বখতিয়ার খলজি ও লক্ষণ সেন কন্যার গল্পগাঁথা

 

বিজয়ী বীর বখতিয়ার খলজি তখন গৌড় বাংলা শাসন করছেন। রাজা লক্ষণ সেন পালিয়ে গেছেন বিক্রমপুরে। মুসলমানদের শাসনে রাজ্যের হিন্দু বৌদ্ধসহ সকল প্রজা বেশ সুখেই আছে। রাজ্যের সুখের খবর চাপা থাকল না। সর্বত্র সুখের খবর ছড়িয়ে গেল। পৌছল রাজা লক্ষণ সেনের কানে। রাজমাতা শুনলেন, রানি শুনলেন। নিতান্ত অবিশ্বাসের মাঝেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন। এরই মধ্যে বিশ^স্ত প্রমাণও তাঁরা পেয়েছেন। বিশ্বাস না করে পারেন? লক্ষণ সেনের একমাত্র কন্যা শুনে উতলা হয়ে উঠেছেন। তাঁর স্থির সংকল্প তিনি ফিরে যাবেন সাধের নবদ্বীপ ধামে। রাজবাড়ি না হোক, রাজপথেই বাসা বাঁধবেন। একদিন সত্যি সত্যিই দেখা গেল রাজবাড়িতে কে যেন চুপিসারে ঢুকছে। প্রহরী রুখে দাঁড়ালো, কে কী তার পরিচয়। রাজ-দুহিতা নির্ভয়ে জানালেন- যা বলার তিনি রাজার কাছে বলবেন। তাঁর সাথে তিনি সাক্ষাত করতে চান। দ্বার রক্ষক তাঁকে সসম্মানে নিয়ে চললো রাজ সন্দর্শনে। খবর নিয়ে বললো একটু অপেক্ষা করতে। একটু পরে উনি আসছেন।

শিল্পীর চোখে বখতিয়ার খিলজী : kalayi.blogspot.com

রাজ-দুহিতা দেখতে পেলেন কে যেন নামায পড়ছেন। খোলা দরজা দিয়ে তাঁকে দেখা যাচ্ছে। সৌম্য প্রশান্ত বদন। সুললিত কণ্ঠস্বর। এরপর রাজ-দুহিতার আরো অবাক হবার পালা। নামায শেষে সেই ব্যক্তিই তাঁর সামনে হাজির হয়েছেন। তিনি বিনম্রভাবে তাঁকে আহ্বান জানাচ্ছেন অন্দরে আসতে। অসঙ্কোচে রাজ-দুহিতা বললেন- তিনি রাজার সাথে সাক্ষাত করবেন। তাঁর বিশেষ প্রয়োজন। সরদার আবার আহ্বান জানালেন- আসুন, ভেতরে আসুন। সে কণ্ঠে কী যাদু ছিলো কে জানে। রাজ-দুহিতা সম্মোহিতের মতো তাঁর পিছু অনুসরন করলেন। এ বাড়ির সবকিছুই তার নখদর্পণে। সব অলিগলি, আনাচকানাচ তার কত চেনা। কত না আপন। সেই বিশাল হলঘরে বসে রাজ-দুহিতা অবাক হলেন। সেই আগের মতই সব সাজানো গোছানো আছে। সবকিছু পরিপাটি ছিমছাম। এ কথা সে কথার পর রাজদুহিতা তাড়া দিলেন- রাত হয়ে এলো। আমি এবার ফিরে যাবো। একবার শুধু রাজার দেখা চাই। কথায় কথায় লক্ষণ সেন কন্যা অবশ্য মুগ্ধ হয়ে গেছেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ করেছেন তাঁর পরিচয়। আনন্দের আতিশয্যে এতটুকু গোপন রাখেননি।

কথার পিঠেই কথা দিয়ে সরদার দু:খ প্রকাশ করলেন সত্যিই রাত হয়েছে তাঁর খেয়াল হয়নি। তিনি অনুতপ্ত। এবার সাদর আহ্বান এলো- আপনার বিশ্রামের দরকার। আর আপনার আহারের আয়োজন হয়ে গেছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। তারপর রাজকন্যাকে হতচকিত করে দিয়ে সরদার তাঁর হাতে তুলে দিলেন চাবির গোছা। পরম প্রত্যয়ের সুরে বললেন- যে ঘরে ইচ্ছা আপনি থাকতে পারেন। যে ঘর আপনার পছন্দ, সেই ঘর বেছি নিন। আর যে পাচক-পাচিকাকে দরকার তাকে দিয়েই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করুন। এ ঘর-দোর আপনাদের। আমি রক্ষণাবেক্ষণ করছি মাত্র। বিনয়ে বিগলিত রাজকন্যার বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি। তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন, যাকে খুঁজছেন তাঁকে পেয়েছেন।দুস্তি-দুশমন, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে যিনি সবার হৃদয় জয় করেছেন, এই সেই বিজয়ী বীর বখতিয়ার। নদীয়া নবদ্বীপ ধাম অভিযানের সরদার ঘোড়-সওয়ার, যার নাম লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে।

ছবি: বখতিয়ারের নামে বখতিয়ারপুর জংশন, বিহার : en.wikipedia.org

তারপরে এ কথা সে কথার পর রাজদুহিতা সহাস্যে বলেন-আমরা যে অলক্ষ্যে বলি আপনি যবন, তা জানেন? তেমনি হাসিমুখেই বখতিয়ার জানালেন- জানি। রাজদুহিতা বললেন- আপনি মুসলমান। আর আমি হিন্দুর ঘরের ময়ে। বরং বলতে পারেন আপনার চিরশত্রু কন্যা। তবু আমরা নতুন করে জানলাম- আপনি সত্যি মহান, মহানুভব। আপনার তুলনা হয় না। আপনি খাঁটি মানুষ। খাঁটি মুসলমান। আপনাকে সর্বান্ত:করণে বিশ্বাস করি। বখতিয়ার খলজির চোখে মুখে তখন জয়ের গৌরব। পবিত্র ইসলামের মহান বাণী স্মরণ করে তিনি বলেন- আল্লাহর কাছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই। সব মানুষকে সমানভাবে ভালোবাসর নাম ইসলাম। আমি তাঁরই একজন নগণ্য খাদেম। ইসলামের শিক্ষাই আসল শিক্ষা।

হদিস:
১. ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক: ভারতে মুসলিম নির্যাতন, ঢাকা পাবলিকেশন্স, বাংলাবাজার ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ২০১১
২. আব্দুল্লাহ মামুন আরিফ আল্ মান্না: ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমের ভুল ধারণা
৩. ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *