মোহাম্মদ নূরুল্লাহ :
আমার দাদির তরেতে যেন গো বেহেস্ত নসিব হয় । এ কথাটি কবি জসীমউদ্দীন দাদু ও নাতির কথপোকথনে আবেগ মাখানো ভাষায় যখন এভাবে প্রকাশ করেন, “দোয়া মাগো, দাদু, আয় খোদা দয়াময়, আমার দাদি তরেতে যেনগো ভেস্ত নসিব হয়।” কবি জসীম উদ্দীন অন্তত পাঁচ বার ‘ভেস্ত’ ব্যবহার করেছেন এ কবিতায়। এ শব্দটিকে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, কবি- সাহিত্যিক, গল্প, কবিতা, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিওসহ সবগুলো মাধ্যমের পরতে পরতে ‘ভেস্ত’ শব্দটি নষ্ট হয়ে যাওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে । সচেতন কিংবা অবচেতন ভাবে। যা বলা মুশকিল। যেমন বলা হচ্ছে উত্তর বঙ্গের বন্যায় এবারের ফসলগুলো ভেস্তে গেছে। এভাবে হাজারো উদাহরণ লক্ষণীয়।
রাসূলে পাক (সাঃ) এর মুখনিঃসৃত বাণী, সাহাবী ও তাবেয়ী আজমাইনের বাণীতে আমরা ‘হাদিস’ বলে গণ্য করি।
তথাকথিত বুর্জোয়া সম্প্রদায় ‘হদিস’ নামে একটি শব্দ তৈরি করেছে । যার অর্থ করা হয়েছে খোঁজ বা অনুসন্ধান অর্থে।
যেমন ছেলেটি হারিয়ে গেছে না বলে বলা হচ্ছে ছেলেটির হদিস মিলছে না। আজ ভেবে দেখতে হবে । এরকম অসংখ্য শব্দ আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি । একজন মুসলিম হিসেবে যা ঈমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ।
কেউ যদি বুঝে শুনে ‘বিছমিল্লাহ গলদ’ অর্থাৎ’ ‘আল্লাহর নামে ভুল’ বলে তাঁর ঈমান থাকবেনা। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে পাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন “লা রইবা ফিহি” ভুল তো দূরের কথা আল্লাহর নামে কিংবা আল্লাহর কালামে কোন সন্দেহ নেই। ডঃ মরিস বুকাইলি সূরা মুদ্দাসসিরের ২৯ নাম্বার আয়াতের এর পর্যালোচনা, গবেষণা ও ব্যাখ্যা করে প্রমাণ করেছেন কোরআন সম্পূর্ণ নির্ভুল। তিনি এর হরফ, হরকত ও নানান বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সুতরাং আমরা “বিসমিল্লাহ গলদ” যারা বলছি বা যদি কেউ বলে থাকি অবশ্যই তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিব। কস্মিনকালেও এ ধরনের কথা মুখে আনবো না। ‘আচ্ছালামু আলাইকুম ‘আমরা সম্বোধনে বলবো লিখতে গিয়ে কেন আসসালামু আলাইকুম এভাবে লিখি ? একবারও কি নিজেকে প্রশ্ন করেছি । এগুলো হচ্ছে আরবি ফারছি নির্ভরশব্দ। তাই বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতায়ন বা বিকৃতি করার চেষ্টা মাত্র। যারা করেছেন তারা অনেকটা সফলও হয়েছেন। এ বিষয়ে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। গভীর ঘুমে থেকে নাক ডাকলে কি চলবে ?
আরবি ফারছি না জানা ব্যক্তিগণ বাংলা বানানের এই কদর্য বুঝতে না পেরে অহরহ ভুল উচ্চারণ ও ভুল বানান করে যাচ্ছেন। গত বিশ বছর ধরে বাংলা পড়াতে গিয়ে আমি এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছি।
যেমন কবির নাম হচ্ছে আহসান হাবিব (আহ্ছান হাবীব কিংবা আওছান হাবীব ) যার সঠিক উচ্চারণ। কিন্তু শিক্ষার্থী বা প্রশিক্ষণার্থীগণ উচ্চারণ করে বসেন, আহশান হাবিব । এভাবে হাজারো উদাহরণ রয়েছে। যা ঘটে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এরকম আব্দুস সালাম আব্দুস সামাদ আসগর আলী প্রভৃতি।
এ শব্দগুলোর সঠিক বানান ছিল এ রকম:
আবদুছ ছালাম, আবদুছ ছামাদ, আছগর আলী প্রভৃতি। এ বানানগুলো ও উচ্চারণগুলোতে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণার্থীরা অহরহ ভুল করে যাচ্ছে। আছগর আলী উচ্চারণ করতে গিয়ে প্রায়শ: শোনা যায়; আশগড় আলী। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে বাংলা ভাষার পরতে পরতে। কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় কয়েকটি উদাহরণ উপস্থাপন করলাম।
ভাবমর্যাদা শব্দটির যদি ব্যবহার করি, তাহলে কি ভাষার কিংবা সে বিষয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। আমার বুঝে আসে না। কেন আমরা ‘ভাবমর্যাদা’র পরিবর্তে ‘ভাবমূর্তি’ শব্দটি ব্যবহার করি। বরং আমি মনে করি ‘ভাবমর্যাদা’ শব্দটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য। হ্যাঁ যেখানে ‘ভাবমূর্তি’ শব্দটি দরকার সে স্থানে আমরা ‘ভাবমূর্তি’ শব্দটির প্রয়োগ করব। ‘কুরবানি’র স্থলে ‘কুরবানী’। আবার ‘উৎসর্গের স্থানে আমরা ‘উৎসর্গ’ ব্যবহার করতে পারি। অসাম্প্রদায়িকতা বলতে গিয়ে কিংবা অসাম্প্রদায়িক সাজতে গিয়ে নিজেদেরকে এভাবে বিকিয়ে দিতে পারি না ।
ঈদের আনন্দকে নিরানন্দ করে তুলেছে এই দেশে কারণ “ঈদ “শব্দটির আরবির প্রতিবর্ণ রূপ হল আইন, ইয়া ও দাল। এ তিনটি হরফ মেলে “ঈদ” শব্দটি গঠিত হয়েছে । সেখানে আমরা যদি বলি “ইদ” তাহলে ঈদের খুশি, ঈদের আনন্দ, নিরানন্দে পরিণত হয় । এভাবে হাজার শব্দকে অতি কৌশলে বিতাড়িত করা হচ্ছে। আরবি ফারছী নির্ভর বাংলাকে সংস্কৃতায়ন করাই হচ্ছে এর মূল উদ্দেশ্য ।
আমরা কেন আইন, আদালত, কিতাব, কলম শব্দগুলোকে বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারে সহজভাবে নিতে পারছি না। সকল বাঙালির কাছে এই প্রশ্ন রেখে গেলাম ।
আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে । সচেতন হতে হবে। আরবি ফারছী নির্ভর যে বাংলা তার কদর করতে হবে । কবি নজরুল, সতেন্দ্রনাথ দত্ত, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, আব্দুল হাকিম, ভারত চন্দ্র প্রমুখ কবি সাহিত্যকগণ যে ভাষার কদর করেছেন, মর্যাদা দিয়েছেন। সেই ভাষাকে আগলে রাখতে হবে ।
এতদপ্রসঙ্গে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের মন্তব্য স্মরণীয়:
“যে হৌক সে হৌক ভাষা কাব্যরস লয়ে। ”
(উদ্ধৃত, মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যান )
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে আসল বাংলার কয়েকটি উদাহরণ লক্ষণীয়।
নবরাজ মজলিস আলাওলকে গ্রন্থ রচনার অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলেন:
” মছজিদ পুষ্কুর্ণী নাম নিজ দেশে রহে।
গ্রন্থকথা যথাতথা ভক্তি ভাবে কহে।।
গ্রন্থ পড়ি সকলের দীপ্ত হএ মন।
নাম স্মরি মহিমা করএ কতজন ।।”
(উদ্ধৃত, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম পৃষ্ঠা ২৭১)
অথবা কবি আলাওল তখন বলেন:
“আরবি কিতাব হন্তে ফারছী ভাষাএ।
রচিলা বয়েত ছন্দে ইউসুফ গদাএ।। ”
রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানকে নিয়ে জনৈক কবির লেখায় আসল বাংলার ইঙ্গিত লক্ষণীয়:
” খারাব করিল যত আশেকের তরে।
জোলেখা খারাব হৈল ইউসুফের উপরে।।
লায়লির উপরে মজনু হৈল আসক।
সংসার বিখ্যাত যার আশকি সাদক।। ”
আমাদের বাংলা ভাষা যা ছিল কত সহজ সরল। যা ছিল মানুষের মুখে মুখে ।
সংস্কৃত পন্ডিতগণ বাংলাকে সংস্কৃতের আত্মীয় বানাতে গিয়ে এসব প্রাকৃতজনের বা সাধারণের ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন অবলীলায়। সচেতনভাবে। যা বাংলা ভাষাভাষীকে চিরদিন ক্ষতবিক্ষত করতে থাকবে। হৃদয়ের গহীনে । তার দহন জ্বলতে থাকবে অনাদিকাল।
মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি আব্দুল হাকিমের মন্তব্য এ প্রসঙ্গে ইয়াদযোগ্য:
“দেশি ভাষা বিদ্য্যা যার মনে ন জুয়াএ।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ না যাএ।।”
–নূরনামা, আব্দুল হাকিম
ভাষার মর্যাদা রক্ষা করি। তাকে যথাস্থানে ব্যবহার করি। কাউকে বা কোন গোষ্ঠীকে ছোট করে নয়, বরং যার যার প্রাপ্য সম্মান তাকে দেই। তাহলে জাতি মুক্তি পাবে । আমাদের বাংলা ভাষা তথাকথিত সাধু বা কাঠিন্য থেকে পরিত্রাণ পাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। জনৈক কবির উক্তিই হোক আমাদের মুক্তির প্রেরণা। যা তিনি সচেতন কিংবা অবচেতন ভাবে ব্যবহার করেছেন। যা আমাদেরকে এক কাতারে এনে মেল বন্ধনের সৃষ্টি করেছে :
” নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ।
জগত ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।।”
মোহাম্মদ নূরুল্লাহ ফরিদপুর।