নুরুল আমিন
আবহমান বাংলার সমৃদ্ধ প্রকৃতির এক অবারিত দান বর্ষাকাল। আমাদের জীবনযাত্রার পথে বর্ষার স্নিগ্ধ পরশ প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। বর্ষার রূপ-রস আর সৌন্দর্যে প্রকৃতি সজীব হয়ে ওঠে। বৃষ্টি ধোয়া প্রকৃতির রূপে মন মেতে ওঠে। বর্ষার রিমঝিম শব্দে মন হয়ে ওঠে কাব্যময়। প্রচণ্ড তাপদাহকে বিদায় জানিয়ে বর্ষা রানীর বর্ষণে সিক্ত হয় প্রকৃতি এবং প্রাণ ফিরে পায়। বয়ে যায় শীতল বাতাস। নেমে আসে প্রশান্তি। বর্ষা মৌসুমে মনোরম দৃশ্য দেখে চোখ জুড়ায়, মন ভরে যায়।
শহর কিংবা গ্রামে বৃষ্টি ভেজা পথে পিচ্ছিল খেয়ে পড়েনি বা বৃষ্টির পানিতে ভিজেনি এমন লোকের সংখ্যা খুব কম। বাঙালির অতি প্রিয় ঋতু বর্ষাকাল। বর্ষায় প্রকৃতির অপরূপ আর আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘের ভেলা মন কেড়ে নেয়। অবারিত মাঠ, মেঘলা আকাশ, টলমলে জলের পুকুর, মাটির সোঁদা গন্ধ, ভেজা সবুজ ঘাস আর পাতার হাসি দেখতে ভাল লাগে। শাপলা, পদ্ম, কদম কেয়া আরও কত রং-বেরঙের ফুল-ফসলের হাসিতে জেগে ওঠে বাংলার প্রতিটি জনপদ। বর্ষার থইথই জলে শৈল, বোয়াল, কই, সিং, জাগুর ইত্যাদি নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। আসমানে গুড়ুম গুড়ুম ডাক দিলে সাগর-নদী থেকে এসব মাছ খাল, বিল, পুকুর ও জলাশয়ে উঠে আসে। বর্ষাকালে টাটকা মাছের স্বাদ-ই আলাদা।
আষাঢ়-শ্রাবন এই দুই মাস বর্ষাকাল হলেও বছরের বেশিরভাগ সময় জুড়ে থাকে বর্ষাকাল। বাঙালির অতি প্রিয় ঋতু বর্ষাকাল। বাংলা সাহিত্যে বর্ষা ঋতুর বেশ প্রভাব পড়েছে। বর্ষার কাদাজলে মিশে আছে বাঙালির প্রাণ। বাইরে ঝড় বয়, অথচ জানালার পাশে বসে দাদা-দাদীর কাছে গল্প শুনে বেশ আনন্দ উপভোগ করে কচিকাঁচার দল। বর্ষায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ।
কিন্তু বর্ষণে জনজীবনে দুর্ভোগের পালা কোন অংশে কম নয়। বর্ষাকালে রাস্তাঘাট গ্রাম শহর বন্দর সবখানেই বৃষ্টিজলে কদাকার হয় চারপাশ। দেশের অনেক স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রবল বর্ষণ আর জোয়ারের পানির নিচে পথঘাট তলিয়ে যায়। পথচারী ও যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। যানজট সৃষ্টি হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ রাস্তায় চলাফেরা করতে হয়। গ্রামের চেয়ে শহরের অবস্থা বেশি খারাপ হয়। অনেক জায়গায় মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়ে। মশা-মাছির উপদ্রব বেড়ে যায়। মশা ও পানি বাহিত নানা রোগ দেখা দেয়। কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়ে। বাড়তি পানির চাপে অনেকের পুকুর ও খামারের মাছ চলে যায়। বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়। শহরের অলিগলি এমনকি গ্রামেও বিভিন্ন কারণে রাস্তা কাটা হয়। অথচ যথাসময়ে তা সংস্কার করা হয় না। এগুলো এক ধরনের অপরাধ। কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও যেন দেখে না। এসব বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এতে কিছুটা হলেও রাস্তায় জনদুর্ভোগ কমবে। সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে।
বর্ষাকালে দেশে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এসব দুর্যোগ থেকে রেহাই পেতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে বাঙালি। বর্ষাকালে বেশি বেশি গাছ লাগানো উচিত। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হবে।
বাঙালি জীবনের এক নতুন আবাহন বর্ষাকাল। গ্রীষ্মের রুদ্র-রুক্ষ প্রকৃতির গ্লানি ধুয়ে মুছে প্রশান্তি আর স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে জীবন। রোদ-বৃষ্টির খেলায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায় বাঙালির মনে। বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে দেখা যায়, প্রচণ্ড খরায় অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ কুলা, থালাবাটি নিয়ে উঠানে নেমে – আল্লাহ মেঘ দে, বৃষ্টি দে প্রভৃতি গান গাইতে থাকে। কুয়ার ভেতর থেকে ব্যাঙের ডাক শুনলেই বাঙালির মনে সাড়া জাগে বৃষ্টি হবে। আসলে তাই হয়ে থাকে। বর্ষায় ডাহুক ডাকে। মেঘের কোল জুড়ে রংধনুর সাত রঙ খেলা করে। কী অপূর্ব দৃশ্য! কী চমৎকার দেখা যায়! মন যমুনায় তখন আনন্দের জোয়ার আসে। প্রকৃতি সাজে অপূর্ব সবুজের সাজে।
দেশের অনেক স্থানেই সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা রয়েছে। এগুলোতে এমনিতেই যাতায়াত করতে অসুবিধা হয়। তার উপর খানাখন্দ। রাস্তায় পানির নিচে লুকিয়ে থাকা গর্তে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। পানি নিষ্কাশনের দুর্বল ব্যবস্থার কারণে সড়কে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। পলিথিনের অপব্যবহার এবং যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে এ অবস্থাকে আরো প্রকট করা হচ্ছে। পানিনিষ্কাশন আরো দুর্বল হচ্ছে। সরকার তথা কর্তৃপক্ষের একান্ত উদ্যোগ ও হস্তক্ষেপ ব্যতীত এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ সম্ভব নয়। অপরিকল্পিত ড্রেন দুরাবস্থা সৃষ্টির জন্য কম দায়ী নয়। অনেক স্থানে ড্রেনের স্লাভ ভাঙ্গা থাকে। বিভিন্ন অপরিশোধ্য বর্জ্য নালা ও নর্দমায় জমে আটকে থাকে। ফলে পানি নামতে পারে না। তাই ঘনঘন নালা নর্দমা পরিষ্কার করা একান্ত প্রয়োজন। বর্ষা মৌসুমে সড়ক ব্যবস্থাকে দুর্দশা থেকে রক্ষা করতে হলে দ্রুত পানি সরানোর ব্যবস্থা জোরদার করা ব্যতীত বিকল্প নেই। এসব সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে কোনভাবেই জলাবদ্ধতাকে আটকানো যাবেনা এবং জনদুর্ভোগ বেসামাল হয়ে উঠবে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বর্ষাকাল প্রতি বছর আসে। প্রকৃতির এ নিয়মকে পরিকল্পনা প্রনয়নের মাধ্যমে উৎপাদন, উন্নয়ন ও অগ্রগতির কাজে লাগাতে হবে। আর তাতে মানুষ দুর্বিসহ জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে কল্যাণময় এক আলোকিত জীবন পাবে। বর্ষণের দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেতে পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেড়িবাঁধ ছিঁড়ে বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবে যায়। মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়।
পানি নামার সীমাবদ্ধতার কারণে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আবার নদী ও খাল দখল করে অনেকেই অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেন। এতে বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ফলে পথেঘাটে পানি জমে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বর্ষাকালে অনেক সময় সড়ক ও ব্রীজের নির্মাণ কাজের বিলম্বিতার কারণেও ভোগান্তি হয়। বর্ষায় সড়কে ভোগান্তি লাঘবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একান্ত উদ্যোগ ও আন্তরিকতা প্রয়োজন। সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিলে প্রত্যাশিত আশা পুরণ হবে আশা করা যায়। ভোগান্তি যা-ই হোক, বর্ষার নিবিড় পরশে প্রকৃতির নতুন সাজে বাঙালির প্রাণে নতুন জাগরণ আসে। নতুন স্বপ্নে জেগে ওঠে বাঙালি। তখন আর দুর্ভোগের চিত্র মনে রাখে না। বর্ষার অপরূপ বাঙালি জাতিকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। বর্ষার অপরূপে মুগ্ধ বাঙালি।
.
লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক, লালমোহন, ভোলা।
[email protected] 01759648626
অভিনন্দন রইল
আমার একটা পশ্ন যে এটা কী রচনা নাকি অন্য কিছু