মানুষের কল্যাণে নিবেদিত বরিশাল আল ইখওয়ান ইয়াতিম খানা ও কমপ্লেক্স

মোঃ মমিন উদ্দিন রানা

বরিশাল নগরীর নবগ্রাম সড়কের ২৭ নং ওয়ার্ড, সোনামিয়ার পুল বাজারের উত্তর পাশেই আল ইখওয়ান ইয়াতিম খানা ও কমপ্লেক্স অবস্থিত। দেখেই মনে হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ। যা বহু গুণীজনের একনিষ্ঠ পরিশ্রমের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সামগ্রিক প্রচেষ্টার ফল। কমপ্লেক্স এলাকা জুড়ে রয়েছে ইয়াতিমখানা, জামে মসজিদ, দাখিল মাদরাসা, নূরানী মাদ্রাসা, হাফেজি মাদ্রাসা, মুসলিম গোরস্থান ও দাতব্য চিকিৎসালয়। সব মিলিয়ে আত্মমানবতার সেবাদানের একটি বিশেষ প্ল্যাটফর্ম এই কমপ্লেক্স। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭০ জন ইয়াতিম ও পরিত্যক্ত শিশু লালন পালনকারী ইয়াতিম খানাটি বরিশাল জেলার অন্যান্য ইয়াতিমখানার তুলনায় বহুগুণে এগিয়ে আছে। বরিশাল জেলা প্রশাসক এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আল ইখওয়ান ইয়াতিম খানা ও কমপ্লেক্স পরিদর্শন করে এর ভূয়সী প্রশংসা করছেন। আল ইখওয়ান ইয়াতিম খানা ও কমপ্লেক্স সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠান।

১৯৯৩ সালে তৎকালীন রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের ডেফুলিয়া গ্রামে আল ইখওয়ান ইয়াতিমখানা ও কমপ্লেক্সের কার্যক্রম শুরু করা হয়। সে সময় এলাকার রাস্তাঘাট, অবকাঠামো ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপর্যাপ্ততার কারণে স্থানীয় তরুণ জনগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিলো। সু-শিক্ষা না থাকার কারণে স্থানীয় অধিকাংশ মানুষ সামাজিক শৃঙ্খলা বা মানবীয় গুনাবলীর অভাবে প্রকাশ্যে অনেক জঘন্য অন্যায় ও জুলুমে নিমজ্জিত ছিলো। এখানে মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বানকারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল ফলে মানুষের মধ্যে দ্বীনি জ্ঞানের ও পূর্ণতা ছিল না।

অবশেষে বরিশাল শহরের আদর্শ হোমিও ফার্মেসির মালিক দক্ষিণ বঙ্গের বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক সৈয়দ আব্দুর রাজ্জাক এখানকার অবস্থা অবলোকন করে সমাজ সেবার হাত বাড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু করেন। ব‌রিশাল শহ‌রের কিছু ইসলাম প্রিয় ব‌্যক্তি‌কে সা‌থে নি‌য়ে তিন‌ি সোনা‌মিয়ার ‌পুল বাজা‌রের প‌শ্চিম-উত্তর পা‌শেই ১৯৮৫ সা‌লে আল ইখওয়ানা স‌মিত‌ি গঠন করেন। প্রাথমিকভাবে আল ইখওয়ান সমিতির সমাজ সেবামূলক প্রজেক্ট আল ইখওয়ান সমাজ কল্যাণ পরিষদ নামে দাতব্য চিকিৎসালয় ও নৈশ বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয় I ১৯৯৩ সালে আল ইখওয়ান সমাজকল্যাণ পরিষদের নাম পরিবর্তন করে ‘আল ইখওয়ান ইয়াতিমখানা ও কমপ্লেক্স’ নামে বর্তমান কমপ্লেক্সের যাত্রা শুরু হয়। শুরুর দিকে মাত্র ১০ জন ইয়াতিম শিশু ভর্তি করে এর উদ্যোক্তাগণ আল ইখওয়ান ইয়াতিম খানার কার্যক্রম শুরু করেন।

সে সময় International Islamic Relief Organization (IIRO) নামক একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায় ও বিশেষ সুধীজনের দান, সদকা, যাকাত, ফিতরা ইত্যাদির মাধ্যমে ইয়াতিমখানার কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। এক সময় এই দাতব্য সংস্থাটির আর্থিক সহযোগিতা প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে ইয়াতিমখানার কার্যক্রম পরিচালনা করতে এর উদ্যোক্তাগণ অনেক বেগ পেতে হয়। ১৯৯৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন একটি বেসরকারী ইয়াতিমখানা হিসেবে সরকারি ক্যাপিটেশন গ্রান্ট প্রাপ্ত হলে ইয়াতিমখানার কার্যক্রম আরো সুচারু-রূপে পরিচালনা করা সহজ হয়। পাশাপাশি বরিশাল শহরের অসংখ্য সুধী, শুভাকাঙ্ক্ষীদের আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে ইয়াতিমদের সেবায় এ প্রতিষ্ঠানটিকে ঘরে তোলেন এক অনন্য উচ্চতায়।

আল ইখয়ান ইয়া‌তিমখানা ও কম‌প্লেক্স‌টি বি‌শেষ কিছু ‌বৈ‌শি‌ষ্টের জন‌্য সর্ব মহ‌লে প্রশং‌‌‌সিত। প্রতিষ্ঠাতা‌দের তথ‌্যম‌তে ‌কিছু  বৈ‌শিষ্ট‌্য উ‌ল্লেখ কারছি

এক. ইয়া‌তিম ‌শিশু‌দের আদর্শ নাগ‌রিক ‌হিসা‌বে গ‌ড়ে তোলা: ইয়া‌তিম নিবাসী ‌শিশু‌দের পাঠ দা‌নে সবসময় কর্তৃপক্ষ সজাগ দৃ‌ষ্টি রাখ‌ছেন, যার ফ‌লে তা‌দের মেধ‌া বিকা‌‌শের ‌‌‌ক্ষে‌ত্রে অন‌্যান‌্য শিশু‌দের তুলনায় এ‌গি‌য়ে আ‌ছে। ইসলা‌মি জ্ঞা‌নের পাশাপা‌শি যে‌ কো‌নো বিষ‌য়ে তা‌দের দক্ষতা বৃ‌‌দ্ধির জন‌্য কম‌প্লে‌ক্সে পাঠাগার স্থাপন ও তা শিশু‌দের জন‌্য উন্মুক্ত করা আ‌‌ছে। প্রতি‌দিন তা‌দের বি‌নোদ‌নে জন‌্য প্রয়োজনীয় ‌খেলাধূলা‌র ব‌্যবস্থা রয়েছে।

দুই. সুষম খাদ‌্য ও‌ যথাযথ স্বাস্থ‌্যসেবাঃ নিয়‌মিত খাদ‌্য তা‌লিকা অনুযায়ী খদ‌্য প‌রি‌বেষন করা হয়। এছাড়া সুধীজ‌নের দাওয়া‌তের মাধ‌্যমে শিশু‌দের প্রায় উত্তম খাবার দেয়া হয়। এক কথয় শিশু‌দের পু‌ষ্টিকর খারার প্রদা‌নে ইয়া‌তিম খানা প‌রিচালনা পর্ষদ সর্বদা স‌চেষ্ট। ‌শিশু‌‌‌দের ‌‌যে কো‌নো অসুস্থতায় তাৎক্ষ‌ণিক চি‌কিৎসা সেবা প্রদা‌ন করা হয়।

তিন. ‌পোষাক প‌রি‌চ্ছেদ ও প্রফুল্ল মান‌শিকতা ‌‌‌তৈ‌রি করাঃ প্রতি ঈ‌দে সকল ইয়া‌তিম ‌শিশু‌দের নতুন ‌পোষাক ও সর্বদা প্র‌য়োজনীয় ‌‌‌তৈষজ প‌ত্রে‌র ব‌্যবস্থা করা হয়। সবসময় শিশু‌দের হা‌সিখু‌সি ও প্রফুল্ল রাখ‌তে অফুরন্ত সেবা দি‌য়ে যা‌চ্ছেন তা‌দের খা‌দেমগন।

চার. হিসাব কিতা‌বে সচ্ছতাঃ ইয়া‌তিমখানার সকল প্রকার আয়-ব‌্যয় এক‌টি ‌রে‌জিষ্টা‌রে পুঙ্খানুপুঙ্খভা‌বে প‌রিচালনা ক‌মিট‌রি প্রতি‌নি‌‌‌ধির মাধ‌্যমে সং‌ক্ষিত হয়। র‌শিদ ছাড়া কোন আয় এবং ভাউচার ছাড়া কোন ব‌্যয় করা হয় না। কা‌জেই সম্মান‌তি শুধীজ‌নের সকল প্রকার আ‌‌র্থিক সহ‌যো‌গিতা যথাযথভা‌বে ইয়া‌তিম শিশু‌দের কল‌্যা‌ণে ব‌্যয় করা হয়।

পাঁচ. শিশু‌দের সা‌র্বিক নিরাপত্তা প্রদানঃ কম‌প্লে‌ক্সের নতুন বাউন্ডা‌রি ও গেট ক‌রে শিশু‌দের আবাস্থ‌লে নিরাপত্তা বৃ‌দ্ধি করা হয়। শিশু‌দের প্রয়োজনীয় সব‌কিছু কম‌প্লেক্স অভ‌্যন্ত‌রে প্রদান করা হয়।

প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি আলাউদ্দিন শরীফ বলেন, শুরুর দিকে যত উদ্যোক্তা ছিলেন তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। যারা এখনো জীবিত আছেন তারা কমপ্লেক্স উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের পরিশ্রমের ফলে ক্রমান্বয়ে ইয়াতিম খানা ও কমপ্লেক্স এর সার্বিক উন্নতি হচ্ছে। ইয়াতিমখানা ও কমপ্লেক্স সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা, সুধীজন ও জনশক্তিদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে মহান রব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন করা।

মোঃ মমিন উদ্দিন রানা

 

One comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *