ফরাসি বিপ্লবে ভূমিকা রেখেছিলেন অপহৃত যে বাঙালি ক্রীতদাস

মুক্তবুলি ডেস্ক

চট্টগ্রাম থেকে অপহৃত শিশু জেমোরকে ক্রীতদাস হিসেবে ১৭৬৬ সালে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া হয়। নিজের মালিকের বিরুদ্ধে এই যুবকের জবানবন্দী পরবর্তীতে ভূমিকা রাখে সতেরশো শতকের ফরাসি বিপ্লবে।

ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গ, ইতিহাসের ভয়ঙ্কর সেই ফরাসি কারাগার যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া ছিল অসম্ভব। ১৭৮৯ সালে এই দুর্গের পতনের মাধ্যমেই ঘটে ফরাসি বিপ্লব। তবে, ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে বাংলার কী সম্পর্ক? এর উত্তর পেতে হলে জানতে হবে লুই-বেনওয়া জেমোর নামক একজন ক্রীতদাসের ইতিহাস।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরের রাজনৈতিক দায়িত্ব পায়, সেসময়ই চট্টগ্রাম থেকে শিশু বয়সী জামোরকে ক্রীতদাস হিসেবে অপহরণ করে ইংরেজ দাস ব্যবসায়ীরা। ১৭৬০ এর দশকে উপমহাদেশের অন্যতম সেরা বাণিজ্য বন্দর ছিল চট্টগ্রাম। এ অঞ্চলে ইংরেজদের নিয়মিত যাতায়াত থাকায় সেসময় ক্রীতদাস কেনা-বেচা বা অপহরণও ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

যদিও জামোরকে অপহরণের সঠিক সময় জানা যায়নি, ধারণা করা হয় ১৭৬৬ সালে ফ্রান্সে নেওয়ার আগে তাকে পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ দাস ব্যবসায়ীদের হাতেও পড়তে হয়েছে। জেমোরকে মাদাম ডু ব্যারির কাছে হস্তান্তর করেন রিশেলুর ডিউক লুই ফ্রাঁসোয়া আরমান্ড। অনেকের মতেই জেমোর তখন ছিল ৭ বছরের একজন বালক।

ক্রীতদাস নেওয়ার জাহাজ/ ছবি- গেট বেঙ্গল

১৭৭০ সালে ফ্রান্সের নটর-ডেম দে ভার্সাই গির্জায় জেমোরকে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করানো হয়। এসময় তার গডমাদারের ভূমিকা পালন করেন মাদাম ডু ব্যারি নিজেই। তার গডফাদারের ভূমিকায় ছিলেন লুই ফ্রাঁসোয়া জোসেফ ডি বোরবন। এখানেই তার নামকরণ করা হয় লুই-বেনওয়া জেমোর।

তবে, ক্রীতদাস হিসেবে ফ্রান্সে আনা হলেও মাদাম ডু ব্যারির পরিবারে শিশুটিকে ক্রীতদাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয়নি। তাকে মূলত একটি খেলনা হিসেবে ব্যবহার করতেন ডু ব্যারি। রাজপ্রাসাদের সবারই ঠাট্টা উপহাসের আনুষাঙ্গিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো তাকে। দুর্গের সকলের দ্বারাই অবিরাম উপহাস এবং অপমানের স্বীকার হন জেমোর।

 

অপমানজনক এই ঘটনাগুলোই তার পরবর্তী জীবনদর্শনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাহিত্য ও দর্শনের প্রতি জামোরের গভীর আগ্রহ, জ্ঞানের জন্য তার তৃষ্ণা এবং মানুষের সমতা নিয়ে ভাবনা থেকেই ফরাসি বিপ্লবে অংশ নেন ২৭ বছর বয়সী জেমোর। জাঁ-জ্যাক রুশোর দর্শনে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত জেমোর বিপ্লবে জ্যাকোবিয়ানদের পক্ষ নিয়েছিলেন।

ডু ব্যারির বিলাসবহুল জীবনযাত্রাকে ঘৃণা করতেন তিনি। নিজের হারানো গয়না পুনরুদ্ধারের জন্যে ডু ব্যারির বারবার ইংল্যান্ড সফরের প্রতিবাদও করেছিলেন জেমোর। অবশেষে ফ্রান্সের কমিটি অব পাবলিক সেফটিতে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজের মর্যাদা নিশ্চিত করেন জেমোর। এমনকি পরবর্তীতে রেভলিউশনারি সার্ভেইলেন্স কমিটির সেক্রেটারিও নির্বাচিত হন তিনি।

 

কমিটি অব পাবলিক সেফটির একজনতথ্যদাতা হিসেবে ১৭৯২ সালে মাদাম ডু ব্যারিকে গ্রেপ্তার করাতে সফল হন জেমোর। তবে সে যাত্রায় নিজেকে জেল থেকে মুক্ত করে জেমোরকে চাকরিচ্যুত করেন ডু ব্যারি। এতে ক্ষান্ত হননি জেমোরও। ডু ব্যারির বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু অভিযোগ এনে শেষমেশ তার গ্রেপ্তার, বিচার ও মৃত্যুদণ্ডে ভূমিকা রাখেন জেমোর। মালিকের বিরুদ্ধে দেওয়া জেমোরের জবানবন্দি মূলত সতেরশো শতকের ফরাসি বিপ্লবের আদর্শকেই তুলে ধরে।

১৭৯৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রয়াত ফরাসি রাজা লুই (১৫) এর শেষ উপপত্নী, মাদাম ডু ব্যারিকে বন্দী করা হয়।

ডু ব্যারির ট্রায়ালের সময়ই জেমোরের আসল পরিচয় সামনে আসে। সেই ট্রাইব্যুনালের কাগজপত্রে লুই-বেনওয়া জেমোরকে বাংলায় জন্মগ্রহণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তার আফ্রিকান বংশোদ্ভূত সম্পর্কে দীর্ঘ ভুল ধারণা ভাঙে এর মাধ্যমেই।

তবে, কমিটি অব পাবলিক সেফটির একজন তথ্যদাতা হওয়া সত্ত্বেও, গিরোন্ডিনরা তাকে ডু ব্যারির সহযোগী হিসেবে সন্দেহ করে। জেমোরের বাড়ি অনুসন্ধান করে কিছু বই, রুশোর কিছু লেখা ও ফরাসি বিপ্লবের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুই নেতা জাঁ-পল মারাট এবং ম্যাক্সিমিলিয়েন রোবেসপিয়েরের প্রতিকৃতি ছাড়া কিছুই পায়নি তারা। কোনো প্রমাণাদি না পাওয়া সত্ত্বেও ছয় সপ্তাহ কারাভোগ করতে হয় জেমোরকে।

 

কারাগার থেকে মুক্তির পরপরই ফ্রান্স ত্যাগ করেন তিনি। তবে, ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের পতনের পর আবারও তিনি প্যারিসে ফিরে আসেন। একটি স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক হিসেবে প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টারে তার বাড়িতে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটান জেমোর।

দারিদ্র্যের শিকার জেমোর ১৮২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। প্যারিসেই একটি নামহীন কবরে সমাহিত করা হয় এই বাঙালিকে, যিনি আর কখনোই বাড়ি ফেরেন নি।

সূত্র- গেট বেঙ্গল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *