বখতিয়ারের বাংলাদেশ

মাহমুদ ইউসুফ

পূর্বেই বলা হয়েছে নবি রসুলদের ওয়ারিশরাই বাংলার জমিনের প্রথম সন্তান। তাই ইসলামের সাথে বাংলাদেশের রিশতা অতিপ্রাচীন। বহুদিন পর্যন্ত এখানকার অধিবাসীগণ আল্লহর অনুসারী ছিলেন। কালক্রমে এদেশে বিভিন্ন ধর্মাদর্শ ও মতবাদ প্রবর্তিত হয়। মাক্কার মুশরিক স¤্রাট আবু জাহিল, আবু লাহাব, অলিদ, উতবা, শায়বারা নবি ইবরহিমেরই আওলাদ। আবার আদ, বখত নসর, মিহিরকুল, শশাঙ্ক, বল্লাল সেন, হালাকু খাঁন, আরবান, রিচার্ড, গই, গণেশ, শ্রীচৈতন্য, আকবর, ক্লাইভ, মাওসেতুং, স্টালিন, লেনিন, আতাতুর্ক, জওহরলাল নেহরু, ইন্ধিরা, বুশ, মোদি, সুচি, ট্রাম্প এই সব স¤্রাটরা কিন্তু আদমেরই আওলাদ। তদ্রুপ প্রাচীন বাঙালিরাও পিতৃধর্ম ভুলে তাগুত কর্তৃৃক শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে। ইসায়ি সপ্তম শতকে মুহাম্মাদ স. আদম, ইবরহিম, মুসা, ইসার আনীত দীন ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটান ও পরিপূর্ণতা দান করেন। আরও আগ থেকেই বাংলার সাথে আরবের তেজারতি সম্পর্ক ছিলো। ওই সময়েই ব্যবসা-বাণিজ্যের বদৌলতে এখানকার বাসিন্দারা আল কুরআনের সংস্পর্শে আসেন। পরবর্তী পাঁচশ বছর চলে ইসলামের নীরব প্রচার। এ পর্বে দায়ি ইলাল্লাহর মুজাহিদরাই ছিলো নায়কের ভূমিকায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর সূচনায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কায়েম হয় মালিক বখতিয়ারের নেতৃত্বে। বখতিয়ার খলজি বাঙালি মুসলিমদের হারানো সালতানাতের পুনরুদ্ধারকারী।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি স্বাধীন অ্যাডভেঞ্চার এবং দুঃসাহসিক অভিযানকারী। এই মহাবীরের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলায় মুসলিম রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। ইনসাফভিত্তিক সমাজ কায়েমেও তিনি অদ্বিতীয়। মাত্র ১৭ জন মুজাহিদ নিয়ে একটি রাষ্ট্র বিজয় ইতিহাসে এই প্রথম। অদ্যাবধি তাঁর রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি। অসাধারণ সমরকৌশল, তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা এবং কুটনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ায় এ অসাধ্য সাধিত হয়েছিল। চৌকষ গোয়েন্দা বাহিনী এ অভিযানে মূল ভূমিকা রাখে। ১২০৫ সালের ১০ মে (১৯ শে রমযান ৬০১ হিজরি)১ সংঘটিত হয়েছিল এই মহাবিপ্লব। সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, মানবাধিকার পরিস্থিতি না জানলে বখতিয়ার খলজির নদিয়া ও লাখনৌতি বিজয় অভিযান সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝির পয়দা হতে পারে।

সমকালীন সমাজ
বখতিয়ার আগমনের পূর্বে বাংলাদেশের সার্বিক পরিবেশ ছিলো খুবই নাজুক। বর্বরতা, পৈশাচিকতা আর নোংরামির দাপট সর্বত্র। বাংলাভাষা নির্বাসনে, সাধারণ নাগরিকরা মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। নারী নিগ্রহ অতীতের পরিসংখ্যান ভেঙে দেয়। রামপালে বল্লালসেন কর্তৃক আদম শাহ ও তাঁর সাত হাজার মুজাহিদকে হত্যার রেশ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত। উচ্চবিত্তদের আধিপত্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব জায়গায় পয়দা হয় বিশৃঙ্খলার রাজত্ব। ফলে মানবতার পক্ষে একটি বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়ে। সেই রেনেসাঁ বহন করে নিয়ে আসেন বাঙালির মুক্তির দূত, ইতিহাসের কান্ডারি, সিপাহসালার বখতিয়ার খলজি। কিন্তু কেন বাহির থেকে আসা একজন সেনাধ্যক্ষ ইতিহাসের কিংবদন্তি নায়ক হয়ে রইলেন সে বিষয়টি জানতে তৎকালীন মানবীয় সংকট ও রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া ছাড়া গত্যান্তর নেই।

গৌড়রাজ্যের শাসক শশাঙ্ক তার পুরো শাসনামলে বৌদ্ধ নিধনে নিযুক্ত ছিলেন। নামজাদা ভাষাবিজ্ঞানী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর জানান:
কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্কের আদেশ ছিলো- সেতুবন্ধ হতে হিমগিরি পর্যন্ত যত বৌদ্ধ আছে বালক-বৃদ্ধ-নির্বিশেষে তাদেরকে হত্যা করবে, যে না করবে তার মৃত্যুদ- হবে।২
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জুলুমবাজ শোষক শশাঙ্ক সম্পর্কে এরপর আর কী বলার থাকতে পারে? ‘বৌদ্ধধর্মকে পরাভূত করে হিন্দুরা যেভাবে বৌদ্ধ-ইতিহাস লোপ করেছিলেন, তা অকথ্য অত্যাচার-লাঞ্ছিত। হর প্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় লিখেছেন, ‘‘বৌদ্ধ পারিভাষিক শব্দগুলো জনসাধারণের ভাষা হতে অন্তর্হিত হয়েছে। যে জনপদে (পূর্ববঙ্গে) ১ কোটির অধিক বৌদ্ধ এবং ১১৫০০ ভিক্ষু বাস করত সেখানে একখানি বৌদ্ধগ্রন্থ ৩০ বছরের চেষ্টায় পাওয়া যায় নাই।’’ … হিন্দুরা বৌদ্ধকীর্তি একেবারে লোপ করাবার জন্য যেখানে সেখানে তাদের প্রাচীন কীর্তি ছিলো, তা মহাভারতোক্ত পঞ্চ-পা-ব অথবা আর কোনো হিন্দু রাজ-রাজড়ার সম্পর্কিত এরূপ পরিকল্পনার দ্বারা বৌদ্ধাধিকারের চিহ্নমাত্র লোপ করবার চেষ্টা পেয়েছিলেন।’৩ এছাড়া প্রাচীন ভারতীয় রাজা মিহির কুল বা কুমারিল ভট্টের সন্ত্রাস-জাহেলিয়াত কারও অজানা থাকার নয়।
শশাঙ্কের পর প্রায় চারশ বছর বাংলায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলো পালবংশ। পালরাজাদের পরে এগারো শতকে আবার সরকারে আসে শশাঙ্কের উত্তরসূরী সেনবংশ। সেনরাজগণ ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদে বিশ্বাসী এবং এর কঠোর বাস্তবায়নে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পরধর্ম সহিষ্ণুতা ছিলো না। এই সময় বাংলার সামাজিক জীবনে আমলাতন্ত্রের প্রভাব দারুণভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক জীবনেও পরিবর্তন ঘটেছিল। বর্ণাশ্রম প্রথার কড়াকড়ি প্রয়োগ শুরু হয়। আবার বর্ণে বর্ণে বিভক্তির ফলে সামাজিক জীবনে অসংখ্য বর্ণের উৎপত্তি হয়। প্রধানত পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য আদর্শ সামাজিক জীবনকে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি সংস্কৃতির আলোকে সজ্জিত হলো এবং সেন প্রশাসনের উচ্চতর হতে শুরু করে নিম্মস্তর পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন বাংলার সামাজিক কাঠামোতে নতুনত্বের আবির্ভাব ঘটলো। অন্যদিকে বৌদ্ধধর্ম তথা তদীয় সমাজের করুণ অবস্থা শুরু হয়। বৌদ্ধগণ কেউবা স্বদেশ পরিত্যাগ করল অথবা স্বদেশে থেকে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য আদর্শের অন্তরালে নিজেদের অস্তিত্ব কোনোক্রমে টিকিয়ে রাখল। সুতরাং সেন আমল একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগ হিসেবে গণ্য করা যায়। সমকালীন সময়ে এই যুগের অবদান ব্রাহ্মণ্যধর্মের আধিপত্য সুদৃঢ়করণ। ব্রাহ্মণ্য বর্ণ ব্যতীত অন্য বর্ণগুলো হলো ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র বা সংকর বর্ণের শুদ্র। ব্রাহ্মণদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জন হিন্দু সমাজকে করেছিল আরও রক্ষণশীল ও সনাতনপন্থী এবং সেই সঙ্গে মানুষে মানুষে পার্থক্য আরো সুচিহ্নিত করেছিল। এর ফলস্বরূপ নিম্মবর্ণের লোক, নারী-সমাজ ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীগণ নিপীড়নের শিকার হয়েছিল।৪

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জীবনপ্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। তাদের ধর্ম ও প্যাগোডা অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। তাদের উপাসনালয় বর্ণহিন্দুদের দখলে চলে যায়। নলিনীনাথ দাশগুপ্ত ‘বাঙ্গালায় বৌদ্ধধর্ম’ বইয়ে লিখেছেন, ‘পুরীর জগন্নাথ মন্দিরটি একটি পুরাতন বৌদ্ধ মন্দিরের ভিটার উপরই নির্মিত হয়েছে। মন্দির অভ্যন্তরস্থ বিগ্রহদ্বয় বৌদ্ধ ত্রিরত্নের অনুকরণ ব্যতীত অন্য কিছু বলে মনে হয় না। এ ধরনের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে যথেষ্ট পাওয়া যায়।’ হিন্দুসম্প্রদায় রীতিমত বৌদ্ধভাব, মত, আচার আচরণ রপ্ত করে বৌদ্ধদের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়কে এদেশীয় ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্য মুছে ফেলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।৫ বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মণদের অন্যায় আচরণ, বিদ্বেষ অত্যাচার ইত্যাদি তাদেরকে ভীষণভাবে শঙ্কিত করেছিল। এর প্রমাণ বিভিন্ন তাওয়ারিখে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। এই প্রকারের গ্রন্থাবলির মধ্যে শংকর বিজয় ও শূণ্য পূরাণ অন্যতম। চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত শূণ্যপূরাণ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে:
ব্রাহ্মণদের অত্যাচার এতই জঘন্য হয়েছিল, বৌদ্ধেরা সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকত, শুধু এমন নয়, ব্রাহ্মণেরা সদ্ধর্মসেবীদের যথাসর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাদের ধ্বংসের দিকেও ঠেলে দিতে দ্বিধা করেনি।৬

নারী-পুরুষে পর্দা, ভদ্রতা, রুচিবোধ বা শালীনতা বলতে কিছু ছিলো না। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা, নগ্নতা, যৌনতা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে দিকবিদিক। শবর জাতির ন্যায় কেবল বৃক্ষপত্র পরিধান করে এবং সারা গায়ে কাঁদা মেখে, ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে লোকেরা অশ্লীল গান গাইত এবং তদনুরূপ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করত। জীমৃতবাহন ‘কাল বিবেক’ গ্রন্থে যে ভাষায় এই নৃত্যগীতের বর্ণনা করেছেন, বর্তমানকালের রুচি অনুসারে তার উল্লেখ বা ইঙ্গিত করাও অসম্ভব।৭ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ^বিদ্যালয়ের ভারতবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শ্রী অতীন্দ্র মজুমদার তাঁর চর্যাপদ কিতাবের চর্যাপদের সমকালীন বাংলাদেশ প্রবন্ধে বলেন:
‘ব্রাহ্মণরা ছিলেন সমাজের উচ্চ মঞ্চে, কিন্তু সাধারণ লোকের ভাবনা, ধারণা চিন্তাকর্মের সংস্পর্শের বাইরে। গোটা সমাজ তখন তিনটি বৃহৎ প্রাচীরের দ্বারা বিভক্ত- সবার উপরে ব্রাহ্মণ, মাঝে অগণিত শুদ্র পর্যায়ের সাধারণ লোক আর সবার নিচে সমস্ত রকম সামাজিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত অস্পৃশ্য দীন ও নিরন্তর দু:খের দহনে দগ্ধ অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছ সম্প্রদায়। … বাৎসায়ন পরিষ্কারভাবে বলেছেন, গৌড়বঙ্গের রাজান্তঃপুরে মহিলারা নির্লজ্জভাবে ব্রাহ্মণ রাজকর্মচারী ও দাসভৃত্যদের সঙ্গে কামচর্চা, কামষড়যন্ত্র ও কামসম্ভোগ করতেন। তিনি আরও বলেছেন, কামচরিতার্থতার জন্য নগরে এবং গ্রামে বিত্তবানদের ঘরে দাসি রাখা হতো এবং ছিলো বাররামা ও দেবদাসী।৮

অতীন্দ্র মজুমদারের এ বয়ান একাদশ ও দ্বাদশ শতকের সেন যুগের। বর্তমান বাংলাদেশও কী সেই আমলে ফিরে যাচ্ছে? হাল আমলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অরাজকতা, গুম, খুন, মাৎস্যন্যায়, সেক্স ভায়োলেন্স, বলপ্রয়োগের নিকট মানবতার আত্মসমর্পণ সেই জননিরাপত্তাহীন অধঃগতির চিত্রকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

সেই সমাজে নারীরা ছিলো শুধুই ভোগ্যপণ্য। তাদের ছিলো না কোনো সামাজিক মর্যাদা। লেবাসের ক্ষেত্রেও ছিলো বিশ্রী বাসনা। পুরুষরা ধুতি ও নারীরা শাড়ি পড়ত। তবে ইহা দ্বারা শুধু দেহের নিম্মাংশ আবৃত থাকত। আর উর্ধ্বাংশ থাকত খোলা। আজব রুচি! যেখানে নারীরা অর্ধউলঙ্গ থাকে বা উপরিভাগ অনাবৃত উদম থাকে সেখানকার সামাজিক অবস্থার কথা কল্পনা করুন! পুরুষের বহুবিবাহ ও নারীর সহমহরণ প্রথা প্রচলিত ছিলো। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে বলা হয়েছে, স্ত্রীলোক কখনো স্বাধীন হবে না। পতিসেবাই পরম ধর্ম ও স্বর্গফলদায়ক। নারীগণের একমাত্র পতিই গতি। পতি উৎকৃষ্ট বা অপকৃষ্ট হলেও তাঁকে ত্যাগ করা যাবে না। এই বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে বাঙালি ইনসানকে বাঁচাতেই বখতিয়ারের পদার্পণ গৌড় বাংলায়। রমা প্রসাদ চন্দ লিখেছেন:
মহাম্মদ-ই-বখতিয়ারের অভ্যুদয় গৌড়ের সর্বনাশের মূল বা সর্বনাশের ফল বলে কথিত হইতে পারে না। বিজয় সেনের অভ্যুদয়ই গৌড়ের সর্বনাশের প্রকৃত মূল বা ফল বলে কথিত হইতে পারে।৯

বখতিয়ার খলজি বাঙালি রেনেসাঁর নকিব-অগ্নিপুরুষ। বাঙলার সেই বিপদজনক পরিস্থিতির পরিত্রানে প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় এরূপ একজন মহামানবের। যিনি কোনো অন্যায়ধর্মের সাথে সমঝোতা করেন না, চিন্তাশক্তি যার অনাবিল, অন্তদৃষ্টি যাঁর তীক্ষ্ম, অসাধারণ যাঁর প্রতিভা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব যাঁর জন্মগত বৈশিষ্ট্য, সর্বোপরি মানবকল্যাণে যাঁর লক্ষ্য, তেমন মহাপুরুষের আহ্বানেই জাতির জীবনে আসে সুবেহ সাদেক, স্বর্ণালী সকাল। তার দেহে নতুন যৌবনশক্তির হয় পুণরাবির্ভাব, হয় তার পুনরুজ্জীবন। এই তো জাতির জন্য রেনেসাঁ, জনতার বিপ্লব। বখতিয়ার ছিলেন তেমনই একজন বিপ্লবী বীর, সমরকৌশলী ও সময়ের সাহসী সন্তান।

পাল রাজাদের আমলে বাংলার জনসাধারণের একটা অংশ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল। পরে সেন রাজাদের আমলে প্রচ- আগ্রহে ও প্রচারের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণের উদ্দীপনায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে বাঙালি সমাজে মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণদের প্রতাপ এত বেশি বেড়ে যায় যে, তা অচিরে অত্যাচার হয়ে দাঁড়ায়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা বাঙালি সমাজকে অসাড় ও জড়বৎ করে ফেলেছিল, দুর্বল করে ফেলেছিল সঙ্ঘশক্তিতে, উপরন্তু সমাজপতিদের প্রতি জনসাধারণের উল্লেখযোগ্য অংশকে বিরূপ করে তুলেছিল। সঙ্ঘশক্তি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছিল বলেই তন্ত্র-মন্ত্র-স্বস্ত্যয়ন প্রভৃতিতে মানুষের অন্ধবিশ্বাস জন্মেছিল; যখন এসব আচার-অনুষ্ঠান ও অলৌকিক শক্তির চর্চায় জনগণ অতিরিক্ত ব্যাপৃত হয়, তখন তা মনুষ্যত্বের বিপর্যয়কেই সূচিত করে। ব্রাহ্মণ্য প্রাধান্যের ফলে বৌদ্ধ ও নিম্মবর্ণের জনসাধারণ খুবই ক্লিষ্ট ও নির্যাতিত জীবন যাপন করেছিল ও তারা নিষ্কৃতির জন্য অহি শক্তির কাছে কায়মন বাক্যে প্রার্থনা করেছিল এবং সেসময় বাংলায় মুসলমান বিজয়াভিজান হলে তারা বেশ সমাদরের সঙ্গেই বৈকুণ্ঠ থেকে অবতীর্ণ পরিত্রাতারূপে মুসলমানদের বরণ করেছিল।১০

বখতিয়ারের কৃতিত্ব
বখতিয়ার খলজি বাংলা জয়ের পর খুব বেশিদিন এর শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারেননি। কিছুদিনের মধ্যেই তিব্বত অভিযানে বের হন। তিনি তাঁর অধিনস্তদের হুকুম দেন, আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে। অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জনগণের আর্থিক সমৃদ্ধি আনয়ন, শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রগতিতে মনোযোগ দেন তাঁরা। মোটকথা একটি স্বাধীন স্বপ্নভূমি, আজাদ আবাসভূমি সৃষ্টিতে যা যা করা দরকার সকলক্ষেত্রেই তাঁদের দৃষ্টি পড়ে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত লিখেছেন:
বখতিয়ার খলজি দিল্লি সুলতানের অধীন একটি প্রাদেশিক সরকার লাখনৌতিতে গঠন করেন এবং ক্রমে ক্রমে রাঢ়, গৌঢ় ও বরেন্দ্র এলাকা দখল করেন। তিনি মগধ ও মিথিলা বিজয় করে বঙ্গে আসেন এবং কামরূপ ও তিব্বতের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তিনি বিহার রাজ্যের নামকরণ করেন। তিনি বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিল্পকলা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।১১

বাঙালাহ নামের দেশ, বাঙালি নামে ভাষা সৃষ্টি, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টিতে মুহাম্মাদ বখতিয়ারের কৃতিত্ব অসাধারণ। অস্পষ্ট পরিচয় এক তুর্কি সন্তান তখনকার শক্তিস্তম্ভ সুলতান মুহাম্মাদ ঘোরি বা দিল্লি প্রধান কুতুব উদ্দিনের কোনো রকম সাহায্য ছাড়াই ইসলাম অনুসারীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করে যায় এমন এক রাজ্য, গুরুত্বে যা অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে দাঁড়ায় দিল্লি-সালতানাতের ঈর্ষার ব্যাপার। উচ্চতায় খাটো হলেও মুহাম্মাদ বখতিয়ার এমন এক সেনাপতি যাঁর সাহস, উদ্যম ও নেতৃত্বের তুলনা মেলা ভার। রণকৌশলের মত প্রশাসন দক্ষতায়ও তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। রণক্ষেত্রে দুর্জয় ও রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা বিধানে অতুলনীয় এই মর্দে মুজাহিদ রাজ্যবাসীর সর্বরকম কল্যাণ সাধনে ছিলেন তৎপর।১২ ইতিহাসবেত্তা ড. মোহাম্মদ হাননান রচিত কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
বখতিয়ার খলজির বঙ্গ অভিযান: বাঙালির ইতিহাসে নতুন ধারার সূচনা। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, বাংলার এই প্রথম মুসলিম শাসনকর্তা কখনোই অত্যাচারী ছিলেন না। মধ্যযুগের ইতিহাসের জনক বখতিয়ার খলজি নিজের থেকে বাংলার সুলতান উপাধি গ্রহণ করেননি। তবে খলজি বংশের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আইওয়াজ (১২১৩-২৭) দিল্লির অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন নরপতি হিসেবে ১২ বছর বাংলা শাসন করেন। ফলে তিনি ইতিহাসে লাভ করেন বাংলার প্রথম সুলতানের মর্যাদা। গিয়াসউদ্দিনের এই ক্ষমতা গ্রহণ এবং তাঁর পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে মধ্যযুগে ভারত ও বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলমানদের অভিযান নিছক রাজ্য জয় ছিলো না। ছিলো সুপরিকল্পিতভাবে ইসলাম অভিযান।১৩

মুক্তির প্রতীক বখতিয়ারকে বৌদ্ধ ও নিম্ম বর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্য ও নির্মুল অভিযানের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে দুবাহু বাড়িয়ে স্বাগতম জানায়। জনগণ ও সমাজ ব্যবস্থায় বিভেদ, বিসম্বাদের ফলে আশে-পাশের কোনো রাজা বা বাংলার প্রজারা নদিয়া-বিক্রমপুরের রাজা লক্ষণ সেনকে কোনোপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা করেনি। মুসলিম আগমনে ক্রমে ক্রমে জীবনের ক্লেদ, গ্লানি, সাংস্কৃতিক পঙ্গুত্ব, ব্রাহ্মণ পূজা, নরবলি, প্রকৃতির উপাসনা ও সীমাহীন ব্যাভিচার, অযাচার, বলাৎকার থেকে রেহাই পায় বনি আদম। বাংলাদেশে এভাবেই হাজির হয় সহসা নতুন ভোর। শুরু হয় নতুন বিপ্লবের পদধ্বনি। দীনেশচন্দ্র সেন ‘বৃহৎবঙ্গ প্রথম খন্ড’ কিতাবে স্বভাবতই বলেন, মুসলমানগণ কর্তৃক বঙ্গবিজয়কে বৌদ্ধরা ভগবানের দানরূপে মেনে নিয়েছিল।১৪

বাংলাভাষা ও সাহিত্যের জন্মলাভ
হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মকিতাব ঐতরেয় আরণ্যকে বাঙালিরা পিশাচ, ইতর, দাস, দস্যু, রাক্ষস, অসুর, ম্লেচ্ছ হিসেবে আখ্যায়িত। বাংলাবুলিকে আর্যঋষিরা পক্ষীভাষা হিসেবে প্রতিপন্ন করে। সেন আমলে বাংলা জবানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করে সংস্কৃত বুলি ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে তদানীন্তন হিন্দু সরকার। গৃহকোণে বন্দি হয়ে পড়ে বাংলাভাষা।
জানিনা কতদিন বাঙ্গবাণী জন্মিয়া ঘরের কোণে লাজুক বধূটির মত নিরিবিলি বাস করিতেছিল। সে দিন বাঙ্গালার অতি স্মরণীয় সুপ্রভাত, যে দিন সে সাহিত্যের বিস্তীর্ণ আসরে দেখা দিল। বাস্তবিক সেদিন বাঙ্গালীর এক নবযুগের পূণ্যাহ। … যাঁহারা বলিয়াছিলেন- অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ। নিশ্চয় তাহারা বাংলা ভাষাকে আবাহন করে আনেন নাই। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিপক্ষেরাই সনাতনপন্থিগণকে বিমোহিত করে বেদমার্গ হইতে ভ্রষ্ট করিবার জন্যই এই মোহিনী বঙ্গবাণীর সাধনা করিয়াছিল। পরে স্বার্থের খাতিরে লৌকিক দেবতার পূজকরাও তাহাদের সহিত যোগ দিয়াছিল।১৫

বখতিয়ারের বাংলা বিজয় না হলে আজ দেশের রাষ্ট্রভাষা থাকত সংস্কৃত। মুসলিম মুলুক কায়েম হওয়ায় তকদির ফিরে পায় বাংলাভাষা। আচার্য শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেনের ব্যক্ত বাণী:
মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করতেছিল। … হীরা কয়লা খনির মধ্যে থেকে যেমন জহুরির আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভেতর মুক্তা লুকিয়ে থেকে যেরূপ ডুবুরির অপেক্ষা করে থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোনো শুভদিন, শভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গালা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। … বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙ্গালা মুসলমানদের মাতৃভাষা।১৬
এটাই চিরন্তন সত্য। মুসলিম শাসনের প্রভাবে বাংলা বুলি ও সাহিত্যে পয়দা হয় রেনেসাঁ। এই নবজাগরণে সৃজিত হয় কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। সুলতানি ও মুঘল আমলে ৪০ জন মুসলিম কবি ও ৩০ জন হিন্দু কবি ধর্মীয় কাব্য, রসপ্রধান কাব্য, বীরগাঁথা, রম্যকাব্য ও মর্সিয়া কাব্য রচনা করেন। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম-হিন্দুতে কোনো তফাৎ ছিলো না।

মুসলিম বিজয় ছিলো বাংলার প্রতি বিরাট আশির্বাদস্বরূপ। এটা বাংলাভাষী লোকদেরকে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্যমঞ্চে সংঘবদ্ধ করে। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের ভিত্তি স্থাপন করে দেয়। কেবল এই বিরাট সংহতি এবং মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার গুণেই বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি উৎসাহিত হয়। যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় তরান্বিত না হতো এবং এ প্রদেশে আরও কয়েক শতকের জন্য হিন্দু শাসন অব্যাহত থাকত। তাহলে বাংলাভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং অবহেলিত ও বিস্মৃত হয়ে অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো।১৭
আজকের বাংলাদেশ
আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সমরবিদ বখতিয়ার খলজি। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সহিহ সত্য। পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক অধ্যাপক রিচার্ড এম. ইটন১৮ বলেন:
এই অভ্যুত্থান (মুহাম্মাদ বখতিয়ারের উত্থান ও লক্ষ্মণ সেনের পতন) পাঁচশতাধিক বছর স্থায়ী এমন এক সূচনা করেছিল যাতে বাংলার অধিকাংশ এলাকা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী শাসকদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। … স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকাংশ সদস্য শাসক শ্রেণীর ধর্ম ইসলামকে গ্রহণ করেছিল। এটা ছিল চরম পরিণতিসূচক ও বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে প্রমাণিত, কারণ মুসলমান জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতকে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি করে।১৯

সবারই জানা আছে ব্রিটিশ শাসনাবসানে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয় ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে। আজকের বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এ অংশ পাকিস্তানের অংশীভূত হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে পয়দা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। এখানকার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ মুসলিম হওয়ায় আযাদি অর্জন সম্ভব হয়েছে। বখতিয়ারের অভিযান ও বিপ্লব ব্যর্থ হলে হিন্দু রাজত্ব অদ্যাবধি বহাল থাকত এই স্বপ্নপূরীতে। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের সব তারিফ, সব প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য। আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে আজও ভারতের প্রদেশ হয়ে থাকতে হতো। এটাই স্বাভাবিক।

বাংলার জানা ইতিহাসে যে নামটি সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তারকারী, যে নামের অহঙ্কারে মাতোয়ারা বাঙালি, বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, যার আগমন না ঘটলে বাংলায় মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য স্বাধিকার সম্ভব হতো না, অহির বিধান কায়েম হতো না, বাংলা মুল্লুকে ইসলামের প্রচার প্রসার ঘটতো না, বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই বিস্ময়কর পুরুষ, রূপকথার রাজপুত্রের মত তেজোদীপ্ত, অসীম সাহসী, বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পথিকৃত, যাঁর নাম মালিক বখতিয়ার খলজি। তাই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলা যায় বখতিয়ারই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নগাঁথার রচিয়তা। এজন্যই ধ্রুবতারা হয়ে জ¦লছেন বাংলার আকাশে। তিনিই ছিলেন বাংলার মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রথম নিশান বরদার। দুই শতাব্দীর পরাধীনতার গ্লানি মোচন করে বাংলাদেশের মুসলমানরা স্বাধীন ভূখ-ন্ডের বাসিন্দা। নানাবিধ ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে উপমহাদেশের ৫৫ হাজার ৮১৩ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে যে স্বাধীন বাঙালি মুসলিম নিবাস নিশ্চিত হয়েছে, যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন রয়েছে তার পথপ্রদর্শক, দিশারী পুরুষ তো ওই মহান সিপাহসালার বখতিয়ার। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই মহান পথপ্রদর্শকে আমরা বিস্মৃত হয়েছি। বানের পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানার মত আমাদের স্বাধীনতার গৌরবের অসংখ্য ভাগিদারদের ভীড়ে বাংলার সমতল ভূমি ছেয়ে গেছে। কেবল অনুচ্চারিত থেকে গেছে সেই মহান পুরুষটির নাম, যার পদার্পণ না ঘটলে এই বাংলার মাটিতে ইসলাম আবাদ হতো না, মুসলমানরা রাষ্ট্রক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচশ বছর দেশ শাসন করতে পারতো না, স্বাধীন বাংলাদেশ নামক এই ভূখন্ডের জন্ম হতো না। দুঃখের বিষয় আমাদের ইতিহাসের সেই মহান নায়ককে আজ আমরা ভুলে গেছি, হারিয়ে ফেলেছি। সত্য ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে আমাদের বড় অনীহা। আমরা ভুলে যাই, সত্য ইতিহাসই বর্তমানের সাথে অতীতের যোগসূত্র রচনার একমাত্র উপায়। ঐতিহ্যই জাতির প্রত্যাশার রূপ, আকাক্সক্ষার ফসল।১৯

বিশ শতকে স্বাধীন দেশ গড়ার প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অবদানে যারা ঋদ্ধ তাঁরা হলেন মৌলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, শরৎ চন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, সুভাস চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, খাজা নাজিম উদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান এবং আরও অনেকে। কিন্তু শিকড় সৃষ্টি করে গেছেন মহাবীর বখতিয়ার।

বাঙালিবাদী, সেকুলার, হিন্দু, বৌদ্ধ, বাম-রাম বা তথাকথিত প্রগতিবাদীরা বখতিয়ারকে আক্রমণকারী বা ভিলেন হিসেবে জাহির করতে পারে। কিন্তু বিশে^র মানবতাবাদীরা এটা মনে করেন না। তাঁরা বখতিয়ারকে আলোর দিশারী ও ত্রাণকর্তা হিসেবেই গ্রহণ করে নিয়েছে। বাস্তবেই বখতিয়ার তাই। এ কারণেই হকপন্থী মানুষ ও মুসলিমদের কাছে তিনি ইতিহাসের মহানায়ক। বখতিয়ারই আমাদের স্বপ্নপুরুষ, আমাদের নেতা এবং মানবাধিকার সংরক্ষক। তাই আমাদের বলনে, করণে, চলনে, মননে, শয়নে, স্বপনে, বয়ানে এই রূপকথার নায়ককে লালন করাই হোক সবার অঙ্গীকার।

তথ্যসূত্র:
১. সুখময় মুখোপাধ্যায়: বাংলার ইতিহাস ১২০৪-১৫৭৬, খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি, ৬৭ প্যারীদাস রোড ঢাকা-১১০০, এপ্রিল ২০০০, পৃষ্ঠা ১১
২. শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন: প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, পলাশ প্রকাশনী, ১০ কবি জসিমউদদীন রোড, ঢাকা ১২১৭, প্রথম পলাশ প্রকাশনী সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২ইং, পৃষ্ঠা ১২
৩. শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন: প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, পৃষ্ঠা ১২-১৩
৪. ড. এস এম রফিকুল ইসলাম: প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাস: সেনযুগ, বাংলা একাডেমি ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: মে ২০০১, পৃষ্ঠা ২০৬-২১৪
৫. ভিক্ষু সুনীথানন্দ: বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, বাংলা একাডেমি ঢাকা, জুন ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ৭৭
৬. চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত শূণ্যপূরাণ নিরঞ্জনের রুষ্মা পরিচ্ছদ, কলিকাতা ১৩৬৬, উদ্ধৃত, ভিক্ষু সুনীথানন্দ: বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, পৃষ্ঠা ৭৭
৭. শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার: বাংলা দেশের ইতিহাস, প্রথম খ-, প্রাচীন যুগ, চতুর্থ সংস্করণ, কলকাতা, শ্রাবণ ১৩৭৩, পৃষ্ঠা ২০২
৮. অতীন্দ্র মজুমদার: চর্যাপদ, নয়া প্রকাশ, ২০৬, বিধান সরণী, কলকাতা ছয়, প্রথম প্রকাশ চৈত্র ১৩৬৭, পৃষ্ঠা ৩১-৩৩
৯. রমা প্রসাদ চন্দ: গৌড় রাজমালা, দে’জ পাবলিকেশন্স, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ মে ২০১৪, পৃষ্ঠা ৮১
১০. সুরজিৎ দাশগুপ্ত: ভারতবর্ষ ও ইসলাম, সাহিত্য প্রকাশ, ৮৭ পুরানা পল্টন লাইন, ঢাকা ১০০০, প্রথম বাংলাদেশ মুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৬
১১. আবুল মাল আবদুল মুহিত: বাংলাদেশ: জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব, সাহিত্য প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০০, ৫১ পুরানা পল্টন ঢাকা-১০০০, ওঝইঘ ৯৮৪-৪৬৫-২১৯-১৭, পৃষ্ঠা ২৫
১২. আসকার ইবনে শাইখ: মুসলিম আমল বাংলার শাসনকর্তা, পৃষ্ঠা ৬৫-৬৬
১৩. ড. মোহাম্মদ হাননান: বাঙালির ইতিহাস, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭
১৪. শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন: বৃহৎবঙ্গ প্রথম খ-, পৃষ্ঠা ৫২৮-৩০; উদ্ধৃত, ভিক্ষু সুনীথানন্দ: বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, পৃষ্ঠা ৭৫
১৫. ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ: বাংলা সাহিত্যের কথা প্রথম খ– প্রাচীন যুগ, মাওলা ব্রাদার্স, ৩৯ বাংলাবাজার ঢাকা ১২১৫, তৃতীয় মুদ্রণ: আগস্ট ২০০৬, ওঝইঘ: ৯৮৪ ৪১০-১০৬ ৯, পৃষ্ঠা ১৪
১৬. শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন: বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব (প্রবন্ধে), উদ্ধৃত: মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত বাংলাভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: জুন ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১৮-২৯
১৭. ড. এম. এ. রহিম: বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতি ইতিহাস প্রথম খ-, ভূমিকা, (তরজমা- মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান) বাংলা একাডেমি ঢাকা, দ্বিতীয় পুনমুদ্রণ: জুন ২০০৮, পৃষ্ঠা ৮
১৮. রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাকসনের অরিজোনা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর, নামজাদা শিক্ষাবিদ, গবেষক, ঐতিহাসিক।
১৯. রিচার্ড এম. ইটন: ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ (তরজমা- হাসান শরীফ), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জুন ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৬-১৭
২০. প্রথম প্রভাত, বঙ্গবিজয়ের ৭৯৩ তম স্মারক, ধানমন্ডি ঢাকা, জানুয়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ২৭-২৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *