মু হা ম্ম দ মা সু ম বি ল্লা হ
শ্রমে ঘামে ও পরিশ্রমে কৃষক ফলান সরিষা ফুল। ফুলে ফুলে যখন মাঠ হলুদাভ, ঠিক তখন এসে হাজির মৌমাছিরা। মধু আহরণে ব্যস্ত হয়ে যায় কৃষকের অনুমতি ছাড়াই। মৌমাছি শ্রম বোঝে না, কৃষকের ঘাম বোঝে না। যদিও মৌমাছি নিজেও অনেক পরিশ্রমি। কৃষকের তাতে কোনো রাগ বা অভিমান হয় না। কারোরই হয় না। কারণ এই মধু আহরণ চলে স্রষ্টার সুনিপুণ অ্যালগরিদমে। স্রষ্টা তার আপন ভাষায় লিখেছেন এমন জটিল অ্যালগরিদমের প্রোগ্রাম। যা মেনে চলতে হয় সকল জীবকে। কৃষক বরং আনন্দিত হন। কারণ যত মৌমাছির আনাগোনা হবে, তত তার ফলন ভালো হবে। সোনায় সোনায় ভরে যাবে ক্ষেত।
ঠিক এই কৃষকের মতো রোযাদার সিয়াম সাধনায় নিজেকে পরিশুদ্ধ করেন একটি মাস ধরে। তিনি প্রতিটি দিন ক্ষুধায় কষ্ট করেন, পিপাসায় কাতর হয়ে যান। মুখকে নিয়ন্ত্রণ করেন। জিহ্বাকে বেঁধে রাখেন। ভালো কাজে মনোনিবেশ করেন। এক গাদা নিয়মের শৃংখলে বন্দী হয়ে যান স্রষ্টার নির্দেশে। ত্রিশটি রোযা শেষে যখন পশ্চিমাকাশে উঁকি দেয় এক ফালি চাঁদ, তখন মৌমাছির মতো মধু আহরণে হাজির হন একদল চেতনার মুখোশধারী শিল্পী। ঈদের মধু আহরণে। রোযাদারের ঘরে রাতের শেষাংশে যখন সিরামিক প্লেট গ্লাসের টুংটাং আনন্দ, মসজিদ থেকে ভেসে আসছিল ঈমানের সুর, তখন তিনি ছিলেন গাঢ় ঘুমে নিমজ্জিত। কখনওবা মাইকের শব্দে বিরক্ত হয়ে আওড়িয়েছেন গালি। রোযাদার যখন পিপাসার্ত হয়ে কুরআন পড়ছিলেন, তখন তিনি আকণ্ঠ পানে নিমজ্জিত। বাকা চাঁদের হাসি দেখে সেই তিনি সদলবলে এসেছেন টিভির পর্দায় ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গান নিয়ে।
১৯৩১ সাল। ভারতবর্ষ নিমজ্জিত শ্যামাসঙ্গীতের সুরে। ঘরে ঘরে গ্রামোফোনে বেজে উঠত ‘নয়ন তুলে দ্যাখ মা শ্যামা’। মুসলিম শিল্পী নাম পরিবর্তন করে হিন্দু সেজে শ্যামাসঙ্গীতে গলা দিতেন। পেট চালানোর জন্য। ঠিক তখন। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন এই গান। সুরারোপও করলেন তিনি। ঈদের আগে আগে রেকর্ড প্রকাশ হল। কণ্ঠ দিয়েছিলেন আব্বাস উদ্দীন আহমদ। চলমান স্রোতকে অস্বীকার করে সে গানের রেকর্ড পৌঁছে যায় মানুষের ঘরে ঘরে। হাটে মাঠে ঘাটে সবর্ত্র গুনগুন ‘ও মন রমজানের ওই রোযার শেষে এল খুশির ঈদ’। ব্যস উন্মুক্ত হয়ে গেল ইসলমী গানের দরোজা। বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। গানের কথার প্রতি খেয়াল করলেই বোঝা যাবে কতটা গভীর জ্ঞান ছিল ইসলামের।
তোতাপাখি হয়ে হেলেদুলে নেচে নেচে গেয়ে যান ‘ও মন রমজানের ওই রোযার শেষে এল খুশির ঈদ’। গানের এই চরণে যে কথা বলা আছে তা কি আপনি হৃদয়ে ধারণ করেন? ত্রিশটি রোযা পালন শেষে যে ঈদ আসে, সেই ঈদ একান্তই রোযাদারের। রোযাদারই অনুভব করেন সেই খুশি। ঈদের খুশি কতটা আলোড়িত করে হৃদয়, তা কেবল সিয়াম সাধকই বোঝেন। যন্ত্রসঙ্গীতের তালে তালে শরীর দুলিয়ে গেয়ে যান যে গান, সে গানের শিক্ষা নিয়ে কখনো ভেবে দেখেছেন?
তবলার তালে, বেহালার সুরে আর গিটারের ঝংকারে নারী পুরুষ সমবেত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন ‘তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ’। যন্ত্রসঙ্গীতের ঝনঝনানিতে কখনো আপনার ভাবা হয়নি নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মানে কী? কোন পথে বিলিয়ে দিতে হবে। আপনার চেতনার শরীরে এই চরণ কিভাবে বসল। যে পথে বিলিয়ে দিতে হবে সে পথে তো আপনি নেই। অসামান্য দরদ দিয়ে বলছেন, শোন আসমানী তাগিদ। রোযাদার মুসলিমের চোখে তখন জলের ধারা নামে। অবশ্যই আপনার গায়কীর ঢঙে নয়। গানের আহ্বানে। আপনি কি কখনো ভাবনার গভীরে ডুব দিয়েছেন, আসলে আসমানী তাগিদ কী? আপনার প্রতি আসমানি তাগিদ কী ছিল?
আসমানী তাগিদ ছিল বিশ্বাস স্থাপন করো আল্লাহর সার্বভৌমত্বে। রাসুলগণ পথ দেখানোর জন্য এসেছিলেন তাদেরকে বিশ্বাস করো। তাগিদ ছিল কিতাবসমুহকে বিশ্বাস করো। হৃদয়ে কি কখনো সেই বিশ্বাস অনুভব করেছেন? রাসুল (স.) যে কিতাব এনেছেন, সেটা তো আপনার জন্যও ছিল। আসমানী তাগিদ ছিল সেখানে, অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। সালাত আদায় করো। সিজদায় মাথা নতো করে বিনয়ী হও। যা তোমাকে রিযিক দেয়া হয়েছে তা থেকে স্রষ্টার পথে ব্যয় করো। ক্ষুধার্তের আর্তনাদ শোনো। পরিচয় দিতে হয় তাই দেন নিজেকে মুসলিম বলে। সমাজ আড়চোখে তাকাবে, তাই জীবনবৃত্তান্তে লিখে যান ধর্ম ইসলাম। বিভক্তির ব্রাকেটে থাকে সুন্নি । আসমানি তাগিদ শোনেনও না, মানেনও না। অথচ অবলীলায় উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। কী বিচিত্র!
আহ! কী আবেগী উচ্চরণ! তোর সোনা দানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ। তাকওয়ায় পরিপুর্ণ হৃদয় কেঁপে কেঁপে ওঠে। কিছুই আমার না। আকাশ, বাতাস, আসমান ও জমিন সবই আল্লাহর। সকল সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ তাআলার। সোনা দানা, উচ্চ প্রাসাদ, অট্টালিকা সব আল্লাহর তরে। এতবড় ওজনদার কথা ধারণ করার মতো সক্ষমতা কী আপনার আছে? এটা স্বীকার করলেই যে আপনার চেতনার পাহাড় মোমের মতো গলে গলে ক্ষয় হয়ে যাবে! মোহগ্রস্ত হয়ে প্রশংসা ও সম্মানি কুড়াবার অভিলাষে তোতাপাখি হয়ে উচ্চারণ করে যান। ভেবে দেখেছেন, আপনার উপার্জন শুধুই আপনার নয়। অধিকার আছে তাতে ক্ষুধার্তের। বস্ত্রহীন পথশিশুর। দরিদ্রের।
মুসলমান মরে গেছে। নজরুল তখনই অনুভব করেছিলেন। মুর্দা মুসলিমের নিদ্রা ভাঙাতে তাই কবির আহ্বান যাকাত দেয়ার। “দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ”। লোকে কী বলবে এই ভয়ে, পাখিদের যেভাবে শস্যদানা ছিটিয়ে দরদের প্রকাশ ঘটান, সেভাবেই কিছু টাকা আর নিম্নমানের কাপড় ছিটিয়ে দেন দরিদ্র চাতকপাখিদের জন্য। যাকাত কোনো অনুকম্পা নয়। দান নয়। ভিক্ষা নয়। এ যে আপনার সম্পদে গরীবের অধিকার। অধিকার না দিলে ছিনিয়ে নিতে হয়। গরীব সে সাহস রাখেন না বলেই ছিনিয়ে নেন না। আপনার খই ছিটানোর আশায় বসে থাকেন।
সঙ্গীত পরিচালকের নির্দেশনা মোতাবেক সমবেত নারী পুরুষদের মধ্য থেকে একজন কণ্ঠ বাগিয়ে গেয়ে ওঠেন “আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে /যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ”। আপনার চেতনার শরীরে কী ভয়ংকর উচ্চারণ! যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ। সেই ময়দানকে কি স্বীকার করেন? আপনার চোখের সামনেই সেই ময়দানে শহীদ হল কত শশ্রুমন্ডিত সফেদ মানুষ। হৃদয় সরোবরে কি সামান্যতম আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল? অনুদান আর অনুগ্রহ হারাবার ভয়ে বুলন্দ করেছেন চেতনার আওয়াজ। যে গলায় আওয়াজ তুলেছিলেন, সেই গলায় শহীদি ময়দানের উচ্চরণ বড়ই বেমানান লাগে।
“তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ”। আপনি কি ইসলামে মুরিদ হয়েছেন? বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ করার আহ্বান করছেন। নিজে তো মুরিদ হোন আগে। তারপর আহ্বান রাখবেন। “যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী / সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ”। খাবারের অভাবে যারা জীবনভরই রোযাদার। মানে নিত্য উপবাস করছেন। তাদের কথা কি ভাবেন? নাকি বোতাম টিপে কাঁচ উঠিয়ে দেন বিরক্তিভরা মুখে।
কণ্ঠ মিলিয়ে মিলিয়ে কোরাস গাইছেন, “ঢাল হৃদয়ের তশতরিতে শিরনি তৌহিদের”। হারমোনিয়ামে দম দিয়ে যখন সুর সাধনা করেছিলেন, তখন কি অর্থের গভীরে প্রবেশ করে দেখেছেন? তৌহিদের যে শিরনি হৃদয়ের রেকাবিতে ঢালার আহ্বান করছেন, সেই তৌহিদ কী? তৌহিদের শিক্ষা কী? নিশ্চয়ই ভেবে দেখেন নি। যদি দেখতেনই, তাহলে মঙ্গল শোভাযাত্রায় আপনার মুখটি দেখা যেত না। মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে গানে গানে চেতনা প্রসব করতেন না। আল্লাহর পাশাপাশি অন্য কারো বন্দেগী করতেন না। যুগের পর যুগ তশতরিতে মুখস্ত শিরনি ঢেলে যাচ্ছেন তৌহিদের।
তৌহিদের দাওয়াত দিতে গিয়ে যারা যুগে যুগে শিকার হয়েছেন ইট পাথরের আঘাতের। জলুমকে মাথা পেতে নিয়েছেন, তাদের জন্য যদি প্রেমের মসজিদ গড়তেই না পারেন, তাহলে এই গান আপনার জন্য নয়। প্লিজ এই ঈদের গানটি আপনি গাইবেন না। বড় বেমানান লাগে। সুর কেটে কেটে যায়। বড় বেসুরো লাগে।
বাস্তবতাকেই তুলে ধরা হয়েছ।