লালচান বিবি

নুরুল আমিন ।।

গ্রামের মানুষ যাত্রা, পুতুল নাচ, বায়স্কোপ এসব দেখতে খুব পছন্দ করেন। একসময় এগুলো ছিল গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। একদিন মেহেরগঞ্জের হাটে মানুষ দলবেঁধে বায়স্কোপ দেখছিল। আজকের বায়স্কোপের প্রধান আকর্ষণ লালচান বিবি। মেহেরগঞ্জে কয়েকদিন ধরে ঢোল পিটিয়ে জানান দেয়া হয়েছে। খবর পেয়ে মানুষ দলে দলে লালমোহন ভূমি অফিসের সামনে বড় সৃষ্টিগাছের তলায় ভীড় জমাতে শুরু করলো। লোকজনের আগ্রহ দেখে বায়স্কোপের গায়ক মনে মনে খুব খুশী হলেন। বায়স্কোপের বাক্স কাঁধে করে বহন করা খুব কষ্ট। কিন্তু কষ্ট করে বহন করে এনে হাটে বায়স্কোপ দেখিয়ে যা পয়সা পায়, তাতে তার সংসার চলে না। কোন রকমে দিন কাটে। তাছাড়া কত সুন্দর পরী, রাজা-রানি বায়স্কোপে দেখালো, তাতে মানুষের সাড়া অতটা পায়নি, যতটা আগ্রহ লালচান বিবি দেখার জন্য মানুষের মধ্যে দেখা যায়। মানুষের ঢল নেমেছে।
আজকে লালচান বিবি দেখার জন্য এক একজনে তিন চারটি টিকেট কিনেছে। যারা টিকেট সংগ্রহ করেছে, তাদেরকে ভূমি অফিসের সামনে থাকতে বলা হয়েছে। ভূমি অফিসের সামনে দিয়ে বয়ে চলা রাস্তার দক্ষিণ পাশে দত্ত পাড়া পুকুর পাড়ে বালিকা বিদ্যালয়, প্রেসক্লাব ও মুরুব্বিদের একটি ক্লাব ঘর। এখানে বসানো হলো বায়স্কোপের বাক্স। আজকে বায়স্কোপের গায়ক সেজেছে এক নতুন সাজে। আরও কয়েকজনে খুব সেজেগুজে হাজির হয়েছে বায়স্কোপ দেখাতে।
লালচান বিবি বায়স্কোপ দেখানো শুরু হয়ে গেলো। বায়স্কোপের চমকে আর গায়কীর ঠমকে মানুষের মনে আনন্দের জোয়ার এসেছে। গায়ক সুরের ভেলায় ভেসে ভেসে ঠমকে ঠমকে যা বলছেন, তার দেখা মিলছে বায়স্কোপের ভেতর। মন মাতানো ছন্দে সুরের ঝংকার তুলে বায়স্কোপের মজার কাহিনী বলে যাচ্ছে গায়ক।
যা ছিল এরকম – আহা!  কী চমৎকার দেখা গেছে। লালচান বিবি আইসা পড়ছে। পান খাইয়া ঠোঁট লাল করছে। আলতা রাঙা পায়ে হেঁটে চেয়ারেতে বইসা পড়ছে। লাল শাড়ি পিন্দা রইছে। হাতে একটা লাঠি আছে। হাত ভরা চুড়ি আছে। লাল মিয়া দেইখা ফেলছে। কী জানি কী ভাবতে আছে। আস্তে আস্তে আইতে আছে।… …
হঠাৎ বিকট একটা আওয়াজ হলো। বায়স্কোপের গান থেমে গেছে। থেমে গেছে রঙের মেলা। ভয়ে মানুষ ছুটাছুটি করছে। বিকট হাসির শব্দ শোনা যায়। খিলখিল করে হাসতে হাসতে বায়স্কোপের বাকসা থেকে বেরিয়ে এলো লাল বেনারসী শাড়ি পড়া লালচান বিবি। আলতা রাঙা পায়ে হেঁটে সামনে এসে দাঁড়ালো। বায়স্কোপ ওয়ালার চোখ যেন কপালে উঠে গেছে। বায়স্কোপের নায়িকা তার চোখের সামনে, এ যেন জীবন্ত এক কিংবদন্তি। যা ভাবতে অবাক লাগে। কল্পনার লালচান বিবি এখন বাস্তবে হাজির। সে পান চিবাচ্ছে। লাল ঠোঁট। হাত ভরা চুড়ি। পিন্দনে লাল শাড়ি। হাতে একটা লাঠি। চোখে আগুন। মুখে হাসি।
সে বায়স্কোপ ওয়ালার সামনে এসে দাঁড়ালো। আর বলতে লাগলো – আমি লালচান বিবি। হা হা হা। আমি লালচান বিবি। খাড়ায়া কী দেখতে আছত। কী ভাবতে আছত। আমারে কী চমৎকার দেখা যায় তাই না! হা হা হা। আমি লালচান বিবি। হা হা হা। আমার পায়ে আলতা, হাতে মেথি, গায়ে হলুদ  এখনও শুকায়নি। আমারে লাল মিয়া দেইখা ফেলছে তাই না! হা হা হা। আমারে দেইখা কী জানি কী ভাবতে আছে। আস্তে আস্তে আইতে আছে। কী কইরবো? আমারে লইয়া যাইবো? হা হা হা। ওই মিয়া। তোমার কথা মিছা না। তুমি হাছাই কইছ। তোমার বায়স্কোপের গল্প হাছা।
আমি এই বাংলার কোন এক গাঁয়ের দুলালী মেয়ে, কোন এক গাঁয়ের বধূ। (অঝর কান্নায় ভেঙে পড়ে।) আমি লালচান বিবি। লাল শাড়ি পিন্দা স্বামীর বাড়ি যামু। কত আশা! কত স্বপ্ন এই বুকে! কিন্তু না। আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ওই হায়ানার দল আমার স্বপ্ন ভেঙে দিছে।
আমি বাঙালি নারী। বাংলার জমিনে ছোট্ট একটা শান্ত সুখের ঘর বাধার স্বপ্ন দেখছিলাম। আমার সেই স্বপ্নের ঘরে ঝড় উঠলো, ঝড়, দুর্দম দুরন্ত ঝড়। সেই ঝড়ের তান্ডব ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত বাঙালির ওপর। রুখে দাঁড়ালো বাঙালি। রুখে দাঁড়ালো বাংলার দামাল ছেলেরা। শুরু হলো যুদ্ধ। যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ। লাল-সবুজের একটি পতাকার জন্য যুদ্ধ, অধিকারের জন্য যুদ্ধ, বাঁচার জন্য যুদ্ধ, মানচিত্রের জন্য যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ।
কত শত রঙিন সুখস্বপ্নে আঁকা আমার জীবনের মধুরাত। ওই রাতে কত আবেগ, কত অনুভুতি, কত প্রেম-ভালবাসায় সিক্ত কত রকম আনন্দে নাইওরী সেজে রঙিন বাসরে গেলাম। আমার সেই মধুরাতে পাকিস্তানিদের পা চাটা কুত্তা রাজাকার লাল মিয়া পাকবাহিনী নিয়ে আসে। আমার স্বামী আর আমারে ধরে নিয়ে গেলো তাদের ক্যাম্পে। আমার স্বামীকে তারা আলাদা করে নিয়ে গেলো। আমি একা নয়। আরও অনেক বাঙালি নারী ধরে তারা ক্যাম্পে নিয়ে আসে। হায়নাদের আঁচড় থেকে বাঁচতে কত কানলাম, কত মিনতি করলাম। কিন্তু ওই পাষণ্ড হায়ানাদের মন গলেনি। তারপর বাকিটা ইতিহাস……. । হা হা হা। কোথায়? কোথায় আমার স্বামী? এই তোমরা দেখেছো তারে? দেখনি তোমরা? ওই যে দেখো, আমার স্বামী মিশে আছে, লাল-সবুজের পতাকায়। হা হা হা।
অদৃশ্য হয়ে গেলো লালচান বিবি। আবার শুরু হলো বায়স্কোপ দেখা। লালমোহনে সেই দত্ত পাড়া পুকুর, সেই ভূমি অফিস, সেই বালিকা বিদ্যালয় এবং  মুরুব্বিদের ক্লাব ঘর সবই আছে। শুধু নেই লালমোহন প্রেসক্লাব ঘর। ১৯৮৪ সাল থেকে লালমোহন প্রেসক্লাবের যাত্রা শুরু হয়। শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক, শিক্ষক ও গুণীজন আব্দুর রাজ্জাক এটি প্রতিষ্ঠা করেন। মেহেরগঞ্জ তথা লালমোহন বাজারের খাস জমি বরাদ্দ নিয়ে ব্যক্তিগত বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও আজ পর্যন্ত লালমোহন প্রেসক্লাবের জন্য কোন জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়নি। কোন ভবন নির্মাণ হয়নি। ভাড়া ঘরে, খানিক এখানে, খানিক ওখানে। এভাবেই চলছে লালমোহন সাংবাদিকদের সংগঠন। লালমোহন প্রেসক্লাবের জন্য জায়গা বরাদ্দ ও ভবন নির্মাণ করে দিবে বলে অনেকেই কথা দিলেও কথারা শুধু কথাই থেকে গেলো। লালমোহন প্রেসক্লাবের জন্য জায়গা বরাদ্দ ও ভবন নির্মাণ করা হোক, এটাই স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রাণের দাবি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও প্রাবন্ধিক, লালমোহন, ভোলা।

[email protected], 01759648626

৭ comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *