মহাত্মা মুহাম্মাদ ছবি খাঁ ও তাঁর কাল

মাহমুদ ইউসুফ।।

শেরে বাংলার বরিশাল। বরিশালের বীরনায়ক শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। শেরে বাংলার পূর্বকালে আরও একজন কর্মবীরের পরিচয় পাই ইতিহাস থেকে। সেই শ্রদ্ধেয় কীর্তিমান মুহাম্মাদ ছবি খাঁ। সপ্তদশ শতাব্দীর কণ্ঠস্বর ছবি খাঁ মুঘল যুগের একজন খ্যাতিমান চরিত্র। কল্যাণমুখি কর্মধারার প্রবর্তক, সুস্থধারার রাজনীতি চর্চা তাঁর সুকীর্তি। ন্যায়বিচারক, প্রজাবৎসল, জনসেবক ও সমাজসেবকের মূর্ত প্রতীক। মানুষের দুরাবস্থা, সমস্যা-সঙ্কট সমাধানে উদার হস্ত সর্বদা প্রসারিত থাকত। দুর্নীতি, অনিয়ম, অনাচার, সাম্প্রদায়িকতা ছিলো তাঁর সিলেবাস বহির্ভূত। আধুনিক যুগের রাজনৈতিক চর্চায় গুম, খুন, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, পৈশাচিকতা পষ্ট। পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ছবি খাঁর রাজনীতিতে এসব দুরাচার, অপকর্ম ছিলো অনুপস্থিত। মানুষের নিরাপত্তা ও জনজীবনে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেন ছবি খাঁ। তাঁর সময়কালে মানুষ নিñিদ্র নিরাপত্তায় রজনী কাটাতে পারত। ঘর-বাড়িতে দরজার দরকার হতো না। ভয়-আতঙ্ক বয়ে বেড়াতে হতো না আম জনতাকে। মধ্যযুগের চরিত্র চিত্রণে ছবি খাঁ এ সময়ের রাজনীতিকদের জন্য অনুকরনীয় ব্যক্তিত্ব। নীতির রাজা ছিলেন ছবি খাঁ। রাজার নীতি প্রয়োগ করেননি জনগণের ওপর। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিলো জনকল্যাণ। মানবসেবার ব্রত নিয়েই রাজনীতি করতেন। কায়েমি স্বার্থ তাঁর ছিলো না। সাম্রাজ্যে অবিচার নয়, ন্যায়বিচারের দন্ড ছিলো সর্বত্র। তাইতো সুখ-শান্তি সমূহ বিরাজ করত শাসিত ভূখণ্ডে। মগ-পর্তুগিজদের নৈরাজ্য ও দস্যুবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাকলাবাসীর অশেষ উপকার সাধন করেন এ কিংবদন্তি। তাইতো তাঁর কাছে বরিশালবাসী চিরঋণী।

বাকলায় স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নজির স্থাপন করেন। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সেই সময়ের রোল মডেল তিনি। উন্নয়নের মাইলফলক স্থাপন করেন সেই যুগে। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে এতদাঞ্চলে কোনো রাস্তা-ঘাট ছিলো না। ছিলো না উল্লেখযোগ্য বড় কোনো অবকাঠামো। ছবি খাঁনই এসবের উদ্যোক্তা। নির্মাণ করেন সড়ক-মহাসড়ক। পথ পথিক নয়, পথিকই পথ পয়দা করেন। ছবি খাঁ এই পথের প্রবক্তা। লোকালয়, হাটবাজার, শহর, বন্দর, নগরকে সম্পৃক্ত করেন প্রশস্ত পথ তৈরি করার মাধ্যমে। তিনি টরকি বন্দর থেকে কসবা, গৈলা, ধামুরা, ওটরা হয়ে মাধবপাশা পর্যন্ত বৃহৎ সড়ক নির্মাণ করেন। বাকেরগঞ্জ হতে ঝালকাঠি, ঝালকাঠি হতে রহমতপুর, শিকারপুর ও গৈলা হয়ে কোটালিপাড়া তক একটি রাস্তা ছিলো। গৈলা গ্রামে তাঁর তিনটি জাঙ্গাল বা রাস্তা ছিলো। একটি রামদাসের হাটখোলা হতে দক্ষিণে ধামুরা ও ওটরা, একটি পশ্চিমে কোটালিপাড়ার মধ্য দিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে এবং অন্যটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বর্তমান গৈলা-গৌরনদী সড়ক। রাস্তাগুলোর মধ্যে গৈলা-মশাং রাস্তা এখনও বর্তমান। এই রাস্তা টেরকা, কসবা, গৈলা, ধামুরা ও চাখার হয়ে মশাং তক দীর্ঘ। তিনি ভুরঘাটা থেকে বরিশাল পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করেন। এ রাস্তার ওপর ঢাকা বরিশাল মহাসড়ক। এসব সড়কের পাশে ছিলো অসংখ্য পুকুর, দীঘি, মুসাফিরখানা, মসজিদ। খাল, নদী সংযোগের জন্য তৈরি করতে হয়েছিল অসংখ্য পুল, সেতু। ঘণ্টেশ্বর গ্রামে ছবি খাঁর নির্মিত একটি ইটের পুল বর্তমানেও বর্তমান। [ বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, পৃ ২২১-২২২]

তাঁর সৃষ্ট সড়ক ছিলো খুবই প্রশস্ত ও উঁচু। চওড়ায় ২০-৫০ ফুট। হেনরি বেভারিজ লিখেছেন, ‘ছবি খাঁ ছিলেন সম্ভবত এ জেলার প্রথম সড়ক নির্মাতা। তাঁর সড়ক বা জঙ্গল এ জেলার উত্তরাঞ্চল বা উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে গৌরনদী ও কোটালিপাড়া থানা এলাকায় দেখা যায়। … এটা দেখাটা অবশ্যই সঙ্গত যে ছবি খাঁ তার সড়ক নির্মাণকালে পথচারীদের দৈহিক ও আধ্যাত্মিক চাহিদার কথাও চিন্তা করেছেন, সে জন্য তিনি তার সড়কের পাশে দিঘি খনন করেছেন এবং মসজিদ নির্মাণ করেছেন। এসব দিঘি ছবি খাঁর পাড় হিসেবে পরিচিত, রামসিদ্ধিতে তিনি একটি চমৎকার মসজিদ নির্মাণ করেছেন।’ [ পৃ ২৯৯] তিনি বাকলা, গৈলা, কসবা, মেহেন্দিগঞ্জ, কোটালিপাড়ায় মসজিদ নির্মাণ করেন। পুকুর, দিঘি, সরাইখানা, মসজিদ, স্থাপনা প্রভৃতি লোকহিতকর কাজে তাঁর সমকক্ষতা আজও কেউ অর্জন করতে পারেননি।

ভালো কিছু করার প্রবৃত্তি, অদম্য কর্মতৎপরতা, দুঃসাহসিকতা, সুকীর্তির জন্য এ মহাত্মা আজও পূজণীয়। দানশীলতা, ন্যায়বিচার, উদ্যোগ, সদিচ্ছা, কর্মস্পৃহা, সুনীতি তাঁকে মহান পুরুষের কাতারে পৌঁছে দিয়েছে। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ছিলেন মাতোয়ারা। রোহিনী কুমার সেন লিখেছেন, ‘এই জেলার অনেক স্থানে তিনি প্রশস্ত বর্ত্ম, ইস্টক নির্মিত সেতু, নির্মাণ করিয়াছিলেন; কেবল এ জেলায় কেন, যশোহর, খুলনা, ফরিদপর প্রভৃতি স্থানে তাহার নির্মিত বর্ত্ম এবং সেতু অদ্যাপি দৃষ্ট হইয়া থাকে। ইহা ‘ছবি খাঁর জাঙ্গাল’ বলিয়া প্রসিদ্ধ, অনেক স্থানে এই সমস্ত বর্ত্ম এখন আর পূর্বরূপ উন্নত অবস্থায় না থাকিলেও, যাহা আছে, তাহা যেরূপ প্রশস্ত এবং উন্নত নহে। এই মহাপুরুষ যে কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন, কালে তাহার লোপ হইলেও লোকে তাঁহাকে সহজে বিস্মৃত হইতে পারিবে না। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এই মহাপুরুষের কীর্তি ক্রমশই লোপ হইতেছে। স্বার্থ সিদ্ধির মানসে অনেকে ইচ্ছা পূর্বকই এই প্রাচীন কীর্তি লোপ করিতেছেন। … ছবি খাঁ যিনিই হউন না তিনি যে ধার্মিক ও পরোপকারী ছিলেন, তাহার আর সন্দেহ নাই। দুর্ভাগের বিষয় এই যে, আমাদের বর্তমান ইতিহাস লেখকগণ অনেক আবর্জনায় গ্রন্থের কলেবর পুষ্ট করেন। কিন্তু দেশহিতৈষী ছবি খাঁর নাম পর্যন্তও শুনেন নাই। রত্নপ্রসু ভারতভূমে যে কত স্থানে কত মহার্ঘ রত্ম শোচনাতীত স্থানে পঙ্কিলাবস্থায় পড়িয়া আছে, কয়জনে তাঁহার খোঁজ করে?’’ [পৃ ৬৯-৭১]

মুঘল যুগে বিশ্ব বাণিজ্যে ভারতের শরিকানা ছিলো ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ছিলো এক তৃতীয়াংশ। তাহলে দেখা যায়, ১৫-১৬ শতকে দুনিয়ার মোট সম্পদের এক চতুর্থাংশ ছিলো ভারতের। সেক্ষেত্রে পৃথিবীতে বাংলাদেশের হিস্যা প্রায় এক দশমাংশ। বিশেষ করে, আওরঙজেবের সুশাসনামলে সভ্যতার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির বিকাশ ঘটে উপমহাদেশে। মুঘল প্রতিনিধি হিসেবে এ কৃতিত্ব মুহাম্মাদ ছবি খাঁরও। মুসলিম আমলের সেই স্বর্ণালি যুগের সমাপ্তি ঘটায় ব্রিটিশ বেনিয়ারা। বাঙলার টাকায় শিল্প বিপ্লব ঘটে ম্যানচেস্টারে।

মহান মানুষটি কোন সময়কালের লোক ছিলেন, বিষয়টি নিয়ে তাত্ত্বিকরা একমত হতে পারেননি। ছবি খাঁ গবেষক অধ্যাপক আবদুল হাকিম ও ড. আহমদ হাসান দানি তাঁকে ইসায়ি ১৬ শতকের সুশাসক বলেছেন। রোহিনী কুমার সেন বলেছেন, এই মহাত্মা অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব। সিরাজউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, সপ্তদশ শতাব্দীর। গৌরনদীর বাটাজোড় ইউনিয়নের বাঙ্কুরা গ্রামে ছবি খাঁর ১০০ বর্গফুট আয়তনের হুজরাখানা রয়েছে। পাশের গ্রামে তাঁর পিত্রালয়। তিনি গৈলা গ্রামে সেনাবাহিনী নিয়ে বসবাস করতেন। এখানে গোলা-বারুদ তৈরি ও সংরক্ষণ করা হতো। তাই গ্রামের নাম গৈলা। গৈলার দাসের বাড়ির চারদিকে ইটের দেয়ালের ভিত পাওয়া গেছে। এটাই ছিলো ছবি খাঁর মোকাম।

