে শিখেই পাখি হওয়ার শখ! ওসব ইচ্ছা পুরন হবে না। রেডি হ।
-বাঁধন খুলে দিন।
বাঁধন খুলে দিতেই ছয় পায়ে পিল পিল করে পালালো তেলাপোকাটা। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। আমার করার কিছু ছিল, অলসতার কারণে পারলাম না। হাই তুলে ঘুমুতে গেলাম। মশারিটা ভালো করে খাটের চারপাশে গুঁজে নিলাম। মাংসের যা দাম!