সাব্বির আলম বাবু
শীতের আগমনে খাদ্যরসিক বাঙ্গালির মন-প্রাণ আকুলি-বিকুলি করে শীতের পিঠা, খেজুরের রস আর গুড়ের স্বাদ নেয়ার জন্য। নবান্নের নতুন ধানের আলবা চালের (পিঠা তৈরির এক ধরনের চাল) চিতই পিঠা কোড়ানো নারকেল আর ঝোলা গুড়ে ডুবিয়ে খাওয়ার কথা মনে হলেই যে কারো জিভে পানি আসবেই। তাই শীতের মৌসুমে খেজুরের গুড়ের চাহিদা থাকে ব্যাপক। গ্রামাঞ্চলে কৃষকের দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম মাধ্যম খেজুরের গুড়। তাই শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে কদর বেড়ে যায় খেজুর গাছের। গাছ থেকে রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি সেই গুড় দিয়ে নানান রকমের শীতকালিন পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায় আবহমান গ্রাম বাংলায় । সারা বছর অবহেলিত খেজুর গাছগুলোকে কৌশলে কেটে নতুন রূপ দেন গাছিরা। এরপর তীব্র শীতে শুরু হয় রস সংগ্রহ এবং সেই রস থেকে গুড় তৈরির কাজ।
কোনো কোনো পরিবারের জন্য শীতের সময় এটাই উপার্জনের প্রধান হাতিয়ার। রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড় ও পাটালি তৈরি করে বিক্রি করেন বাজারে। সেই টাকা দিয়েই পরিবারের জন্য কেনেন শীতের গরম কাপড়। চলে ছেলে-মেয়ের স্কুলের পড়ালেখার খরচ। পরিশোধ করেন ঋণের কিস্তি। তৈরি খেজুর গুড় গাছের মালিককে দেয়ার পর এবং নিজের পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের চাহিদা মিটিয়ে গুড় বিক্রি করে যে অর্থ আসে তা দিয়ে সংসারচলে। শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে খেজুর রস বেশি পাওয়া যায় এবং এই রস আরও বেশি মিষ্টি হয় এবং গুড়ের মানও ভালো হয়। হাঁড় হিম করা শীতে কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুলে ঝুলে রস সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন গাছিরা। গাছিদের শিউলিও বলা হয়। পেশাদার গাছিদের তেমন কোন সমস্যা না হলেও রস সংগ্রহের এক শ্রেণির উৎসুক মানুষও পিছিয়ে নেই। তারা দূঃসাহসিক শক্তি নিয়ে গাছে ওঠা নামা করেছে রস সংগ্রহের জন্য। ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাদের নিত্য কাজ এটা।
প্রথমে রস সংগ্রহ করা হয় মাটির পাত্রে। এরপর মাটির পাত্র থেকে সব রস ঢালা হয়বড় টিনের পাত্রে কড়াইতে। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে তাফাল। ধানের খড়কুটোর আগুনে জ¦াল দেয়া হয় কাঁচা রস। আগুনের তাপে রস এক সময় লাল রং ধারন করে এবং ঘন হয়ে আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত মানের গুড় তৈরির জন্য রস সংগ্রহ প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে রস ছেঁকে চুলার উপর বসানো লোহার বা স্টিলের কড়াইতে ঢালা হয়। চুলার উপর কড়াই রাখার পর আগুন জ্বালানোর আগে খেয়াল রাখতে হবে কড়াই ও চুলার মাঝেযাতে কোনো ফাঁকা না থাকে। আরও খেয়াল রাখতে হবে চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া যাতে রসের সাথে মিশতে না পারে। আগুন দিয়ে রস জ্বাল দেয়ার প্রাথমিক অবস্থায় যে ফেনা হয় তা সরিয়ে ফেলতে হয়। ফেনা ফেলতে দেরি হলে সেগুলো রসের সাথে মিশে জটিল অপরিশোধনযোগ্য অবস্থায় চলে যাবে। ধীরে ধীরে ফুটন্ত রস ঘনিভূত হয়ে আসলে সেগুলো হাতা দিয়ে অল্প পরিমাণে তুলে ফোটায় ফোটায়ফেলে দেখতে হয়Ñআঠালো ভাব আসছে কি না। আঠালো বা সিরাপের মতো দেখা গেলে ঝোলা গুড় তৈরি করা যায়। গুড়চাষীরা খুব সহজেই এভাবে খেজুরের রস থেকে ঝোলা গুড় বা পাটালি গুড় তৈরি করেন। এই গুড় তৈরিপ্রক্রিয়া সাধারণত ইংরেজি নভেম্বর মাস থেকে শুরু হয়।
এভাবে তৈরিহওয়া নানা রকম গুড় বিক্রি করা হয় গ্রামের বিভিন্ন বাজারে। গাছিরা খেঁজুরের গুড় তৈরি করে পাইকারি বাজারে ১০০-১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন।খেজুর গুড় খুবই সুস্বাদু। শীতের বিভিন্ন মুখরোচক পিঠা-পুলি তৈরিতে এই গুড়ের ব্যবহার ব্যাপক।গুড়ের পাশাপাশি খেজুরের কাঁচা রসও বেশ জনপ্রিয় সর্বস্তরের মানুষের কাছে। রসও ব্যবহার করা হয় পিঠা, ক্ষীর, পায়েস তৈরির কাজে। খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া ইত্যাদি তৈরি করা হয়।স্বাদ ও মান ভেদে খেঁজুরের গুড় পাটালি, নলেন, হাজারী, ঝোলা ও চিটাগুড় নামেও পরিচিত। নবান্নের পিঠা আর গুড়ের সমারোহে শীতের এই আমেজ ছড়িয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। এই সময়ে কৃষকের মুখে দেখা যায় স্বস্তি আর আনন্দের ছাপ।
তবে দুঃখের বিষয় হলো কালের পরিক্রমায় খেজুর রস ও গুড় এখন বিলুপ্তির পথে। এর কারণ হিসেবে কৃষকরা দায়ী করছেন ন্যায্য মূল্য না পাওয়াকে। সঠিক মূল্যায়ন ও পরিচর্যা করলে খেজুর গুড়ও হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রার বড় উৎস। বিখ্যাত লেখক -কবিদের লেখায় সাহিত্যের বিভিন্ন উপমা ব্যবহারেও উঠে এসেছে শীতের পিঠা ও খেজুরের গুড়।
লেখক: সাংবাদিক