সমকালীন যুগে গণতন্ত্র ধারণা ছিলো অনুপস্থিত। রাষ্ট্র বা সমাজে গনতন্ত্র থিওরির জন্ম হয়নি। গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা মানুষের কাছে ছিলো অজ্ঞাত। তবে ছবি খাঁর জীবনী পর্যালোচনায় আমরা দেখি তিনি পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যক্তি ছিলেন। প্রশাসনিক কাজে স্বৈরাচারী নীতি প্রয়োগ ছিলো নাপছন্দ। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে কখনও একক কর্তৃত্ব প্রয়োগ করার কোশেশ করেননি। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁর গণতান্ত্রিক কর্মপ্রক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ দৃশ্যমান। জমিদারদের মতো সেখানে ছিলো না খাজনা বাড়াবার কোশেশ বা খাজনা অনাদায়ে কৃষক-দিনমজুরকে সুরঙ্গে ফেলে নিঃশেষ করে দেওয়া। তাঁর প্রশাসনিক এলাকায় ছিলো না লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে কৃষকদের সবকিছু লুটে নেয়া। ভোগ নয়, ত্যাগেই তিনি সুখ খুঁজেছেন। ছবি খাঁর আমলে বাকলার জনসাধারণ আধুনিককালের পূর্ণ গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা পুরোটাই ভোগ করতেন।

শেষ জীবনে এ মহানায়ক বিয়োগান্তক ঘটনার সম্মুখীন হন। প্রতারণামূলক ট্রাজেডি তাঁকে গ্রাস করে। নবাব ভুল মেসেজের কারণে ছবি খাঁকে গ্রেফতার করেন। গৈলার মিশ্র বংশের আদি পুরুষ রাম মিশ্র এ ষড়যন্ত্রের নায়ক। তিনি কৌশলে নবাব সৈন্যদের বন্দি কাজে সহযোগিতা করেন। ছবি খাঁর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

ছবি খাঁ ছিলেন মুকুটহীন সম্র  াট  মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সুসংহতকরণের এজেন্ডায় জীবন পার করেন। চাষি, মাঝি, তাঁতি, জেলেদের পীড়িত ক্লিষ্ট মুখে ফুটিয়ে তুলেছেন হাসি। ঐতিহাসিক সোনারবাংলা সৃষ্টিতে তাঁর কৃতিত্ব অসীম, অপরিমেয়। সুদক্ষ শাসনে সমাজ ছিলো সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ। বিভিন্ন ধর্মবর্ণ সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও কর্মক্রম ছিলো হৃদ্যতাপূর্ণ। অতিশয় মধুর সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয় জাতিসমূহের মধ্যে। সময় এসেছে তাঁর নামে অজস্র্র প্রশস্তির, সময় হয়েছে ছবি খাঁর কীর্তিকে প্রণতি জানানোর।

বিখ্যাত বয়ান:
মহাত্মা মুহাম্মাদ ছবি খাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি পাঠক সমীপে পেশ করা হলো:
যদি সর্বসাধারণের উপকারার্থে, অজস্র্র অর্থ ব্যয় করে স্থানে স্থানে প্রশস্ত সড়ক, দিঘি, পুকুর, মুসাফিরখানা, মসজিদ, সেতু, পুল প্রভৃতি নির্মাণ করা যায়, তবে যেরূপ অক্ষয় সওয়াব সঞ্চয় হয়, তদ্রুপ সর্বসাধারণের নিকট চিরস্মরণীয় হয়ে অক্ষয় কীর্তিবান হওয়া যায়।

বরাত:
১. সিরাজ উদদীন আহমেদ, বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, ২. আজিজুল হক বান্না, বরিশালে ইসলাম, ৪. এ. এফ. এম আব্দুল জলীল, সুন্দরবনের ইতিহাস, ৬. রোহণীকুমার সেন, বাকলা, ৫. এইচ. বেভারেজ: দি ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *