মো. জিল্লুর রহমান ।।
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। বিশ্বজুড়ে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৫০ কোটির বেশি। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। কারো কারো কাছে ফেসবুক এতোটাই আর্কষণীয় যে, ফেসবুকে লগইন করে দিন শুরু করেন আবার ফেসবুকে লগআউটের মাধ্যমে ঘুমাতে যান। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির নানা দিক রয়েছে, সাধারণ ব্যবহারকারীরা তা হয়তো একদমই জানেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের আধুনিক জীবনে এক নতুন বাস্তবতা। গ্রামের চায়ের দোকানে মানুষ তথ্যের জন্য এখন আর পত্রিকার পাতা ঘাঁটাঘাঁটি করে না। তার বদলে এসেছে স্মার্টফোন ও আইফোন নির্ভরতা।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন ও আইফোন। এ সব প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি তথ্য, মতামত, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি আদান-প্রদান করতে পারেন। এগুলো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রাণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনলাইন সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের থাকে অনেক উৎস ও অনেক প্রাপক। প্রথাগত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমের থাকে একটি উৎস ও অনেক প্রাপক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া থেকে আলাদা।
আমাদের টাইমলাইন, নিউজফিড ভরে যায় প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় সংবাদ, ছবি ও ঘটনায়। এ সুযোগটি করে দিচ্ছে ইন্টারনেট। সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭০ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত রয়েছে। তরুণদের মধ্যে এ হার আরও বেশি, প্রায় ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের রয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট।
ফেসবুক নিয়ে একটি কথা বেশ বহুল প্রচলিত। ‘ফেসবুক হলো ফ্রিজের মতো! একটু পর পর খুলে দেখতে ইচ্ছা হয়, নতুন কিছু আছে কি না!’ সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট বলা হলেও এর গ-িটা এখন শুধু অনলাইনে বা ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ নেই। স্ট্যাটাস, লাইক, পোক, শেয়ার, চেক-ইনশব্দগুলো আজকাল স্বাভাবিক কথোপকথনেও জায়গা করে নিয়েছে। অনেকের আজকাল ফেসবুক ছাড়া চলেই না, কেউ আবার ফেসবুককে ‘যত নষ্টের গোড়া’ মেনে নিয়ে কারণে অকারণে ‘লগ-ইন’ করছেন প্রতিদিন। অনেকে আবার জমিয়ে ব্যবসা বানিজ্য করছে দেদারসে। চলছে পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি, তর্ক।
ফেসবুক (ইংরেজিতে Facebook , ফেসবুক, সংক্ষেপে ফেবু) বিশ্ব সামাজিক আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থার একটি ওয়েবসাইট, যা ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিতে বিনামূল্যে সদস্য হওয়া যায়। এর মালিক হলো ফেসবুক ইনক। ব্যবহারকারীগণ বন্ধু সংযোজন, বার্তা প্রেরণ এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলী হালনাগাদ ও আদান প্রদান করতে পারেন, সেই সাথে একজন ব্যবহারকারী শহর, কর্মস্থল, বিদ্যালয় এবং অঞ্চল-ভিত্তিক নেটওয়ার্কেও যুক্ত হতে পারেন। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যকার উত্তম জানা শোনাকে উপলক্ষ্য করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক প্রদত্ত বইয়ের নাম থেকে এই ওয়েব সাইটটির নামকরণ করা হয়েছে।
ফেসবুকের সাম্প্রতিক তথ্যমতে সারাবিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৫০ কোটি ছাড়িয়েছে। ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তিকে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৪৫ থেকে বেড়ে ২৫০ কোটিতে পৌঁছায়। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা এবং আয় দুটোই বেড়েছে। তবে শেয়ারের মূল্য ছয় শতাংশ কমেছে। যারা প্রতিদিন ফেসবুক ব্যবহার করেন তাদের সংখ্যা ১৬২ থেকে বেড়ে ১৬৬ কোটিতে পৌঁছেছে। তবে আগের বছরে এই বৃদ্ধির হার ছিল দুই শতাংশ। আর রাজস্ব আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেড়ে বর্তমানে ২,১০৮ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এতে শেয়ার প্রতি গ্রাহকরা আয় করছেন ২.৫৬ ডলার। কিন্তু নিট আয় মাত্র ৭ শতাংশ বেড়ে ৭৩০ কোটি ডলার হয়েছে যেখানে তার আগের বছর নিট আয় বড়েছিল ৬১ শতাংশ।
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক ইলিয়ট জাকারবার্গ (অনেকে বলেন মার্ক জুকারবার্গ) মার্ক জাকারবার্গ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষ চলাকালীন ২৮ অক্টোবর ২০০৩ এটির প্রাথমিক কাঠামো তৈরি করেন। তিনি তার কক্ষনিবাসী ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র এডুয়ার্ডো স্যাভেরিন, ডাস্টিন মস্কোভিৎস এবং ক্রিস হিউজেসের যৌথ প্রচেষ্টায় ফেসবুক নির্মাণ করেন। ওয়েবসাইটটির সদস্য প্রাথমিকভাবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু পরে সেটা বোস্টন শহরের অন্যান্য কলেজ, আইভি লীগ এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। আরো পরে এটা সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, হাই স্কুল এবং ১৩ বছর বা ততোধিক বয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সারা বিশ্বে বর্তমানে এই ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করছেন ২৫০ কোটির বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী।
ফেসবুকের পূর্বসূরি সাইট ফেসম্যাস। এতে জাকারবার্গ হার্ভার্ডের ৯ টি হাউস এর শিক্ষার্থীদের ছবি ব্যবহার করেন। তিনি দুইটি করে ছবি পাশাপাশি দেখান এবং হার্ভার্ডের সব শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে বলেন। কোন ছবিটি হট আর কোনটি হট নয় অর্থ্যাৎ ‘হট অর নট’। এজন্য মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ডের সংরক্ষিত তথ্য কেন্দ্রে অনুপ্রবেশ বা হ্যাক করেন। ফেসম্যাস সাইট এ মাত্র ৪ ঘণ্টায় ৪৫০ ভিজিটর ২২০০০ ছবিতে অন লাইন এর মাধ্যমে ভোট দেন।
জাকারবার্গ ১৯৮৪ সালে নিউইয়র্কের হোয়াইট পেইন এলাকাতে মনোচিকিৎসক ক্যারেন ও দন্তচিকিৎসক জাকারবার্গের ঘরে জন্ম নেন। তার তিন বোন রয়েছে, র্যান্ডি, ডোনা এবং এরিএল। জাকারবার্গ একজন আমেরিকান কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও সফটওয়্যার ডেভেলপার। যার আসল পরিচিতি হল জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ ওয়েবসাইট ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। তিনি বর্তমানে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রেসিডেন্ট। একজন ইহুদী হিসেবে বেড়ে উঠলেও বর্তমানে তিনি নিজেকে একজন নাস্তিক হিসেবেই পরিচয় দেন। জাকারবার্গ এবং তার কয়েকজন সহপাঠী মিলে ২০০৪ সালে এটিকে একটি ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন যখন তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই জাকারবার্গ টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে বছরের সেরা ব্যক্তিত্বরূপে নির্বাচিত হয়েছেন।
২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২১ কোটি ৪০ লাখ, দ্বিতীয় স্থানে ভারত ১৯ কোটি ১০ লাখ। শহরের দিক থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ফেসবুক ব্যবহারকারী ব্যাংকক শহরে ৩ কোটি, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ঢাকা শহরের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ এবং তৃতীয় স্থানে আছে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা।
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বছরে আয় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সারা বিশ্ব থেকে ফেসবুকের মোট রাজস্ব আয় বাংলাদেশী টাকায় দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। আন্তর্জাতিক আয়ের ওপর নির্দিষ্ট হারে কর ও অন্যান্য ব্যয় বাদে এ প্রান্তিকে ফেসবুকের নিট মুনাফার পরিমাণ বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৫১ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে আয়ের পরিমাণ ফেসবুকের মোট আয়ের পরিমাণ শূন্য দশমিক দুই শতাংশ। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি। গত বছর ২০১৯ সালে মাত্র ৩ মাসেই ফেসবুক আয় করেছে ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ২০১৮ সালে আয় করেছিল প্রায় ১৩,২৮০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকারকে কর দিয়ে ঐ বছরে বিনিয়োগ ও অন্যান্য খরচ বাদে তাদের নিট মুনাফা ছিল প্রায় ৩,৪০০ কোটি টাকা।
ফেসবুকের বেশিরভাগ আয় হয় বিজ্ঞাপন থেকে। ফেসবুকে সাধারণত অন্যান্য প্রধান ওয়েবসাইট থেকে কম ক্লিক থ্রু রেট (সিটিআর) রয়েছে। বিজনেসউইক.কমের মতে ফেসবুকের ব্যানার বিজ্ঞাপনে পাঁচ ভাগের একভাগ ক্লিক পড়ে অন্য ওয়েবের তুলনায়, যদিও সত্যিকার বিশেষ তুলনায় এটা অসম হতে পারে। উদাহরণসরূপ, যেখানে গুগল ব্যবহারকারী খোঁজার ফলাফলের প্রথম বিজ্ঞাপনের লিংকগুলোতে ক্লিক করে গড় হিসেবে ৮% (৮০০০০ ক্লিক প্রতি এক মিলিয়ন সার্চে)। সেখানে ফেসবুকের ব্যবহারকারীরা বিজ্ঞাপনে ক্লিক করে গড়ে ০.০৪% (৪০০ ক্লিক প্রতি এক মিলিয়ন সার্চে)।
ফেসবুক অনেক দেশেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে বন্ধ করা হয়েছে যার মধ্যে আছে চীন, ইরান, উজবেকিস্থান, পাকিস্তান, সিরিয়া, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম এবং উত্তর কোরিয়া। উদাহরণসরূপ এটি পৃথিবীর অনেক দেশেই ধর্মীয় বৈষম্য ও ইসলাম বিরোধী কর্মের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অনেক জায়গায় অফিসের কর্মীদের কর্ম সময়ে ফেসবুক ব্যবহার না করার জন্য বন্ধ করা হয়েছিল। ফেসবুকে ব্যবহারকারির গোপনীয়তাও একটি সমস্যা হয়ে দেখা দেয় এবং তার নিরাপত্তাও বিভিন্ন সময় আপোস-মীমাংসা হয়। ফেসবুক একটি মামলা লড়ে সোর্স কোড এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের মামলায়। ২০১১ সালের মে মাসে সাংবাদিক এবং ব্লগারদের কাছে ইমেইল পাঠানো হয় গুগলের গোপনীয়তার নীতির অভিযোগ নিয়ে। যদিও শেষে দেখা যায় যে, গুগল প্রতিরোধকল্পে পিআর খ্যাত বারসন-মারসটেলার এটি করে এবং অর্থদাতা ছিল ফেসবুক যা সিএনএন সহ বেশ কিছু গণমাধ্যমে সমালোচিত হয়। ফেসবুক কুর্দিস্থানের রাজধানী আরবিলে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় নিরাপত্তা জনিত কারণে।
ফেসবুক সামাজিক মাধ্যমটি বর্তমানে আমাদের জীবনের প্রথম পর্যায়ের যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। অনেকে দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ২০ ঘণ্টাই ফেসবুকে বসে থাকতে পছন্দ করে। মোটামুটিভাবে অনলাইন সার্ভিস মানবসভ্যতার যোগাযোগকে অনেক বেশি সহজতর করে ফেললেও এর ক্ষতিকর দিকও কম নেই। বেপরোয়া জীবন যাপন বলতে আমরা বুঝি মাদক জাতীয় দ্রব্য, বেশ্যাবৃত্তি, অনৈতিক কার্যক্রম ইত্যাদি। কিন্তু আপনি জানেন কি এর মাঝে অনিয়ন্ত্রিত ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের আসক্তিরও স্থান রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মান উন্নয়নের ফলে দেশের যুব সমাজ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ধীরে ধীরে এটি আসক্তি হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদের অনেকেই দিনের অধিকাংশ সময় ফেসবুক বা অন্য সামাজিক যোগাযোগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ফলশ্রুতিতে বাস্তবিক সামাজিক খাত যেমন বাবা-মা, ভাই- বোন ও বন্ধু বান্ধবদের মাঝে প্রকৃত অর্থে দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে। ফেসবুকের মত মাধ্যমগুলোর নেশা দেশের উদীয়মান প্রজন্মকে তার স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ত্বের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফেসবুক ব্যবহারে যেসব বিকট সমস্যা দেখা দিচ্ছে –
১. গোপনীয়তাঃ যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন তারা মাঝে মাঝেই নিজের অবস্থান সম্পর্কে স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন। মন খারাপের মুহূর্ত, ভালোলাগার মুহূর্ত সম্পর্কে স্ট্যাটাস দিয়ে থাকেন। এতে আপনি কখন কী করছেন সব বিষয়ে আপনার ফেসবুক বন্ধুরা জেনে যাচ্ছেন। ফলে আপনার জীবনের কোনো গোপনীয়তাই থাকে না। এমনকি যারা অনেকটাই আবেগপ্রবণ তারা নিজেদের ডেটিংয়ের বিষয়েও জনসম্মুখে প্রকাশ করছেন। এসব বিষয়ে আপনার সম্পর্কে যে কেউ খুব সহজেই অনুমান করতে পারেন।
২. ব্যক্তিত্বঃ ফেসবুক ব্যবহারে একজন মানুষের ব্যক্তিত্বে রহস্য বলে কিছু থাকে না। আপনার সম্পর্কে খুব সহজেই ধারণা পাওয়া যাবে আপনি কেমন, আপনি কী পছন্দ করেন, আপনি কী পছন্দ করেন না। এতে বোঝা যায় আপনার ব্যক্তিত্ব কেমন? সাধারণত যারা বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তারা ফেসবুকে সবরকম স্ট্যাটাস দিতে পছন্দ করেন না। যুগের প্রয়োজনে হয়ত তারা তা ব্যবহার করছেন। কিন্তু কোনো ধরনের পোস্ট, স্ট্যাটাস বা ছবি আপলোড করেন না যা তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সব জানিয়ে দেয়।
৩. প্রেমঃ ফেসবুকে অনেক পরিচিত অপরিচিত নারী পুরুষরা বন্ধু হয়ে যান। তারা দিনরাত চ্যাট করে যান। এতে তাদের মাঝে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তারা একে অপরের সাথে দেখা করেন। ডেটিং করেন। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন এই সম্পর্কগুলো কতটা স্থায়ী হয়। গবেষণায় দেখা গেছে তাদের মাঝে অনেক গভীর সম্পর্ক হয়ে যায় কিন্তু তা আর শেষ পর্যন্ত টিকে যায় না। ফেসবুকের ফলে বলা যায় দেশের তরুণ সমাজ বিপথে গমন করছে।
৪. অপরাধ প্রবণতাঃ আজকাল ফেসবুকে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক জটিলতা নিয়ে ফেসবুকে বেশ আলোচনা সমালোচনা হয়ে থাকে। ফলে দেশের তরুণ সমাজ এর থেকে নোংরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে। এর থেকে তাদের জীবনের ঝুঁকিও অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া দেখা যায় বন্ধুদের পোস্টে কমেন্ট করে কি করে বন্ধুকে পঁচানো যায় সে বিষয়ে জোরদার প্রতিযোগিতা চলে। ফলে তাদের মাঝে গীবত করার প্রবণতাটা বেশি হয়।
৫. নৈতিকতার অবক্ষয়ঃ ফেসবুক একটি জনপ্রিয় মাধ্যম একথা বলতেই হয়। কিন্তু মানব জাতির একটাই সমস্যা ভালো বিষয়কে ভালোভাবে ব্যবহার করতে আমরা অভ্যস্ত নই। এই জনপ্রিয় মাধ্যমটিকেও অধিকসংখ্যকই আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করছি না। বিভিন্ন বয়সের মানুষরা নিজেদের বা অন্য নামে ফেইক আইডি খুলে বিভিন্ন নারী পুরুষের সাথে গোপনে অশ্লীল প্রেমালাপ করে যাচ্ছেন। দেখা গেছে এরা অনেকেই বিবাহিত। এতে তাদের নৈতিক অবনতি ঘটছে। বিবাহ বন্ধনটি অনেক ঠুনকো হয়ে গেছে। এর ফলে অনেকের বিবাহ বিচ্ছেদের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এতে মানবজীবনে ফেসবুক একটা বাজে প্রভাব ফেলছে।
৬. বিকৃত রুচিবোধঃ অনেকেই খুব সুন্দর করে নিজের প্রোফাইলে বাজে ছবি প্রকাশ করে নিজেকে খুব স্মার্ট ভাবেন। কেউবা আবার একাধিক ফেক একাউন্ট তৈরি করে মেয়েদের প্রোফাইলে বাজে ছবি পোস্ট করে থাকেন। একমাত্র বিকৃত রুচির মানুষই এ ধরনের কাজ করে থাকেন।
উদ্ভাবিত প্রতিটি জিনিসেরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক ব্যবহার এবং দিক রয়েছে। ফেসবুকও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের জাতীয় জীবনে ফেসবুক কি রকম ভূমিকা রাখছে ? ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক তাকি আমরা ভালোভাবে অনুধাবন করেছি? বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে ফেসবুক মানুষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে যথেষ্ট ভাল ভূমিকা রাখছে এটি যেমন সত্য তেমনি কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুক সামাজিক সম্পর্ক, সমাজ জীবন ও মননশীলতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
ফেসবুকের ইতিবাচক দিক-
১) ফেসবুক মানুষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করে। ২) ফেসবুক যেকোনো অশুভ তৎপরতা বা অসামাজিক, অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করার সুযোগ করে দেয়। ৩) ফেসবুকে মানুষ তার মনের যেকোন অনুভূতি বা মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে। ৪) ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের স্ট্যাটাস বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা যায় এবং অন্য দেশের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও জানা যায়। ৫) ফেসবুকের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বন্ধুত্ব ও সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন অতি সহজ ও করা যায়। ৬) অবসর সময় আড্ডা না দিয়ে ফেসবুক ব্যবহার করে জ্ঞানভা-ার সমৃদ্ধ করা যায়। কারণ ফেসবুক এখন শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এখান থেকে অনেক কিছু শেখাও যায়।
ফেসবুকের নেতিবাচক দিকঃ
১) ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকে নিজেদের বয়স লুকিয়ে কম বয়সীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, এমনকি কেউ কেউ প্রডিউসার পরিচয় দিয়ে অভিনয় বা মডেলিংয়ের লোভ দেখিয়ে অশ্লীল ছবি ও বার্তা আদান-প্রদান করে থাকে। এই অন্যায় কর্মের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ১৮ বছরের কমবয়সী প্রায় দুই কোটি প্রাণ। অথচ ১৮ বছরের নিচে কেউ অ্যাকাউন্ট খোলা নিষেধ। ২) ফেসবুক আমাদের দৈনন্দিন সামাজিক জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এমনকি শিশুদের মনে ফেসবুক প্রায় নেশার মতো কাজ করছে। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিক সম্পর্কটাই। ৩) ফেসবুকের মাধ্যমে বর্তমানে মেয়েরা ডিজিটাল ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে।
৪) ফেসবুকের মাধ্যমে মানুষ এখন সমাজের আসল বন্ধুদের চেয়ে সাইবার দুনিয়ার বন্ধুদের পেছনে বেশি সময় ব্যয় করছে। এতে তারা সমাজ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে পারিবারিক সম্পর্কেও ফাঁটল ধরছে। ৫) ফেসবুকে অনেকের বেনামি অ্যাকাউন্ট রয়েছে । বিশেষ করে অনেক নারীর নামে অ্যাকাউন্ট করা হয়েছে অথচ যার নাম তিনি হয়তো জানেনই না। এসব পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ভয়ানক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। ৬) ফেসবুকের ম্যধমে বর্তমানে অনেক দেশে ভুয়া ইনফরমেশন দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দিচ্ছে। যেমন মিয়ানমারের দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের হত্যা, নির্যাতন ও বাস্তুচ্যুতি। অনেক মিথ্যা তথ্যের মাঝে সত্য বিষয় বুঝা কঠিন হয়ে পড়েছে। ৭) ব্রিটেনের আইনজীবীরা বলছেন, ইদানীং ফেসবুকের কারণেই সে দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়ে চলছে। বিবাহিতরা অনলাইনে নতুন কারও সঙ্গে পরকীয়া জড়িয়ে পড়ছেন কিংবা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া সন্দেহপ্রবণ দম্পতিরা তাঁদের সঙ্গীকে পরীক্ষা করার জন্যও ফেসবুক ব্যবহার করছেন। ব্রিটেনের একজন আইনজীবী বলেছেন, গত নয় মাসে তিনি যতগুলো বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটিয়েছেন, তার সবগুলোই ফেসবুকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ কারণে দেশটির অনেকে বিবাহিত দম্পতিদের ফেসবুক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করছেন।
নিউটন বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত ক্রিয়া থাকে’। একটি পিস্তলকে কেউ ন্যায় পথেও ব্যবহার করতে পারে আবার অন্যায় পথেও ব্যবহার করতে পারে। তাই ফেসবুক যেন কেউ অন্যায় পথে ব্যবহার করতে না পারে সে জন্যে আমাদের কিছু করনীয় আছে, যেমনঃ অভিভাবকদের সচেতনতা হতে হবে। ১৮ বছরের নিচে কেউ যেন অ্যাকাউন্ট খোলতে না পারে। প্রতিটি দেশে সরকারি মনিটরিং সেল গঠন করে ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে মনিটরিং করতে হবে যাতে অন্যায় বা অবৈধ স্ট্যাটাস, ছবি, ভিডিও কেউ পোস্ট করতে না পারে।
প্রতিটি ব্যবহারকারীকে নৈতিকতা এবং নিয়ম নীতি মেনে ফেসবুক ব্যবহার করতে হবে।
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল, অ্যাকাউন্ট খোলার সময় অবশ্যই তার আসল পরিচয় নিশ্চিত হয়ে অ্যাকাউন্ট অনুমোদন দেয়া। এ ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্ট খোলার সময় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আবেদনকারীর সরকারী কোন পরিচয়পত্রের সাথে আইপি অ্যাড্রেস বা অন্য কোন উপায়ে নিশ্চিত হয়ে অ্যাকাউন্ট অনুমোদন দেয়া।
মো. জিল্লুর রহমান
ব্যাংকার ও লেখক
০১৭১৬৭৩৩৭১৪
[বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ, চরফ্যাশন শাখায় ফাস্ট এসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এফএভিপি) ও শাখা প্রধান হিসাবে কর্মরত।
তথ্যসূত্র: মুক্তবুলি ম্যাগাজিন ১৪তম সংখ্যার প্রচ্ছদ রচনা। নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০২০