রিপন শান ।।
আহসান হাবীব। প্রথিতযশা একজন কবি ও সাহিত্যিক। দুই হাতে দুই আদিম পাথরের কবি আহসান হাবীব। দীর্ঘদিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন। তিনি চল্লিশের দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি হিসেবে পরিগণিত। বাংলা ভাষা সাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
১৯৮৫ সালের এইদিনে ১০ জুলাই আহসান হাবীব মৃত্যুবরণ করেন। ১৯১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার শংকরপাশা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতার নাম হামিজুদ্দীন হাওলাদার, মাতা জমিলা খাতুন। তার ছিল পাঁচ ভাই ও চার বোন৷ অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পিতামাতার প্রথম সন্তান তিনি৷ পারিবারিকভাবে আহসান হাবীব সাহিত্য-সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন। সেই সূত্রে বাল্যকাল থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। সেই সময় তার বাড়িতে ছিল আধুনিক সাহিত্যের বইপত্র ও কিছু পুথি। যেমন আনোয়ারা, মনোয়ারা, মিলন মন্দির প্রভৃতি৷ এসব পড়তে পড়তে একসময় নিজেই কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করেন।
তিনি পিরোজপুর থেকে প্রবেশিকা (১৯৩৫) পাস করে কিছুদিন বিএম কলেজে আইএ ক্লাসে অধ্যয়ন করেন, কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে লেখাপড়া ত্যাগ করে কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন এবং আজীবন ওই পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন।
আহসান হাবীব ১৯৪৭ সালের ২১ জুন বিয়ে করেন বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া নিবাসী মহসীন আলী মিয়ার কন্যা সুফিয়া খাতুনকে। আহসান হাবীব দুই কন্যা (কেয়া চৌধুরী ও জোহরা নাসরীন) ও দুই পুত্রের (মঈনুল আহসান সাবের ও মনজুরুল আহসান জাবের) জনক ছিলেন। পুত্র সাবের একজন স্বনামখ্যাত বাংলা ঔপন্যাসিক ও প্রকাশনালয় দিব্যপ্রকাশের কর্ণধার।
১২-১৩ বছর বয়সে স্কুলে পড়ার সময়ই ১৯৩৩ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তার একটি প্রবন্ধ ধরম প্রকাশিত হয়৷ ১৯৩৪ সালে তার প্রথম কবিতা মায়ের কবর পাড়ে কিশোর পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয় ৷ পরবর্তী সময়ে ছাত্রাবস্থায় কলকাতার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হলে তার নিজের সম্পর্কে আস্থা বেড়ে যায়। স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তুকে কবিতায় উপস্থাপিত করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ততদিনে অবশ্য দেশ, মাসিক মোহাম্মদী, সাপ্তাহিক বিচিত্রার মতো নামিদামি পত্রপত্রিকায় তার বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে৷ কলকাতায় গিয়ে শুরু হয় আহসানের সংগ্রামমুখর জীবনের পথচলা৷ সেখানে ১৯৩৭ সালে দৈনিক তকবির পত্রিকার সহ-সম্পাদকের কাজে নিযুক্ত হন । বেতন মাত্র ১৭ টাকা৷ পরবর্তীকালে তিনি ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার বুলবুল পত্রিকা ও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক সওগাত পত্রিকায় কাজ করেন ৷ এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন৷ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি বিভিন্ন সময়ে আজাদ, মোহাম্মদী, কৃষক, ইত্তেহাদ প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫৭-৬৪ পর্যন্ত তিনি ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনস-এর প্রডাকশন অ্যাডভাইজার ছিলেন। পরে তিনি কিছুদিন দৈনিক পাকিস্তানে কাজ করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দৈনিক বাংলার সাহিত্য-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আহসান হাবীব আধুনিক কাব্যধারার কবি ছিলেন। তাঁর কাব্যচর্চার শুরু বাল্যকাল থেকেই। সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ১৯৩৩ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম লেখা একটি প্রবন্ধ ‘ধর্ম’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’ ছাপা হয় পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে। তখন তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র। এভাবেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরু। পরে দেশ, মোহাম্মদী, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই রাত্রিশেষ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ ছায়াহরিণ (১৯৬২), সারা দুপুর (১৯৬৪), আশায় বসতি (১৯৭৪), মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬), দুহাতে দু আদিম পাথর (১৯৮০), প্রেমের কবিতা (১৯৮১), বিদীর্ণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫) ইতাদি। তাঁর দুটি বিশিষ্ট উপন্যাস হলো অরণ্য নীলিমা (১৯৬০) ও রাণীখালের সাঁকো (১৯৬৫)। এ ছাড়া তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ: জ্যোৎস্না রাতের গল্প, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর (১৯৭৭), ছুটির দিন দুপুরে (১৯৭৮) ইত্যাদি।
মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন ও জীবনযন্ত্রণা আহসান হাবীবের কবিতার প্রাণ। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রামী চেতনা এবং সমকালীন যুগযন্ত্রণা তাঁর কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তাঁর ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ বিদ্যমান। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬১), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬১), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), একুশে পদক (১৯৭৮), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০) এবং আবুল কালাম স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪) অর্জন করেন।