বরিশালে বইমেলা ও গ্রন্থ প্রদর্শনীর ইতিহাস

বেগম ফয়জুন নাহার শেলী

‘রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বই অনন্ত যৌবনা, যদি তেম বই হয়।’
একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম বইকে ‘অনন্ত যৌবনা; বলে আখ্যায়িত করলেও বই নিয়ে সে সময় কোথাও কোনো মেলার আয়োজন হয়েছিল কিনা জানা যায় নি। তবে খ্রিস্ট জন্মের পূর্বে পাশ্চাত্য সভ্যতার সূতিকাগার গ্রীসে কবি দার্শনিকদের রচনা প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকলেও এর ধারাবাহিকতার ইতিহাস জানা যায় নি। যতদূর জানা যায়, বই মেলার সূত্রপাত ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ডের স্টুরব্রিজে। এই মেলায় অন্যান্য প্রদর্শিত সামগ্রীর মধ্যে বইয়ের অংশের নাম ছিল ‘বুক সেলার্স রো’। এরপর বিভিন্ন মেলার অংশ হিসাবে বই বিক্রির আলাদা স্টল বরাদ্দ থাকলেও জার্মানিরা জোহান্স বুটেন বার্গে মুদ্রণ শিল্পের সূচনা উপলক্ষ্যে বুক সেলাররা ১৪৫৪ সালে ফ্রাংক ফুটে প্রথম বই মেলার আয়োজন করে।

এর আগে পান্ডুলিপি নিয়ে বইমেলা হত। ফ্রাংক ফুটের এই মেলা ইউরোপের প্রধান বই মেলা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসলেও ১৬৩২ সালে এর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাড়ায় জার্মানিরই লিপজিগের বইমেলা। কিন্তু এ বইমেলাগুলো অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৭৯ সালে ফ্রাংক ফুটের সেন্টপল চার্চে আবারও বইমেলা শুরু হয় যা এখনও চলমান। ফ্রাংক ফুটের পরে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা লিপজগের বইমেলা। অন্যদিকে ১৮০২ সালে আমেরিকার কোম্পানি অব বুক সেলার্সের পরিচালনায় নিউইয়র্কে প্রথম পূর্ণাঙ্গ বইমেলা শুরু হয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে এ মেলা আন্তর্জাতিক রূপ নেয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা ১৯৭২ এর ২০ থেকে ২৭ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে ঢাকার আর্টস কাউন্সিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছিল। ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি কেন্দ্রিক বইমেলার উদ্যোগ গ্রহণ করে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘মুক্তধারা’। এই উদ্যোগের সাথে যোগ দেয় ‘আহমদ পাবলিশিং হাউজ’ নওরোজ কিতাবিস্তান’ ও চলন্তিকা বই ঘর। এর পর ৫২র মহান ভাষা শহীদদের স্মরণে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একাডেমি প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে বইমেলা শুরু হয়। ১৯৮৪ সালে এ মেলার নামকরণ হয় ‘অমর একুশে বইমেলা।’
বিদেশের এবং ঢাকার বইমেলা ও গ্রন্থ প্রদর্শনীর ইতিহাসের এ সামান্য আলোকপাতের পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নীলাভূমি এবং শিক্ষা সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রণী বৃহত্তর বরিশালে এ ধরণের আয়োজনের বিষয় কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।
চর্যাপদের কবি মীননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথ, মঙ্গল কাব্যের পদ্ম পুরানের কবি বিজয়গুপ্ত হতে শুরু করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক কুসুমকুমারী রায়চৌধুরী, কামিনী রায়, জীবনানন্দ দাস, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, মোজাম্মেল হক, আহসান হাবীব, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, আবুল হাসান, আসাদ চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখের মতো অসংখ্য সৃজনশীল কবি সাহিত্যিকদের স্মৃতিধন্য এ অঞ্চলটি। তাই প্রামান্য তথ্যের অভাব সত্বেও শিক্ষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বরিশালের বইমেলা প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত করছি।
এ প্রসঙ্গে এ অঞ্চলের বাণিজ্যিকভাবে বইমেলা বা পুস্তক বিক্রয়ের বাণিজ্যিক বিপনন এবং ভাষা-সাহিত্য-ইতিহাস সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাবলীর অবাণিজ্যিক প্রদর্শনী উভয় ধরণের আয়োজনের বিষয়ই তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
১৯৭৮ সালে বাংলামুদ্রণ ও প্রকাশনার দ্বিশত বার্ষিকী উপলক্ষে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি প্রথম গ্রন্থ প্রদর্শনী ও সেমিনারের আয়োজন করে। এ প্রদর্শনীতে বাংলাভাষা ও অক্ষরের ক্রম বিবর্তন থেকে শুরু করে অনেক দুষ্প্রাপ্য পুঁথি সাহিত্যের পা-ুলিপি এবং মূল্যবান গ্রন্থ প্রদর্শন করা হয়। ২২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ ৪ দিন ব্যাপি অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব আবদুল আউয়াল। বিকেল ৪.০০টা থেকে প্রদর্শনীর শুরু হত। এ উপলক্ষে এ বি এম আশরাফ আলী খানের সম্পাদনায় দুই শতাব্দী নামে আটটি প্রবন্ধ সম্বলিত একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়।
এরপর দেশব্যাপি অনুষ্ঠিত প্রথম গ্রন্থ সপ্তাহের অংশ হিসাবে ১৯৭৯’র ২২ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘বই হোক দেশ গড়ার হাতিয়ার’ এই স্লোগান নিয়ে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি সাতদিন ব্যাপী বইমেলার আয়োজন করে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে বই পাঠিয়ে এ বইমেলার অংশ নেয়। এ ছাড়াও মুক্তধারা ও শিশু একাডেমি এ মেলায় যোগ দেয়। সাতদিনের এই বইমেলায় প্রদর্শনীর পাশাপাশি কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, সুধীবৃন্দের আলোচনা ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ বইমেলা স্মরণে পরবর্তী বছর এসএম ইকবালের সম্পাদনায় ১০টি প্রবন্ধ সম্বলিত একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়।
একই বছর গ্রন্থ সপ্তাহ উপলক্ষে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের বাংলা বিভাগ বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের পান্ডুলিপি, লিপিতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব বাংলা লিপির বিকাশ ও বিবর্তন এবং বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস ইত্যাদি চিত্র-চাট ও প্রাচীন নিদর্শন নিয়ে কলেজে শ্রেণিকক্ষে প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ১৯৮১ সালেও এ উপলক্ষে কলেজটির বাংলা বিভাগ এ ধরণের প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে।
১৯৮০ সালের ৯ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত গ্রন্থসপ্তাহ উপলক্ষে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি কক্ষে বইমেলার আয়োজন করে, এরপরে জাতীয় গ্রন্থমেলাকে আরও গণমুখী করার উদ্দেশ্যে ১৯৮৪ সালের ২ মে গ্রন্থকেন্দ্র বরিশালে আয়োজন করলো নবম জাতীয় গ্রন্থমেলার। মেলার সার্বিক সাফল্যের লক্ষে ৯৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাধারণ পরিষদ এবং ৭টি উপ-পরিষদ গঠন করা হয়। মেলার সার্বিক দায়িত্বে ছিল গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। আটদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এ মেলায় বইয়ের পাশাপাশি সাহিত্য প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘বই পড়ুন এবং বই উপহার দিন’ এই স্লোগান নিয়ে ২ মে ১৯৮৪’র বিকেল ৪ টায় শুরু হওয়া এ গ্রন্থ মেলাটি উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও গ্রন্থমেলা উদযাপন পরিষদের সভাপতি এম এ বারি এবং বক্তব্য রাখেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক ফজলে রাব্বি।
গ্রন্থমেলার এ অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন স্বশিক্ষিত দার্শনিক জনাব আরজ আলী মাতুব্বর, বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, কবি কায়সুল হক, গল্পকার আবুল খায়ের মুসলেউদ্দিন, চলচ্চিত্র অভিনেতা গোলাম মোস্তফা, গল্পকার আবদুস শাকুরসহ বরিশালের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলমান এ গ্রন্থমেলায় স্বাগতিক দেশসহ দেশের ৩০টি প্রকাশনী সংস্থা ও বইয়ের বিপণন প্রতিষ্ঠানে অংশ নেয়া। বিদেশি দূতাবাস থেকে অংশ নেয় ভারত, চীন, বুলগেরিয়া, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, জিডিআর হাঙ্গেরী, সুইজারল্যান্ড, চেকোশ্লাভাকিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, নরওয়ে ও পাকিস্তান।
পূর্বের গ্রন্থমেলাগুলো তুলনায় এ মেলার প্রচুর দর্শক সমাগম ঘটে, আটদিনের এ মেলায় পৌনে দুইলক্ষ টাকার বই বিক্রি হয়েছে বলে জানা যায়। বৈশাখী ঝড় বৃষ্টির কারণে বিঘ্নিত এ মেলায় আরো অনেক বই বিক্রি হত বলে আয়োজকদের ধারণা। এ গ্রন্থমেলা উপলক্ষ্যে ১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল পরবর্তী গ্রন্থমেলায় বদিউর রহমানের সম্পাদনায় ৯টি প্রবন্ধ সম্বলিত একটি স্মারক পুস্তিকা প্রকাশ পায়।
১৯৮৫-র ৮ থেকে ১০ এপ্রিল ৬৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাধারণ কমিটি, ৭টি উপ-পরিষদ এবং পাবলিক লাইব্রেরির সার্বিক সহযোগিতায় পাবলিক লাইব্রেরিতে জাতীয় গ্রন্থ সপ্তাহ ৮৫-র গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সাতদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই গ্রন্থমেলা ৬ এপ্রিল বিকেল ৫.০০ টায় উদ্বোধন করেন বরিশালের জেলা প্রশাসক  আজিজ আহম্মদ। পরের দিন ৭ তারিখ হতে দুপুর ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গ্রন্থমেলা চলে। এর সাথে চলে আবৃত্তি, বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা।
১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সালের প্রতি ২১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর উদ্যোগে এবং উদীচী বরিশাল শাখার আয়োজনে বরিশাল জগদীশ সারস্বত গালর্স স্কুল প্রাঙ্গণে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলায় প্রতি বছর ১৫টির উপরে প্রকাশনা সংস্থা ও স্থানীয় পুস্তক ব্যবসায়ীরা অংশ নেয়। এ মেলায় পুস্তক বিক্রির পাশাপাশি প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো বলে জানিয়েছেন উদীচীর মেলা সম্পাদক সাইফুর রহমান মিরণ।

২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সহায়তায় শহীদ আলাউদ্দিন শিশুপার্কে সাতদিন ব্যাপি বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলার উদ্বোধন করেন তৎকালীন সংসদ এ্যাড. মো: শাহজাহান মিয়া। মেলায় বই বিক্রি ছাড়াও আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
১৯৯৭ থেকে ২০০১ এর প্রতি ১, ২ ও ৩ ফেব্রুয়ারি বাটাজোর বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত মেলায় অন্যান্য সামগ্রীর সাথে বইয়ের স্টল ছিল। ২০০১ এর পর ২০০৪ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এ মেলা চলার বিরতি ছিল। ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল থেকে তিনদিন ব্যাপি এ মেলা আবারও অনুষ্ঠিত হয়।
১৮ মার্চ ২০১০ এবং ২১ মে ২০১৮ সালে বাবুগঞ্জ আগরপুরের রহিমগঞ্জের বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর যাদুঘরে দুটি বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
৩ এপ্রিল ২০১৪ তে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে বরিশাল জিলা স্কুলে ১২ দিন ব্যাপী বরিশাল বিভাগীয় বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলার উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ২০১৪ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ১২ দিন ব্যাপী বইমেলা স্থানীয় অম্বিনী কুমান টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়। এটির উদ্বোধক ছিলেন তৎকালীন শিক্ষাসচিব কবি আবু নাসের চৌধুরী (কামাল চৌধুরী)।

বরিশাল জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ তে লামছড়িতে স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়িতে তিন দিন ব্যাপী আরজ আলী বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বরিশাল নগরীর অশ্বিনীকুমার টাউন হলে জীবনানন্দ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর কবিতা পরিষদের উদ্যোগে বরিশাল অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত জীবনানন্দ মেলার উদ্বোধক ছিলেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী, পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. পবিত্র সরকার।
বরিশাল জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০১৬’র ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ স্থানী অশ্বিনী কুমার টাউন হলে জীবনানন্দ উৎসব অনুষ্ঠানে বইমেলার আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে ৯ জন কবি সাহিত্যিককে সম্মাননা জানানো হয়; যাদের বই ১৬’র অমর একুশের বই মেলায় প্রকাশিত হয়।

২০১৬’র ৭ থেকে ১২ জানুয়ারি অশ্বিনীকুমার টাউন হলে, ২০১৯’র থেকে ১০ জানুয়ারি স্থানীয় শব্দাবলী থিয়েটার হলে এবং ২০১৮’র ৫ থেকে ১০ জানুয়ারি অশ্বিনী কুমার টাউন হলে বেঙ্গল এবং প্রথমা প্রকাশনীর উদ্যোগে প্রথম আলো বন্ধুসভার আয়োজনে বইমেলা হয়। এর মধ্যে ২০১৬ এবং ২০১৮’র বইমেলাটি উদ্বোধন করেন বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক এবং ২০১৭’র মেলাটির উদ্বোধক ছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এ ছাড়া প্রথম আলো বন্ধু সভা ২০১৬-২০১৭ ও ২০১৮’র ১৮ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ৪দিন ব্যাপী বরিশাল শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এবং ২০১৭ ও ২০১৮’র ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বইমেলার আয়োজন করে।

৭ জুলাই ২০১৭ তে বরিশাল জিলা স্কুল প্রাঙ্গণে জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনীর উদ্যোগে সপ্তাহ ব্যাপী বইমেলা হয়। ঐ মেলায় বিভিন্ন প্রকাশনীর ৪০টি স্টল অংশ নেয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বই মেলায় সাহিত্য ও সামাজিক কর্মকান্ডে অবদান রাখার জন্য পঙ্কজ রায় চৌধুরী, হেনরী স্বপন ও আক্কাস হোসেনকে পুরস্কৃত করা হয়।
স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়ি লামছড়িতে আরজ আলী স্মৃতি যাদুঘরের উদ্বোধন উপলক্ষে ২৮ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে লেখকের নিজস্ব গ্রন্থগারের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত উক্ত গ্রন্থ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বরিশাল মেট্রোপলিটিন পুলিশের তৎকালিন কমিশনার এস এম রুহুল আমিন। উল্লেখ্য আরজ আলী মাতুব্বরের গ্রন্থাবলীর সম্পাদনা করেন জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আইউব হোসেন।
বরিশালে বাণিজ্যিক বইমেলার বদলে অবাণিজ্যিক প্রদর্শনীর একটি ধারা শক্তিশালী হয়েছে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির (বি.আর.ইউ) উদ্যোগে । মহান মুক্তিযুদ্ধের চার দশক বা চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সে সময়ে জন্ম নেয়া উন্নয়ন সংগঠন ‘ব্রাক’ মুক্তিযুদ্ধের উপর এক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলো বরিশালে তাদের আঞ্চলিক দপ্তরে। ব্রাকের মিডিয়া কর্মকর্তা সাংবাদিক লেখক জিয়া হাসানের সহায়তায় বিআরইউ শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থ তথ্য ও চিত্র প্রদর্শনী।
অশ্বিনী কুমার হলে আয়োজিত গ্রন্থমেলার সূচনা হওয়া বিআইউ’র প্রদর্শনী এরপর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত হয়। পরবর্তীকালে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু উদ্যানে বিভাগীয় আনসার ভিডিপি কার্যালয়ে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে তা নিয়মিত ভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ইতিহাস ও দলিলপত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত রাইফেল, সাইক্লোস্টাইল মেশিন, গোলার খোসা, মাইনের টুকরা, রেডিও, আলোকচিত্রসহ বহু দুর্লভ সামগ্রী প্রদর্শনীর জন্যে রাখা হচ্ছে।
বিআরইউ’র উদ্যোগে ভাষা সাহিত্য সংশ্লিষ্ট আরেকটি দিনের প্রদর্শনী ২০১৬ সাল থেকে বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সহায়তায় শহীদ মিনারে আয়োজিত হয়।
পাঠকের বিরক্তি উৎপাদনের ভীতি এবং মূদ্রণ পরিসর সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতার কারণে আপাতত এ আলোচনার বিরতি ঘোষণায় বাধ্য হলাম। তবে এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছি ‘ধান-নদী-খালের দেশ বরিশাল’ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় যেমন শিক্ষায় অগ্রণী ছিল তেমনি গ্রন্থকারদের সংখ্যায় তারা ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে সে তুলনায় বই বিপণনের মেলা বা ভাষা সাহিত্য-ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থের প্রদর্শনীতে বরিশালবাসী পিছিয়ে আছে নি:সন্দেহে। যেটুকুওবা হয়েছে বা হচ্ছে তার উদ্যোক্তা আয়োজক ও পৃষ্ঠপোষক যেমন মুষ্টিমেয় তেমন এ সম্পর্কিত প্রচার এবং তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণেও তারা সফল হতে পারেন নি।
ভবিষ্যতে এ দুর্দিন কেটে যাওয়ার প্রত্যাশায় এবং এ নিবন্ধ রচনায় নিজের সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থী। তবুও যেটুকু তথ্য সংগ্রহ হয়েছে সে ব্যাপারে বরিশালের প্রামাণ্য ইতিহাস প্রণেতা সাইফুল আহসান বুলবুল, বরিশাল জেলা উদীচী সম্পাদক সাইফুর রহমান মিরণ, বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আনিসুর রহমান স্বপন সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সংবাদ কর্মীদের কাছে কৃতজ্ঞ।

বেগম ফয়জুন নাহার শেলী, সাবেক সহকারি অধ্যাপক (বাংলা), বরিশাল ইসলামিয়া কলেজ

তথ্যসূত্র:

বরিশাল থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন মুক্তবুলি ১৩তম সংখ্যা, প্রকাশক ও সম্পাদক: আযাদ আলাউদ্দীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *