মো. জসিম জনি ।।
চলতি বছরের ৫ মাসে লালমোহনে ১৭ টি অপমৃত্যু মামলা হয়। এর মধ্যে ৯ টিই পানিতে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা। পরিবারের অসচেতনতায় পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এখন বর্ষাকাল। বাড়ির পাশের পুকুর, ডোবা নালা পানিতে টইটম্বুর থাকে। এসময়টা শিশুদের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ের। শহরের বাসাও শিশুদের ঝুঁকি থাকে। বাথরুমে পানি ভর্তি বালতি কিংবা বাথটাবে ডুবেও বহু শিশুর মৃত্যু হয়। গত নয় সেপ্টেম্বর লালমোহন উপজেলায় পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায় পাঁচ বছরের সাঈদ আর চার বছরের মীম। দুপুরের দিকে শিশু দুটি খেলতে গিয়ে পাশের পুকুরে পড়ে যায়। অনেকটা সময় তাদের দেখতে না পেয়ে পরিবার খুঁজতে থাকে। পরে শিশু দুটির শরীর পুকুরে ভাসতে দেখা গেলে উদ্ধার করে লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এক সাথে দুই শিশুর মৃত্যু কোন পিতা-মাতাই মেনে নিতে পারে না। পরিবারের বুকভাঙ্গা কান্না হয়তো এখনো চলছে। তবুও সচেতনতার অভাব রয়ে গেছে প্রায় ঘরে ঘরে।
শিশুদের পানিতে পড়ে মৃত্যুরোধে পরিবারকে সচেতন করতে লালমোহনে গত ২৬ মে ব্যতিক্রম একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। লালমোহন থানার আয়োজনে নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী হেল্পডেক্সের উদ্যোগে সকাল ১১ টায় লালমোহন উপজেলা অডিটোরিয়ামে এ অনুষ্ঠান হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন উপস্থিত ছিলেন।
সারা দেশের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ২০২১ সালে ১ হাজার ৩৪৮ জন শিশু পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছে। ২০২০ সালে যেখানে এ ধরনের ঘটনায় ৮০৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ৬৭ শতাংশ বেড়েছে বলে উঠে এসেছে এক বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষায়। যাদের ৮৩ শতাংশই শিশু। গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য তুলে এনেছে গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক বেসরকারি সংস্থা ‘সমষ্টি’। ২০২১ সালের মার্চের শুরু থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ উপজেলায় সমীক্ষা চালিয়ে জিএইচএআই ও সমষ্টি দেখেছে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ৪৭ শতাংশ তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বাকীগুলো প্রকাশ হয়নি। আমরা সাংবাদিকরা এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেইনা। যার কারণে অজানা থেকে যায় বহু পানিতে পড়ে শিশুর মৃত্যুর ঘটনা। তাছাড়া অনেক ঘটনা থানা পুলিশকেও জানানো হয়না পরিবার থেকে। পোস্টমর্টেম করানো হবে এ কারণে পুলিশকে না জানিয়েই পারিবারিকভাবে দাফন করে ফেলা হয়। এতে পুলিশের কাছেও রেকর্ড থাকছে না অনেক পানিতে মৃত্যুর ঘটনা। অথচ পানিতে ডুবে মুত্যু দেশের তৃতীয় শিশুমৃত্যুর কারণ। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে পানিতে ডুবে মৃত্যু গুরুত্ব পায় না। থেকে যায় নীতিনির্ধারকদের আলোচনার বাইরে।
দেশে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের শিশুরা পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন। অর্থাৎ বছরে প্রায় ১০ হাজার। আর সকল বয়সের মধ্যে গড়ে ৫১ জন পানিতে ডুবে মারা যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, নিম্ম ও মধ্য আয়ের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার পাঁচ গুণ বেশি।
পারিবারিক অসতর্কতা বা শিশুদের প্রতি নজরদারি না থাকার কারণেই অধিকাংশ পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য শিশুদের নিয়ে সচেতন থাকলে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর ঘটনা পরিবারের অসচেতনতার অভাবে হয়। এজন্য শিশু ভূমিস্ট হবার পর যখন দুই পায়ে ভর করে হাটতে শেখে তখন তার ঝুঁকি থাকে। তখন মায়ের দৃস্টি রাখতে হবে সবচেয়ে বেশি। বাড়ির পাশের ডোবা, পুকুর এমনকি বাথরুমের বালতি ভর্তি পানিতেও শিশুর মৃত্যু হতে পারে। এসব থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধে শিশুদের সাতার শেখানো খুবই জরুরি। সেইসঙ্গে যেহেতু পরিবারের সদস্যদের অগোচরে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে তাই শিশুদের এ সময়ে দেখাশোনা করে রাখার মতো ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ির পাশে কোনও জলাশয় থাকলে তাকে ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে।
মো. জসিম জনি
সাংবাদিক, লালমোহন, ভোলা।
০১৭১২৭৪০১৩৮