বরিশালে ইসলাম

মাহমুদ ইউসুফ।।

মানব জাতির উৎপত্তি একক থেকে। সব মানুষ একই উৎস থেকে উৎসারিত। সৃষ্টির সূচনায় মানবজাতিকে এক গোষ্ঠীতে পয়দা করা হয়। মহাপ্লাবনে খোদাদ্রোহীরা সমূলে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। অতঃপর নুহের অনুগামীরা পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় ঠিকানা স্থাপন করেন। যেসব অঞ্চলে তাঁরা যাত্রাবিরতি করেন বা গমন করেন, সেসব অঞ্চলের নাম তাঁদের নামানুসারে রাখা হয়। এভাবেই সৃষ্টি হয় পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ও দেশ। বাংলায় বঙের আগমনও সে ধরনের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আদম-হাওয়ার মাধ্যমে জগতে জাতির জন্ম। সেই জাতি ছিলো অহির বিধান ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী। উত্তরকালে মানুষ মহামহিম আল্লহকে ভুলে বিভিন্ন ভ্রান্ত মত ও পথকে মেনে নেয়। গ্রহণ করে খোদাদ্রোহী মতবাদ। অহির দীন ত্যাগ করে স্বনির্বাচিত ধর্মানুষ্ঠান ও আচার-আচরণে নিবিষ্ট হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতীক্রম নয়। কালক্রমে বাঙালিরাও আদর্শচ্যুত হয়। মহানবির আবির্ভাবের পর দাওয়াত পেয়েই তাঁদের ইমান ঝলমলিয়ে ওঠে। আবুল মনসুর আহমদের বয়ান ভিন্নভাবে, ‘আরব দেশ হইতে আগত বাঙালিদের দলে দলে ইসলাম গ্রহণের কারণ সুস্পষ্ট। নিজেদের আদি জন্মস্থানের ধর্মপ্রবর্তকের প্রতি টান থাকা তাদের জন্য স্বাভাবিক। কাজেই আরব দেশে ইসলামের আবির্ভাবের প্রথম শতকেই এরাও ইসলামে আকৃষ্ট হয়েছিল স্বাভাবিক কারণেই।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আরব জাতি উদ্ভূত এই বাঙালিরাই প্রথমে বৌদ্ধধর্মে ও পরে ইসলাম ধর্মে দলে দলে দীক্ষিত হয়। তাই পশ্চিম হতে পির দরবেশ ও দিগি¦জয়ী বখতিয়ার খলজির আগমনের ৫০০ বছর আগে এবং সিন্ধু দেশে মোহাম্মদ বিন কাসিমের পদার্পণের ৭০ বছর আগে বাংলাদেশের বাসিন্দাদের মেজরিটি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল।’

বরিশাল শব্দটি কোনো আরবি শব্দের অপভ্রংশ। বহর-ই-সওয়াল থেকে বরিশাল শব্দের উৎপত্তি। ইতিহাসের সুদূর অতীতকাল থেকেই যেহেতু বাংলা এলাকার সাথে সেমেটিক আরব জাতির বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিলো। আরব নাবিকদের সমুদ্রাভিমুখি বাণিজ্য জাহাজকে এ অঞ্চলের লোকজন ‘বহর’ বলে চিহ্নিত করত। আর ভয়াল তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ বাংলার দক্ষিণের সমুদ্রপারের নৌপথটি বিপজ্জনক। এ এলাকায় এসেই আরব বাণিজ্য বহরের নানারূপ সওয়াল বা প্রশ্ন উত্থিত হতো। এই সিলসিলা থেকে বরিশাল নামের সৃষ্টি। [আজিজুল হক বান্না, বরিশালে ইসলাম, পৃ ১৩২] ঐতিহাসিক এ. এফ. এম আব্দুল জলীল তাঁর সুন্দরবনের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নদী ও সমুদ্রে ঘেরা বিধায় আরব নাবিকেরা (বরিশাল) এসেছিলো ব্যবসায় বাণিজ্য উপলক্ষে। এ অঞ্চল তাই আরবদের স্মৃতি বহন করে আসতেছে। বাকলা অর্থ শস্য ব্যবসায়ী। কে বা কারা ওই নাম দিয়েছিল জানা যায় না।’ [পৃ ৫৩৮]


প্রাচীন বঙ্গ বা প্রাচীন বাঙলার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো বাকলা বা চন্দ্রদ্বীপ। যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, সোনারগাঁও, ঢাকা প্রাচীন বাঙলার অন্তর্ভুক্ত। প্রাগৈতিহাসিককালে নুহ প্রপৌত্র বঙ নদীমাতৃক ভূভাগে বসতি করেন। বঙ থেকে বাঙলা। বাঙালা আর বাকলা অবিচ্ছেদ্য অংশ। একই মুদ্রার অভিন্ন পিঠ। কারও মতে শব্দের লিপ্যান্তর মাত্র। তাই বঙের সাথে বাঙলার ইতিহাস বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ নেই। বঙের ইতিহাসই বাঙলার ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস। বঙ হলেন নুহ নবির প্রপৌত্র ও নবি আদমের ১৪তম অধস্তন পুরুষ। আদম→শিষ →আনু →কাএন →মাহলা এল →য়্যারবু →উখনুখ →মুতাশলাখ →লামাক →নুহ →হাম →হিন্দ→বঙ। বঙের জীবনকাহিনিই বলে দেয়, বাকলায় থিতু হওয়া সর্বপ্রথম জনগোষ্ঠী ছিলো মুসলমান। নবি নুহ, পুত্র হাম, পৌত্র হিন্দ, প্রপৌত্র বঙ এবং বঙের সন্তানরা সকলেই ছিলেন মুসলিম। ড. কাজী দীন মোহাম্মদ লিখেছেন, ‘আজ থেকে সাড়ে সাত হাজার বছর আগে হযরত নুহ আ. এর সময়ে সংঘটিত মহাপ্লাবনের পর আল্লাহর অস্তিত্ব একত্ববাদে বিশ্বাসী তাঁর প্রপৌত্র বঙ্গ এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। এরপর যে জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে তাই বঙ্গ জনগোষ্ঠী নামে অভিহিত হয়। কালের বিবর্তনে উক্ত বঙ্গ থেকেই বঙ্গদেশের নামকরণ হয়েছে। কাজেই খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে আরবদেশে হযরত মুহাম্মাদ স. এর আগমনের পর বাংলায় যে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে তা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বস্তুত পৃথিবীতে মানুষের আগমন ও তার বিকাশ ধারার সাথে ইসলাম ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। কাজেই এদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে সে সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান অপরিহার্য।’ [বাংলাদেশের উৎপত্তি ও বিকাশ, পৃ ১৬৭]

বঙ বাঙালি জাতির আদি পুরুষ। হযরত নুহ নবির প্রপৌত্র বঙ সম্পর্কে মুক্তবিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার বর্ণনা, ‘বঙ্গ (কিংবা বঙ বা বং) ছিলেন একজন কিংবদন্তি বংশধর যিনি দক্ষিণ এশিয়ার বাংলা অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপনকারী বলে মনে করা হয়।
বঙ্গকে হিন্দের ছেলে ও হামের (হজরত নুহের ছেলে) নাতি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম শতাব্দীর রোমানো-ইহুদি ইতিহাসবিদ ফ্ল্যাভিয়াস জোসেফাস জোর দিয়েছিলেন যে হামের বংশধরেরা এশিয়ার কিছু এলাকায় জনবহুল ছিল। গুলিয়ানার হাফিজ শামসুদ্দিন দাবি করেছিলেন যে হজরত হাম বর্তমান পাকিস্তানের ‘গরিবওয়াল’ নামক একটি শিয়া-জনবহুল গ্রামে মারা গিয়েছিলেন, যেখানে আজও একটি ৭৮ ফুট লম্বা কবর পাওয়া যায়।
অনেক নথিভুক্ত সূত্র এবং ইবরাহিমি ইতিহাসবিদদের মতে, পিতৃপুরুষ বঙ্গই প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন যা এখন দক্ষিণ এশিয়ার বাংলা অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। এতে বলা হয়েছে যে সেখানে বসতি স্থাপনের পর, তার আওলাদ হয়েছিল এবং বঙ্গ নামে পরিচিত একটি মহান জাতি কায়েম করেছিলেন। এ কথাটি ১৬ শতাব্দীর ইতিহাসবিদদ্বয় ফিরিশতা এবং আবুল-ফজল ইবনে মুবারক দ্বারাও সমর্থিত।’ এ তথ্যের আলোকে সুনিশ্চিত যে, বঙই বাঙালি জাতির আদি জনক। হযরত নুহ নবির সাথেই বাঙালি জাতির রিশতা বা মূল সম্পর্ক।

রাজাপুরের খাঁন বাড়ি মসজিদ

তাই সুনিশ্চিত যে, মুসলমানরাই বাকলা বরিশালের আদিবাসী। মুসলিম নাগরিক সমাজই চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন জনগোষ্ঠী। ইসলাম ধর্মাবলম্বি নাগরিকরাই বরিশালের আদিম অধিবাসী। নবি-রসুলের ওয়ারিশরাই চন্দ্রদ্বীপ সর্বপ্রথম আবাদ করেন। বাকলার রোমাঞ্চকর ঐতিহ্যের জীবনরেখা মুসলিমদেরই দান। ইতিহাসখ্যাত গঙ্গারিডি রাজ্য নির্মাণ করেছিল বঙ্গ-দ্রাবিড়ি মুসলিম নায়কেরা। বাকলা ছিলো গঙ্গারিডি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।


মিডেল এজে পশ্চিমা বিবরণীতে দেখা যায়, বরিশাল উপকূলের অধিবাসীরা ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়। ১৬৬১ সালে ওলন্দাজ জাহাজ ‘টার স্কেলিং’ বাকলা উপকূলে বিধ্বস্ত হয়। ডাচ নাবিক গ্লানিয়াস জাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার কাহিনি, ক্রু ও যাত্রীদের দুর্ভোগ ও দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। ১৬৮২ সালে লন্ডনে যা ‘বাঙলা মুল্লুকে একটি দুর্ভাগ্যজনক সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা’ নামে প্রকাশিত হয়। জাহাজের যাত্রীরা সমুদ্র উপকূলে যেসব লোকের মোলাকাত পেয়েছেন তারা ছিলেন মুসলমান। আধুনিককালে বরিশালের মুসলমান সংখ্যাধিক্য প্রসঙ্গে হেনরি বেভারিজের বিবৃতি, ‘বাকেরগঞ্জের দক্ষিণাংশে স্থায়ী বসবাসকারী মুসলমানদের সংখ্যা অতিরিক্ত ভারী হওয়ার পেছনে ধর্মান্তরকরণের অবদান খুব বেশি নেই।’ [পৃ ২১৭] প্রকৃত ব্যাপার হলো মুসলমান হিন্দু বা অন্যধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত কোনো জাতি নয়। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, উপজাতি এককালে সকলেই ইসলাম ধর্মানুসারী ছিলেন। সময় পরিক্রমায় মুসলিম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে তারা ওইসব ধর্ম গ্রহণ করে। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস তাই বলে। কারণ আদম-নুহ সকলেই ছিলেন মুসলিম। বর্তমান বিশ্বের ৮০০ কোটি মানুষ তাঁদেরই বংশধর। বরিশালের সিংহভাগ লোকের পেশা কৃষি। আর কৃষি হলো নবি আদমের জীবিকা প্রথা। কৃষিকাজের সাথে আদমের ধর্মীয় রীতিনীতি সংশ্লিষ্ট। বরিশালের প্রাচীনকালের, আদিকালের, প্রাগৈতিহাসিককালের জনগণ ছিলো মুসলমান, বর্তমান জনগোষ্ঠীও মুসলমান। মাঝে কিছুকালের জন্য বিভ্রান্ত হয়েছিলো। বক্ররেখার সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে বর্তমানে সুপথেই বহমান বরিশালবাসী।

আর্যদের সংস্কৃত সাহিত্যে ও ধর্মশাস্ত্রে নবিদের উত্তরসূরী বাঙালিদের দস্যু, দাস, বর্বর, অস্পৃশ্য, অপাঙক্তেয়, যবন, অসভ্য, অসৎকুলজাত, ধর্মজ্ঞানশূণ্য, ভাষাশূণ্য পক্ষী, অপবিত্র পক্ষীবৎ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহাভারতে বাংলার সমুদ্রতীরবর্তী লোকদের ম্লেচ্ছ বলছে। মহাভারত রচয়িতার কাছে বরিশাল ম্লেচ্ছদেশ। উক্ত হয়েছে বঙ্গদেশ বৈদিক কৃষ্টি ও সভ্যতার বহির্ভূত। আর্যহিন্দুদের বিজাতীয় বিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা অতি পুরাতন। পৌরাণিক হিন্দুধর্মগ্রন্থে বাংলার আদিম অধিবাসীদের অত্যন্ত হেয়, কদর্য ও ঘৃণ্য ভাষায় বিবৃত। পুরাণে জারজ, মনুসংহিতায় সর্প, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে অনার্য, অসুর। ঐতরেয় আরণ্যকে দুর্বল, দুরাহারী ও কাক। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে অস্পৃশ্য ও পক্ষীরূপে চিত্রিত। এখানে বঙ্গভূমিকে ঘৃণাহ ম্লেচ্ছদেশ বলা হয়েছে। স্বল্পকালের জন্য বসবাস করলেও তা আর্যসন্তানদের প্রায়শ্চিত্য করতে হবে বলে শাস্ত্রগ্রন্থে বর্ণিত। আধুনিককালেও বাকেরগঞ্জের অধিবাসী বঙাল বলে অভিহিত। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা বঙাল বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও উপহাস করে আমাদের। এর কারণ আমাদের মুসলিম আইডেন্টিটি। কারণ আমরা বঙের আল বা আওলাদ বা সন্তান-সন্তুতি। বঙের আওলাদরাই বঙাল। বঙ হলেন আবু বঙ্গাল বা বঙ্গালদের পিতা।

তথ্যসূত্র:
১. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বরিশাল বিভাগের ইতিহাস
২. আজিজুল হক বান্না, বরিশালে ইসলাম
৩. এইচ বেভারেজ, দি ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ
৪. রিচার্ড এম. ইটন, ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ
৫. আখতার ফারুক, বাংগালীর ইতিকথা
৬. মনসুর মুসা সম্পাদিত বাঙলাদেশ
৭. বাংলাদেশের উৎপত্তি ও বিকাশ, ইফাবা
৮. আনিসুল হক চৌধুরী, বাংলার মূল
৯. শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলা দেশের ইতিহাস ১ম খ-, কলকাতা
১০. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব, কলকাতা
১১. অনিল চট্টোপাধ্যায়, বাঙালিরা হিন্দু হলে তো বাঙলাদেশই হয় না, কলকাতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *